হুবাব ইবনে মুনযির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নামের এক সহাবী ছিলেন। তাঁর জীবনী সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তিনি আবু বকর, উমর, বিলালের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মতো এতোটা বিখ্যাত ছিলেন না। তাঁর জীবনে যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা পাওয়া যায়, সেটা বদরের দিনের ঘটনাটি।
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই জায়গাটি কি আপনি আল্লাহর নির্দেশে বাছাই করেছেন; যার থেকে আমরা এক চুলও এদিক-সেদিক সরতে পারবো না? নাকি এই জায়গাটি আপনি নিজের রণ-কৌশল হিশেবে নির্বাচন করেছেন?”
প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হুবাব ইবনে মুনযির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাজের ‘সোর্স’ জানতে চাইলেন। অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহীর নির্দেশানুসারে কি কাজটি করেছেন? নাকি একজন মানুষ হিশেবে নিজ থেকে করেছেন?
হুবাব ইবনে মুনযিরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন প্রশ্ন করার পেছনে কারণ ছিলো। তিনি এমনি-এমনি প্রশ্নটি করেননি। তিনি যা বলতে চাচ্ছেন, সেটার জন্য রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাজের সোর্স জেনে নেয়া আবশ্যক ছিলো। এটা যদি ওহীর নির্দেশ হয়ে থাকে, তাহলে ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’ নীতি ফলো করবেন। ওহীর নির্দেশ মানে হলো, আল্লাহ এমনটা করতে নির্দেশ করেছেন, এটার মধ্যেই কোনো হিকমত আছে। আর যদি ওহীর নির্দেশ না হয়, তাহলে তাঁর কিছু বলার আছে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন, “না, এটা আমার নিজস্ব রণকৌশল।” অর্থাৎ, আল্লাহ ঠিক ঐ জায়গায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করতে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেননি, তিনি শুধুমাত্র রণকৌশল হিশেবে জায়গাটি নির্বাচন করেন।
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! যুদ্ধ করার জন্য এই জায়গাটি উত্তম নয়। আপনি সবাইকে নিয়ে ঐ কূপের কাছে গিয়ে ছাউনি স্থাপন করুন, যা কুরাইশদের অতি নিকটে। এরপর আমরা সেই জায়গার আশেপাশে যে কূপ আছে, তা বন্ধ করে দেবো। সেখানে একটি হাওয তৈরি করে তাতে পানি ভরে রাখবো। পরে আমরা শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করবো। এতে করে আমরা পানি পান করতে পারবো, কিন্তু ওরা পানি পান করতে পারবে না।” [সীরাত ইবনে হিশাম: ২/৩০৯-৩১০]
হুবাব ইবনে মুনযির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যখন নিশ্চিত হলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জায়গা নির্ধারণটি ওহীর নির্দেশ নয়, তখন তিনি তাঁর বিকল্প প্রস্তাব রাখলেন। বিষয়টি যদি ওহীর নির্দেশ হতো, তাহলে তাঁর বিকল্প প্রস্তাব রাখার কোনো সুযোগ ছিলো না। ওহীর নির্দেশ হলে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাবে বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ ছিলো না। এতে করে সেটা কুফরি হতো। কিন্তু, বিষয়টি যেহেতু ওহীর নির্দেশ নয়, সেহেতু তিনি মতামত দিলেন।
অনেকটা অখ্যাত একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে দ্বিমত করে একটি প্রস্তাব দিলেন, কোনো সাহাবী তাঁকে ধিক্কার জানাননি, তাঁর স্পর্ধা নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি, তাঁর দিকে তেড়ে যাননি। অন্যদিকে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যাকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ রাসূল হিশেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন একজন সাহাবী! যার উপর আল্লাহ ওহী নাযিল করেন, তিনি কি একজন সাধারণ সাহাবীর প্রস্তাব গ্রহণ করবেন? একজন নেতা হিশেবে তিনি যদি তাঁর মত বদলান, বাকিরা তাঁর সম্পর্কে অন্য কিছু ভাববে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব চিন্তা করে কি ঐ সাহাবীর প্রস্তাব নাকচ করে দিবেন?
না, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ সাহাবীর প্রস্তাব নাকচ করে দেননি। তিনি বরং বদর যুদ্ধের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে একজন অখ্যাত সাহাবীর প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তাঁর প্রস্তাবানুসারে তিনি তাঁর বাহিনীকে ক্যাম্প করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনা থেকে হুবাব ইবনে মুনযিরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ক্রিটিকাল থিংকিংয়ের দিকটি ফুটে উঠে। তিনি প্রথমে উৎস যাচাই করেন, মানুষ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত করেন, তারপর একটি যুক্তিপূর্ণ বিকল্প প্রস্তাব দেন।
ক্রিটিকাল থিংকিংয়ের অন্যতম শর্ত হলো- প্রশ্ন করা। আপনি যদি কোনো কিছু গভীরভাবে চিন্তা করতে চান, তাহলে আপনাকে প্রশ্ন করা শিখতে হবে। প্রশ্ন করারও পদ্ধতি আছে, সেই পদ্ধতিও শিখতে হবে। প্রশ্ন দুই ধরণের হতে পারে।
-
একধরণের প্রশ্ন হলো, নিজের মনে জাগা। এটা হলো Internal Questioning.
