আল-হামরায় ঢোকার সময় আমাদের দেখা হয়
বলে-কয়ে নয়, হুটহাট দেখা হওয়া বেশি মধুময়!
কাজল বরন দু’চোখ দেখেছি দুই কোটরের ঘরে
পুরনো দিনের কত না গল্প সেই চোখে খেলা করে!
জিজ্ঞাসা করি, তোমার জন্ম স্পেন দেশটায়?
উত্তর দিল, না, বরং আমি জন্মেছি গ্রানাডায়। [১]
বলো কী! গ্রানাডা! সে তো ঘুমিয়েছে সাতশ বছর ধরে
তোমার দু’চোখে জেগে সে উঠেছে আজ এতদিন পরে!
যেন উমাইয়া যুগ ফিরে এলো, উড়িয়ে পতাকা তারই
যুদ্ধের মাঠে ছুটছে তাদের তেজী অশ্বের সারি।
ইতিহাস কত অদ্ভূত দেখো! আজকে আমাকে ঘিরে
তামাটে বরন আরব-দুহিতা হয়ে সে এসেছে ফিরে।
যেন দামেশক তার মায়াভরা চেহারায় আজও ফোটে [২]
বালকিস-এর চোখ, সুআদের গ্রীবা যেন ভেসে ওঠে। [৩]
আমাদের পোড়ো বাড়ি আর ঘর উঠছে স্মৃতিতে ভেসে
যেন মা চাদর টেনে দিচ্ছেন আমার নিকটে এসে।
যেন ইয়াসমিন ফুল ফোটে আছে, তারাদের করে ম্লান
যেন স্বর্ণালী জলাশয় ধারে বুনো হাস করে গান।
‘দামেশক নিয়ে কথা কেন? তুমি নিজেই বা কোথা থাকো?’
‘তোমার দিঘল চুলের নদেই দামেশক ধরে রাখো।
দামেশক দেখি তোমার আরবি চেহারায় কথা বলে
দামেশকে যত সূর্য দেখেছি, তোমার মুখে তা জ্বলে।
জেনেরেলিফের ঘ্রাণ, কুলুকুলু রব ও লেবুর গাছে,
নানান রঙের সুগন্ধি ফুলে আজও দামেশক আছে। [৪]
হাঁটছে আমার সাথে, তার চুল উড়ে আর উঠে ফুলে
ফসল-না-কাটা মাঠে শিষগুলো উঠছে যেভাবে দুলে।
কানের লম্বা দুলটি গ্রীবায় চকচক করে কত
ক্রিস্টমাস ইভে দীপ্তি ছড়ানো মোমের বাতির মতো।
হাঁটছি যখন সুবোধ শিশুর মতো আমি তাঁর পাশে
আমার সামনে ইতিহাস যেন টিলার মতন ভাসে।
কী যেন বলছে কারুকাজগুলো, শুনছি তা থেকে থেকে
প্রাসাদের ছাদে নকশাও যেন আমাকে যাচ্ছে ডেকে।
‘আল-হামরা তো আমার পূর্বপুরুষের গৌরব
দেয়ালে দেয়ালে সে কীর্তিগাঁথা লেখা আছে, পড়ো সব!’
কী! তার পূর্বপুরুষ! একটা ধাক্কা খেলাম যেন
কলিজায় পড়ে আরেক আঘাত, খুন ঝরে তাতে হেন।
আহা, এ ঊষসী তাহলে আমারই বংশের কোনো নারী
তার ও আমার পূর্বপুরুষ এক, তা বুঝতে পারি।
গল্পের শেষে তার কাছ থেকে বিদায় নিই যখন
তারিক ইবনে যিয়াদ এলেন করতে আলিঙ্গন। [৫]
নোট:
[১] গ্রানাডা স্পেনে অবস্থিত: তথাপি নিজেকে স্প্যানিশ বলে পরিচয় না দিয়ে গ্রানাডিয়ান বলে পরিচয় দিতে তিনি গৌরব ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। হারানো ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর সযত্ন মমত্ববোধ, ইতিহাসসচেতনতা ও শেকড়ের প্রতি টান ফুটে উঠছে এই সূক্ষ্ম আলাপটিতে।
[২] দামেশক (দিমাশক – دمشق): তৎকালীন উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী। বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী। কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই। বিভিন্ন কবিতায় শহরটির স্মৃতিচারণা করেছেন খুবই করুণভাবে। এইসব স্মৃতিচারণায় নিজের গল্প বলার পাশাপাশি উমাইয়া ইতিহাসকে টেনে আনেন প্রায়ই।
[৩] বালকিস ও সুআদ: বালকিস ছিলেন কবির স্ত্রী। বাগদাদে এক বোমা হামলায় নিহত হন। তাঁর স্মরণে কবি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। এরমধ্যে ‘বালকিস’ শীর্ষক দীর্ঘকবিতাটি সমধিক আলোচিত। উপমহাদেশে ‘বালকিস’ নামটি ‘বিলকিস’ উচ্চারিত হয়। সুআদ একটি কাল্পনিক নারীচরিত্র। বিখ্যাত সাহাবি কবি কাব বিন যুহাইর-এর ‘বানাত সুআদ’ শীর্ষক কবিতা – যা নবিজি সা. কর্তৃক আদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছিল – এই নারীচরিত্রটিকে ঘিরে সূচিত হয়েছিল।
মুসলিম স্পেনের ইতিহাস ও গ্রানাডার গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো কবিকে তাঁর প্রিয়তমা বালকিস-এর স্মৃতির মতোই বেদনাকাতর করে দেয়। এই ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাঁর কাছে এত বেশী মোহময় ও কমনীয় যে, প্রাচীন আরবের সবচেয়ে আলোচিত কাব্যিক নারীচরিত্রটির রূপ-লাবণ্যের মতোই তাঁর কল্পচোখে এসে ধরা দেয়। বক্ষ্যমান কবিতায় কবি নিজস্ব ভাবকল্পনায় যে নারীমূর্তিটি তৈরি করেছেন, তার মাঝে বালকিস ও সুআদকে একইসাথে দেখতে চাওয়ার রহস্য বোধয় এখানেই নিহিত।
[৪] জেনেরেলিফ (জান্নাতুল আরীফ – جنات العريف): আল-হামরা প্রাসাদের কাছাকাছি আরেকটি ছোট প্রাসাদ। বাগান ও কৃত্রিম জলপ্রবাহে সুসজ্জিত। আন্দালুসিয়ার নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন। গ্রানাডার প্রশাসকগণ গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপনে ব্যবহার করতেন।
[৫] তারিক বিন যিয়াদ: স্পেনজয়ী মুসলিম সেনাপতি। কবি আল-হামরার তোরণে দাঁড়িয়ে কল্পডানায় চড়ে রোমান্টিকতা ও স্মৃতিকাতরতার নদী পেরিয়ে পৌঁছে যান সাতশ বছরের পুরনো কোনো বন্দরে, কান পেতে শুনতে চান তারিক বিন যিয়াদের সমরজয়ী সৈন্যদলের অশ্বখুরের ধ্বনি।