একজন রোজাদার রমজান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ- বিশেষ করে হাত, পা, চোখ, মুখ, উদরকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রেখে সংযমী হয়। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা পায়। রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন বান্দা হিংসা-বিদ্বেষ, কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে থাকে। ফলে কুপ্রবৃত্তির সব দেয়াল ভেঙে যায়। খারাপের ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যায়। অন্তর নির্মল ও সুন্দর হয়।
কিন্তু আমরা কী পরিকল্পনা করেছি রমজানের দিনগুলিকে ঈমান ও এহতেসাবের সাথে অতিবাহিত করার? ফলপ্রসূ রোজা পালনের পাশাপাশি সুস্থতার সাথে পবিত্র রমজান কীভাবে অতিবাহিত করা যায় সে বিষয় এখন আমরা জানার চেষ্টা করবো।- কীভাবে রোজার দিনগুলি অতিবাহিত করবো সংক্ষেপে তা নিয়ে একটু আলাপ করা যাক-
রোজায় যা করা উচিত নয়:
- অতিরিক্ত ঘুমানো।
- অলস সময় কাটানো।
- টিভি দেখে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার করে সময় কাটানো।
- নফল ইবাদাতের কথা বলে বেড়ানো।
- ভারী কাজ করা।
- সারারাত জেগে থাকা (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম ঘুম থেকে উঠে সেহরি খেতেন)
- তারাবী নিয়ে বিতর্ক করে তাহাজ্জুদ-তারাবী কোনোটাই না পড়া।
- সেহরীতে ও ইফতারে অতিরিক্ত খাওয়া।
- বেশি কথা বলা বা একদম চুপ থাকা।
রোজায় যা করা অতীব জরুরী:
- এই রমজানকে জীবনের শেষ রমজান মনে করে পুরো মাস রোজা রাখার নিয়্যত করা।
- পুরো রমজানের জন্য একটি সুন্দর রুটিন তৈরি করে এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ক) সকালে কি কি কাজ করবেন? বিকালে কি কি কাজ করবেন? সন্ধার পর কি করবেন? এর একটি তালিকা তৈরি করা।
খ) বিশেষ করে বলপ্রয়োগের কাজ, চিন্তাশীলতার কাজ, গবেষণার কাজ, মুখস্ত করার কাজ, বাহিরের কাজগুলো মধ্যাহ্নের আগে করা।
গ) হালকা কাজগুলো দুপুরের পর করা, আসরের পর ভারী কোন কাজ না করা এবং তখন না ঘুমানো।
- খাদ্য তালিকা তৈরি করা।
- যথা সম্ভব ভাজাপোড়া কম খাওয়া।
যে খাবারগুলো বেশি উপকারী:
- রসুন: হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী খাদ্য হিসেবেই পরিচিত রসুন। কয়েক কোয়া রসুন মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
- সবুজ চা: শরীরকে বিষমুক্তকরণের আরেকটি উত্তম পন্থা হল নিয়মিত সবুজ চা পান করা।
- আদা: বমিবমি ভাব দূর করতে, হজমপ্রক্রিয়ার উন্নয়ন, পেটফাঁপা থেকে মুক্তি ও পেটের গ্যাস নিঃসরণে আদা খুবই কার্যকরী খাদ্য।
- লেবু: লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এই উপাদানগুলো ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি শরীরে রোগবালাই সৃষ্টিকারী অযাচিত উপাদান সৃষ্টি প্রতিরোধ করে।
- ফলমূল: তাজা ফলমূলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, খনিজ পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আঁশ রয়েছে। ফলের ক্ষেত্রে আপেল, কলা, কমলা, স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, আম, তরমুজকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে।
- গাজর: গাজরে ম্যাগনেশিয়াম, লোহা ও ভিটামিন সিতে পরিপূর্ণ, যা স্বাস্থ্যের জন্য বহুমুখী উপকারীতা বয়ে আনে। এই খাদ্যটি রক্তে কোলোস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও লিভারকে বিষমুক্তকরণে খুবই কার্যকরী।
- বাদামি চাল: বাদামি চালে ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফোরাসের মতো শরীরকে বিষমুক্তকরণের প্রধান প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলো রয়েছে।
- ইফতারের পর কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
- অতিরিক্ত মিষ্টি ও মশলা জাতীয় খাবারগুলো না খাওয়া। ইফতার বা সেহরীর পর পরই চা না খাওয়া। ইফতারের কমপক্ষে ২ ঘন্টা পর চা খাওয়া উচিত।
- নফল ইবাদতে প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করা।