-
আরেকধরণের প্রশ্ন হলো- অন্যকে জিজ্ঞেস করা। এটা হলো External Questioning.
“তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা না জানো।” [সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৭]
“অজ্ঞতার প্রতিষেধক হলো জিজ্ঞেস করা।” [সুনানে আবু দাউদ: ৩৩৬]
কোনো বিষয় যদি আপনার জানা না থাকে, তাহলে প্রশ্ন করে জেনে নিতে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। আবার, কোনো বিষয় সম্পর্কে আপনার মনে সন্দেহ জাগলে, সেটার সোর্সও জেনে নিতে পারেন। কোনো বিষয়ের সোর্স সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চাইলেও প্রশ্ন করতে পারেন, যেমনটা হুবাব ইবনে মুনযির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) করেছেন।
ওহীর জ্ঞান ছাড়া (অর্থাৎ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত জ্ঞান) যেকোনো প্রকার জ্ঞান, যেকোনো ব্যক্তির জ্ঞানকে প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের আছে। তবে, অবশ্যই সেটা প্রশ্ন করার পদ্ধতি মেনে। একজন ব্যক্তি যতো বড়ো জ্ঞানী হোন না কেনো, তাঁর জ্ঞান প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। তাঁর সমস্ত কিছুই যে গ্রহণযোগ্য, এমন নয়। তাঁকে যেমন গ্রহণ করা হবে, তেমনি তাঁর কোনো মত বর্জন করাও হবে।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশে বসে বলেন:
“প্রত্যেকের কথা হয় গ্রহণ করা হবে, নতুবা বর্জন করা হবে; শুধুমাত্র কবরে যিনি শায়িত তাঁর কথা ব্যতীত।” [সিয়ারু আলাম আন-নুবালা, ইমাম আয-যাহাবী]
“Take knowledge wherever you find it and do not uncritically accept the opinion jurists have of one another. Indeed, they differ with each other like goats in a pen.” [Jāmi’ Bayān al-‘Ilm: 1308]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসও (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রায় একই কথা জানাচ্ছেন- যেখান থেকে চাও, জ্ঞানার্জন করো, কিন্তু সেটা যেনো ক্রিটিকালি গ্রহণ করা হয়। একজন বললো আর মেনে নিবে, এমনটা যেনো না হয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার একজন প্রিয় ছাত্র। এই দুজনের উদাহরণ সক্রেটিস আর প্লেটোর মতো। প্লেটো যেমন সক্রেটিসের জ্ঞান সংকলন করেছিলেন, আহমদ ছফা যেমন প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের জ্ঞান সংকলন করেছিলেন, ইবনুল কাইয়্যিমও (রাহিমাহুল্লাহ) তেমনি ইবনে তাইমিয়্যার (রাহিমাহুল্লাহ) জ্ঞান সংকলন করেছিলেন।
সেই ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
“ইবনে তাইমিয়্যা আমাদের কাছে অনেক প্রিয়। কিন্তু, ‘সত্য’ আমাদের কাছে তারচেয়েও প্রিয়।”
এই কথার মানে এই না যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাকে (রাহিমাহুল্লাহ) নাকচ করে দেয়া। বরং, এই কথার মানে হলো ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাকে (রাহিমাহুল্লাহ) ক্রিটিকালি গ্রহণ করা। একটা কথা ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রাহিমাহুলাহ) বলেছেন মানেই ‘গ্রহণযোগ্য’, এমনটা না। ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে বেশ কিছু বই পাওয়া যায়। এই বইগুলো পড়া যেতে পারে।
আপনার চিন্তা করার ডায়মেনশন বদলাবে, আরো মজবুত হবে। চিন্তা করতে পারাটা কতোটা আনন্দের, সেটা যদি আপনি একবার বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক অন্য কাউকে ‘বন্ধক’ দিতে পারবেন না। আপনাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলেও আপনি আনন্দিত হবেন, কিন্তু নিজের মস্তক অন্যকে বন্ধক দিয়ে বন্দিত্ব বরণ করে নিতে মন সায় দিবেন না।
মজার ব্যাপার হলো, কুরআনে আল্লাহ অনেক জায়গায় মানুষকে চিন্তা করতে বলেছেন। আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে- আমি কি চিন্তা করতে পারি? নাকি আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে?