মালয়েশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনে দল হিসেবে এককভাবে সর্বোচ্চ ৪৯টি আসন অর্জন করেছে দেশটির মূলধারার ইসলামী আন্দোলন ‘Pan-Malaysian Islamic Party’ তথা ‘PAS’। যার মাধ্যমে দীর্ঘ তিন দশক পর মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহিম, এদুটো সুতোর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে নীরব এক পুনরুত্থানের গল্প রচনা করেছে দলটি। বর্তমানে দলটি মালয়শিয়ার ১৩ রাজ্যের মধ্যে ৪টি রাজ্যই শাসন করছে। প্রাদেশিক রাজনীতিতে সাফল্য সেই ৯০ সাল থেকেই, তবে জাতীয় রাজনীতিতে যে দলটির তেমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, বিগত ৩টি নির্বাচনে ১০% এর বেশি ভোট যে দল আদায় করতে পারেনি, যাদের আসন সংখ্যা ছিল কেবল ১৮ থেকে ২৩ এর মধ্যেই সেই দলটি আজ মালয়শিয়ার রাজনীতিতে দল হিসেবে এককভাবে সর্বোচ্চ অর্ধশত আসন লাভ করেছে।
ক্ষমতার পালাবদলের গল্প, রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গনের রাজনীতি, ঘৃণ্য অপবাদের জঘন্য রাজনীতি- কী নেই মালয়শিয়ার রাজনীতিতে? তারপরও পরিচ্ছন্ন এবং ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমেও যে জনগণের ভালবাসা আদায় করা যায় তার উদাহরণ হচ্ছে মূল ধারার ইসলামপন্থী দল ‘PAS’। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আন্দোলন মালয়শিয়ার রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে ১৯৭৪ সালে। আদর্শিকভাবে মালয়শিয়ার মূলধারার ইসলামী আন্দোলন পাস, উপমহাদেশের জামায়াতে ইসলামী, তুরস্কের মিল্লি গুরুশ আন্দোলন এবং আরব বিশ্বের ইখওয়ান একে অপরের প্রতিচ্ছবি।
৭০ এর দশকে উপরোক্ত আন্দোলনসমূহের মতোই ভিন্ন এক মাত্রা যোগ হয় দেশটির মূলধারার ইসলামপন্থী এই দলটিতে। দেশটির রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে দলটি। বহির্বিশ্বে ডিগ্রীধারী আলেমদের হাতে নেতৃত্ব উঠে আসে যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলে নিক আব্দুল আজীজ এবং বর্তমান দলটির প্রেসিডেন্ট আব্দুল হাদি আওয়াং। ৮০ এর দশকে জোট গঠন এবং জোট ভাঙ্গনের রাজনীতির মাশুল দিতে হয় ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির মাধ্যমে।
ক্ষমতার আসনে ইসলামী আন্দোলনস PAS:
ইসলামী আদর্শ এবং ইসলামী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা এই দলটি তার আদর্শের সাথে নূন্যতম আপোষ না করে ১৯৯০ এর নির্বাচনের জনগণের গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নেয় কেলেন্তান প্রদেশে ৪৬টি আসন অর্জনের মাধ্যমে। প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নিক আব্দুল আজীজ এবং পরবর্তী ৪টি নির্বাচনে (১৯৯৫, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৮) তিনি বারংবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।
(ছবি- নিক আব্দুল আজীজ)
২০১৩ সালে পুনরায় পাস কেলেন্তান প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ঠিক সেসময়ই নিক আব্দুল আজীজ রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার অবসরের পর প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী হন নিক আব্দুল আজীজের সাবেক উপ-মুখ্যমন্ত্রী আহমেদ ইয়াকুব।
জাতীয় রাজনীতিতে PAS:
সাম্প্রতিক নির্বাচনে মূলধারার ইসলামপন্থী এই দলের অভূতপূর্ব এই সাফল্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমকে চাপে রেখেছে। আদর্শগতভাবে আমেরিকার প্রতি সহানুভাবাপন্ন, লিবারেল ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত আনোয়ার ইব্রাহীমের সাথে মূলধারার কট্টর ইসলামপন্থী দল পাসের আদর্শিক দ্বন্দ্ব সকলেরই জানা। গত নির্বাচনে পাসকে নিজের জোটে টানার জন্য মাহাথির মোহাম্মদ দলটির প্রধান আব্দুল হাদী আওয়াং এর সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন। যদিও পরবর্তীতে পাস মাহাথিরের প্রতি নিজেদের সমর্থন তুলে নেয়।
(মাহাথির মোহাম্মদ ও আব্দুল হাদী আওয়াং এর বৈঠকের ছবি)
মূলত ১৯৯৫ সাল থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থানে পাস। ৯৫ এর নির্বাচনে কেলেন্তান প্রদেশের ৭টি সংসদীয় আসনের সবগুলোতেই পাস জয়লাভ করে এবং কেলেন্তান প্রদেশ থেকে বিরোধীদলসমূহ একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পাসের জনপ্রিয়তার কাছে। পরবর্তী ৯৯ এর নির্বাচনে পাস ২৭টি আসন লাভ করে যা সাম্প্রতিক নির্বাচন পূর্ব পর্যন্ত ছিল পাসের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। একই সাথে ৯৯ এর নির্বাচনে কেলেন্তান এবং তেরেঙ্গানু প্রদেশে ঐতিহাসিক জয় লাভ করে পাস। ৯৮ সালে মাহাথির এবং আনোয়ারের দ্বন্দ্ব যখন চরমে তখন সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফায়দা নিজেদের ঘরে তুলে পাস। একই সাথে সরকার কর্তৃক মূল ধারার প্রিন্ট মিডিয়াতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ভালই বিপাকে পড়ে পাস। তখন পাস তাদের রাজনৈতিক কৌশল পালটে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে ইন্টারনেটকে নিজেদের প্রসারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নেয় এবং এর ফলও আদায় করে নেয় খুব শীঘ্রই। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেটে পাস অন্য দলগুলোর তুলনায় খুবই সক্রিয়।
পাসের ভাঙ্গন ও এরদোয়ানপন্থীদের উত্থান:
৯/১১ এর পর রাজনৈতিকভাবে পাস অনেক বাধার সম্মুখীন হয় মূলধারার ইসলামপন্থী দল হিসেবে। তখন বিশ্বব্যাপী লিবারেল ইসলামপন্থীদের উত্থানে পাসও অভ্যন্তরীনভাবে এই আদর্শিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়। তুরস্কের মূলধারার ইসলামী আন্দোলন থেকে বের হয়ে লিবারেল ইসলামপন্থী হওয়া রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ানের লিবারেল আদর্শ পাসকেও আঘাত হানে। পাসের অভ্যন্তরে “এরদোয়ানপন্থী” হিসেবে খ্যাত নেতারা দলের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ২০০৫ সালে দলটির কেন্দ্রীয় অধিবেশনে এরদোয়ান পন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়, তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্দুল হাদী আওয়াং নির্বাচিত হন। এতে দলটির নীতিতেও কট্টর ইসলামপন্থী নীতির পরিবর্তে অনেক মডারেট নীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ৯/১১ এর প্রভাবও এর একটি কারণ ছিল। পরবর্তীতে এরদোয়ানপন্থীরা দুর্বল হয়ে পড়লে দলটি পুনরায় মূলধারার ইসলামপন্থী নীতিতে ফিরে আসে।
২০০৯ সালে এরদোয়ানপন্থীদের সমর্থনে দলটির কেন্দ্রীয় অধিবেশনে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ সাবু। মোহাম্মদ সাবুর এই জয় পাসের উলামা ধারা তথা মূল ধারার জন্য বড় ধরনের আঘাত ছিল মাত্র ৪ বছরের মাথায়। পরবর্তী ২০১৩ সালের নির্বাচনে তেমন সাফল্য পায়নি দলটি এবং দলটির দায়িত্ব পুনরায় আসে উলামা ধারার উপর। ২০১৫ সালের অভ্যন্তরীন নির্বাচনে এরদোয়ানপন্থী ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাবু এবং এরদোয়ানপন্থীরা সমূলে পরাজিত হয় কেন্দ্রীয় সম্মেলনের নির্বাচনে। পরাজিত এরদোয়ানপন্থীরা পাস থেকে বের হয়ে পরবর্তীতে গঠন করে লিবারেল আমানাহ পার্টি।
২০০৮ এর নির্বাচনে পাস ১৮ টি আসন লাভ করে এবং ২০১৩ সালে নির্বাচনে তেমন ভাল ফল অর্জন করতে না পারলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় ১৮ টি সংসদীয় আসন লাভ করে। এরপর মালয়শিয়ার রাজনীতিতে জোট গঠন ও ভাঙনের রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠে। আর পাস এতে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল খাটিয়ে ২০২০ এর সরকার গঠনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে উঠে আসে এবং দেশটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দলটিকে দেয়া হয়।
১৫ তম জাতীয় নির্বাচন ও পাসের সাফল্য:
গত নভেম্বরের নির্বাচনে মূলধারার ইসলামপন্থী দলের দল হিসেবে সর্বোচ্চ আসন লাভ করা সকলের নজর কেড়েছে। পাস জাতীয় রাজনীতিতে কী ধরণের প্রভাব ফেলেছে ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে তার উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট পাসের প্রভাব বুঝার জন্য-
- মালয়শিয়ার সবচেয়ে লিবারেল প্রদেশ পেনাঙ, দেশটির একমাত্র চায়নিজ মুখ্যমন্ত্রী যে প্রদেশের, সেই প্রদেশে মূলধারার ইসলামপন্থী দলটি ২ টি সংসদীয় আসন লাভ করেছে।
- ১৯৮৬ সাল থেকে পেরমাতাং পাউহ সংসদীয় আসন, যেটি ছিল আনোয়ার ইব্রাহীমের পরিবারের দখলে, সেই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছেন আনোয়ার ইব্রাহীমের কন্যা। ৮৬ সাল থেকে একাধারে এই আসনে জয়লাভ করে আসছেন আনোয়ার ইব্রাহীম নিজে, পরবর্তীতে তার স্ত্রী এবং সবশেষ তার কন্যা। আনোয়ার পরিবারের ঘাটি হিসেবে বিবেচিত এই সংসদীয় আসনে আনোয়ার পরিবারকে হারিয়ে আসনটিতে জয়লাভ করেছে পাস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুবকদের বড় একটি অংশ প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করছে মূলধারার ইসলামপন্থী এই দলটিকে। দেশটির যুবকেরা ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং এতে করে তাদের কাঙ্খিত দল হিসেবে পাস প্রাধান্য পাচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটির ৬০% ভোটারই হচ্ছে মালয় জাতির। তারপরও ২০ এবং ৩০ বছর বয়সীদের অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ তা যে ধর্মেরই হোক না কেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী ভোটাররা সেই দলকেই প্রাধান্য দিয়েছে যে দল তাদের চাহিদাকে প্রাধান্য দিবে এবং যাদের ইশতেহার যুবসমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে।
বিশ্লেষকেরা দাবী করছেন- মূলধারার ইসলামপন্থী দল পাস বরাবরের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম যেখানে পাস বিরোধী সেখানে দলটি দেশটির দেড় কোটি টিকটক ব্যবহারকারী, দুই কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং ৪৫ লাখের মতো টুইটার ব্যবহারকারীদেরকেই নিজেদের প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। মূল ধারার ইসলামপন্থী দল হয়েও প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সর্বোচ্চ ব্যবহার বিশেষ করে টিকটকে নিজেদের ক্যাম্পেইন প্রচারনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে যুবসমাজের উপর, যা তাদেরকে এই নির্বাচনে যে কোন দল হিসেবে সর্বোচ্চ ৪৯ টি আসন লাভের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা করেছে।
আনোয়ার ইব্রাহীম জোট গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেও বিশ্লেষকেরা এই জোটকে ক্ষণস্থায়ী ভাবছেন। পাসও সর্বোচ্চ আসন নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় সরকার গঠনের। একবিংশ শতকে মূল ধারার ইসলামন্থীরা ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি পশ্চিমা বিরোধী হওয়ার কারণে। উলামাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মূলধারার একটি ইসলামী দল কীভাবে ও কোন উপায়ে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে? বিরোধীদল হিসেবে হোক কিংবা সরকার গঠন করেও হোক, সেটিই দেখার অপেক্ষায় সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মালয়েশিয়া।