- দৈনন্দিন কাজে ব্যবহ্নত দো’আগুলোর তালিকা তৈরি করে মুখস্ত করা।
- বিষয় ভিত্তিক আয়াত মুখস্ত করা এবং বিশেষ করে ৩০তম পারাটি মুখস্ত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো এবং এর অর্থ ও তাফসীর পড়া। অন্তত একবার পুরো কোরআন পড়া, তেলাওয়াত শোনা, পাশাপাশি ইয়াসীর ক্বাদীর ‘The Message of the Quran’ সিরিজটি শোনা যেতে পারে। এতে করে ১ ঘন্টা করে ৩০টি এপিসোডে সংক্ষেপে ৩০টি পারার সারাংশ সহজেই জেনে নেয়া যায়। (নিম্নে এর লিংক দেয়া হলো- www.youtube.com/watch?v=1gdi1W_HSRk&list=PLYZxc42QNctUnn09Of4rBuakQhu-Q2qpc)
- নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করা।
- বেশি বেশি দান-সাদকাহ করা।
- সার্বক্ষণিক জিকির (আল্লাহর স্মরণ) করা।
- সৃজনশীল কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। যে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল কাজ বা কথা থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম এর সীরাত পড়া। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত পুস্তকাদি পড়া কিংবা আপনার পছন্দের টপিক নিয়ে পড়া। পড়ার সময় অবশ্যই সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পড়া যেন পরবর্তীতে তা নিয়ে সিরিজ লেখা যায়।
- ক্যারিয়ারে কাজে লাগবে এবং সফট স্কিল ডেভেলপ করার জন্য এক বা একাধিক কোর্স করা যেতে পারে। এটা আপনার ফিউচার টার্গেটের সাথে মিল রেখে হতে হবে। এখন হাতের নাগালেই এমন শত কোর্স পাওয়া যায়।
- সুযোগ থাকলে এতেক্বাফও করা যেতে পারে। এতে করে ধৈর্য বাড়বে, সহনশীলতা বাড়বে, নিজের মাঝে স্থিরতা আসবে, প্রতিক্রিয়াশীলতা কমবে। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তোষ অর্জন তো আছেই।
রমজান মাস হচ্ছে ইবাদতের বসন্তকাল। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে ইবাদতে মশগুল থাকেন। রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সারা মাসের জন্য শয়তানকে বেড়িবদ্ধ করা হয়। মানুষ তার পেট ও লজ্জাস্থানের চাহিদা মেটানোর তাড়নায় গুনাহ করে। তাই তাকওয়া অর্জনের নিমিত্তে এই দুই ধরনের গুনাহের উৎসকে দুর্বল করতে আল্লাহতায়ালা রোজার বিধান দিয়েছেন। রোজার দাবি তাকওয়া অর্জন। আর এ জন্য সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
একজন আল্লাহর প্রেমিকের সওম হয় সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে মুক্ত। প্রকৃত রোজাদার পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি ছাড়াও শিরক, কুফর, বিদআত, হিংসা-লোভ, পরচর্চা ও পরনিন্দা থেকেও আত্মাকে পবিত্র রাখেন, আল্লাহর প্রেমরঙে হৃদয় রাঙান। কেবল তখনই একজন রোজাদার খুঁজে পান নিজেকে, নিজের সত্তা ও আত্মপরিচয়কে।
- চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ‘রোজা মানুষের মনের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। যেমন, কর্মে মনোযোগ আসে, পশুত্ব দূরীভূত হয়, সমাজ গঠনে সহায়তা করে।’ ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘সিয়াম মুসলমানদের কেবল পরকালের মুক্তির পথ দেখায় না, নৈতিক চরিত্র গঠনেও এর দারুণ ভূমিকা রয়েছে।’
রোজা ভালো মনের মানুষ গঠনে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের সুস্থ সুন্দর দেহ-মন ও স্বাস্থ্য নিয়ে অতি সহজ ও শান্তিময় জীবন গড়ার ব্যবস্থা হিসেবে মহান আল্লাহতায়ালা রোজা ফরজ করেছেন। তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা খোদাভীরু হতে পারো।’ -সূরা বাকারা: ১৮৩
মূলত ভালো মনের ভালো মানের মানুষ গঠনে খোদাভীরুতার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন পবিত্র মাহে রজমানে পুরো মাসের রোজা রাখার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন। সবশেষ বলবো, আমাদের রামাদ্বানের দিনগুলো হোক প্রানবন্ত, কর্মময়, সূচারু ও প্রোডাক্টিভ। আর রাতগুলো হোক আল্লাহমুখী, তাহাজ্জুদ ও কুরআনময়।