মানুষে-মানুষে যুদ্ধ আর মানবজাতির সৃষ্ট তান্ডবের ইতিহাসকে সামনে রেখে বুঝানো হচ্ছে যে, দিনশেষে মানুষ পশুপ্রকৃতির শয়তান। নীৎসে, ফ্রয়েডের হতাশ অনুসারীরা মানবজাতির জন্তু প্রকৃতির চরিত্র নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। আবার এ কথার বিপরীতে মানবতাবাদীরা মানুষের যোগ্যতা ও ক্ষমতায় সম্পূর্ণ আস্থা রেখে মানুষকে ফেরেশতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এ দুই মতবাদে কিছু সত্য থাকলেও মানুষ ‘ফেরেশতা না শয়তান’ প্রকৃতির সত্যিকার যথাযথ সামগ্রিক অবস্থান নিয়ে উপরের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ব্যর্থ।
মানুষ প্রজাতি এমন এক সত্বা, যাকে “ফেরেশতা এবং শয়তান” এ দুই চরিত্রের মাঝ বরাবর অবস্থানে রাখা যায়। মানুষের সামনে অপশন আছে, হয় ফেরেশতা নতুবা শয়তান হওয়ার। এর যেকোনো একটিতে পরিণত হওয়াতে মানুষের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। পছন্দ করার ক্ষমতাই আল্লাহর অন্যন্য সৃষ্টির তুলনায় মানুষকে বিশেষ সৃষ্টি হওয়ার যোগ্যতা দিয়েছে। মানুষের ভালো অথবা খারাপ পছন্দ করার যোগ্যতা আছে। তবে অন্যান্য সৃষ্টি যেমন- ফেরেশতা, উদ্ভিদ,প্রাণীদের এ যোগ্যতা নেই।
নিষ্ঠুরতা এবং দয়া দুটোই একটা আরেকটির বিপরীত। সেখানে নিষ্ঠুরতা বাছাই না করে মানুষ দয়াকে পছন্দ করতে পারে। মানুষ এক দিকে যুক্তিহীন বোকা ও সর্বনাশী হতে পারে, তবে সে এ পথে না গিয়ে সে মার্জিত বুদ্ধিমানের পরিচয়ও দিতে পারে। বুদ্ধি দ্বারা ভালো পথকে গ্রহণ করাই তার নিকট বেশি প্রত্যাশিত। মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক গুণকে কাজে লাগিয়ে মহৎ চিন্তার জন্ম দিতে পারে। আবার সেই মানুষই অলস আর ষ্টুপিডও হতে পারে। যার মানে হলো, এ আলস্যকে অবলম্বন করে নিজেকে দেহবাদী সত্ত্বার চেয়ে উর্ধ্বে আরও উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যেতে চায় না।
এ মেধাবী মানুষই অন্যের প্রতি হতে পারে উদার আবার সে হতে পারে চিন্তাশুন্য এক উদোম। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ‘হান্নাহ আরেন্ডিট’ চিন্তাশুন্য এ উদোম মানুষকে নাম দিয়েছেন ” স্টুপিড নয় তবে চিন্তাশুন্য ভ্যাবলা”। এ চরিত্রই তাকে নিয়ে যাবে তাচ্ছিল্যের অধিকারী শয়তানির দিকে।ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রথা মানুষের দ্বৈত চরিত্রের উপর জোর দিয়েছে। এক অর্থে মানুষ দুনিয়া আল্লাহ খলিফা (প্রতিনিধি)। মানুষের দায়িত্ব হলো, সে আল্লাহর একত্বের সাক্ষী দিবে আর দুনিয়ায় ইনসাফ কায়েম করবে। রুহানিয়াত জগতে মানুষ এমন এক সত্ত্বা যার সামনে ফেরেশতারা নত হয়েছে, মানুষের স্বর্গীয় চরিত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ যোগ্যতার গুনে আল্লাহ মানুষের সাথে ‘নবী ও ওহীর’ মাধ্যমে কথা বলেছেন। এ মানুষই এমন সৃষ্টি যাকে আল্লাহ সুরক্ষা দেন এবং ভালোবাসেন।
অন্যদিকে মানুষের আছে লোভ আর নির্বোধের মত ধ্বংসাত্মক চরিত্র। এ চরিত্র ধারণ করে সে স্রষ্টার অন্যান্য সৃষ্টিকে সহ নিজেকে শেষ করে দিতে পারে। এখন আসল রহস্য হলো, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। এটি রহস্যপূর্ণ ধাঁধা, যা চিন্তায় ফেলার মত। এ ইচ্ছাশক্তিতে মানুষ ভালো কিংবা মন্দ, দুইটার একটা পছন্দ করতে পারে। সজ্ঞান অবস্থায় মানুষের এ শক্তি সবসময় কাজ করে। এ ক্ষমতাই পৃথিবীর অন্যন্য সৃষ্টি থেকে মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে। বিবেক-বুদ্ধিমত্তা ও স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিই মানুষকে দানশীলতা, নৈতিক গুণে গুণান্বিত করে অথবা অনৈতিকতা ও কামনার বশবর্তী করে। এর সম্পূর্ণ মানে দাঁড়ায়, মানুষ শয়তানও নয় আবার ফেরেশতাও নয়— এ দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ স্পেশাল মাখলুক।
মানুষ ফেরেশতা হলে বুদ্ধি ও স্বাধীন ইচ্ছা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারত না। কিন্তু মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভালো এবং সত্যকে যাচাই করার। দায়িত্বের জন্য মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সত্য ও সুন্দর খোঁজা’ই মানুষের লক্ষ্য। আর লক্ষ্যই তাকে মহান মনুষ্য জাতি হওয়ার ক্রেডিট দিয়েছে। তাই ফেরেশতারা মানুষের এ ক্ষমতার ( মানুষ আল্লাহর খলিফা,স্পেশাল সৃষ্টি) সামনে নত হয়েছিল। আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির গুণে গুণান্বিত। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি দয়া দেখিয়ে এ গুণ কেন মানুষকে উপহার দিলেন?
ক্লাসিকাল এক পন্ডিত বলেন, আল্লাহ এতই রহমতের অধিকারী যিনি কিনা মানুষ নামক এক সৃষ্টি তৈরি করেছেন, যার সক্ষমতা আছে আল্লাহর কথার বাহিরে যাওয়ার। আল্লাহ সুন্দর পৃথিবী, প্রকৃতি, চমৎকার সব উদ্ভিদ-প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এইসব সৃষ্টির সবটাই অসাধারণ। তবে তিনি মানুষ বানিয়ে দেখতে চাইলেন মানুষ ভালো ও সৌন্দর্য সুকমায় কিভাবে পরিপূর্ণতায় নিজেকে বিকশিত করে , ঐসব অসাধারণ সৃষ্টির মত।
দশম শতাব্দীর আলেম আবুল হাসান আল আমিরী “কিতাব আল আমান আলাল আবদ” গ্রন্থে মানুষের অস্তিত্বের চারটি পর্যায়ে উল্লেখ করেন।
- ফেরেশতা,
- মানবসুলভ,
- প্রাণীসুলভ,
- পশুসুলভ
একেক পরিস্থিতিতে একেক অবস্থা বিরাজ করে। এখন কোনটা পছন্দ করবে সেটা মানুষের মেন্টালিটির উপর নির্ভর করে। আমিরী বলেন, মানুষ ফেরেশতা নয়, তবে চেষ্টা করে করে সে ফেরেশতার মত হতে পারে। এক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টার গুণটাই মানুষকে স্পেশাল মাখলুক বানিয়েছে। ভালো ভালো কাজ, চমৎকার সব গুণাবলি, উদারতা, শারীরিক আর আত্মিক পরিশুদ্ধির মর্যাদাপূর্ণ পথ দিয়ে মানুষ ফেরেশতার পর্যায়ে উপনীত হওয়ার আকাঙ্খা করতে পারে। এ আকাঙ্খাই মানুষকে আল্লাহর খুব নিকটে নিয়ে যায়। আবার মানুষ পশুও নয়, জন্তুও না। তবে তার সক্ষমতা আছে হীন পশুর চেয়েও অধম হওয়ার। পশুর বিবেক বুদ্ধি নেই যে সে মানুষের সমান হবে। পশুর কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই। সে শারীরিক কামনা আর প্রয়োজনের বশবর্তী হয়ে জীবনধারণ করে। তবে মানুষ নিজের বিবেক বুদ্ধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পশুর মত কামনা-বাসনায় উত্তেজিত হয়ে পশুর চেয়েও আরো মারাত্মক হতে পারে।
যেহেতু একমাত্র মানুষই ভালো-মন্দ যাচাই বাচাই করতে পারে তাই সে পুরষ্কার বা শাস্তি পাওয়ার একমাত্র হকদার। পুরস্কার আর শাস্তি শেষ কথা নয়। মানুষ যেহেতু আল্লাহর প্রতিনিধি, আর এ উচ্চতর মহান উদ্দেশ্যের জন্য অন্য মানুষকে অনুপ্রেরণাদাতা, পথনির্দেশ দাতা সে নিজেই। নীৎসে, ফ্রয়েড মানুষ্য চরিত্রের অন্ধকার প্রকৃতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ধ্বংসলীলা আর রক্তপাতের দিকটাই বেশি আলোকপাত করেছেন। কিন্তু তারা ভুলে মানুষের জন্তু ও জঘন্য প্রকৃতির চিত্রকে বেশি গাঢ় করে ফেলেছেন। সত্যিকার মানুষ জন্তুও নয় আবার ফেরেশতাও নয়। মানুষ নৈতিকগুণে বলিয়ান হয়ে ভালো ভালো কাজ করার সামর্থ্য রয়েছে। এর জন্য চাই মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির যথাযথ ব্যবহার। আজকের যুগেও মানুষের মধ্যে অনেক ভালো মানুষি রয়ে গেছে। এ ভালো মানুষি দিয়ে মানবতাকে পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে এবং যাবে।
[ডেইলি সাবাহ থেকে অনূদিত]