মানুষের অনেক রকমের ট্যালেন্ট আছে। যার মধ্যে মুখস্থবিদ্যা অন্যতম। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে পড়াশোনা করে মুখস্থ করার পর তা ভুলে যাওয়াই সাধারণ ব্যাপার। তখন খাতায় লিখতে হলে কিছুটা হুবহু এবং কিছুটা নিজের মতো করে লিখে তার লেখা শেষ করে।
মানুষ যতটা না মরণশীল তার চেয়ে বেশি বিস্মরণশীল। চর্চার অভাবে কিংবা অন্য কোন কিছুতে ব্যস্ত থাকার কারণে মানুষ অনেক বিষয় ভুলে যায়। মনে করতে চাইলেও তখন তা আর মাথায় পুরোপুরি আসে না।
আল্লাহ আদম ও হাওয়া আলাইহিসসালামকে দুনিয়ায় প্রেরণ করলেন। তারা সংসার করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে বড়সড় একটা পরিবার হয়ে গেল। সেই পরিবার ছড়িয়ে পড়তে লাগলো পৃথিবীর বুকে। আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন পরীক্ষার জন্য। কিন্তু অভিশপ্ত শয়তানের প্রচারণায় পড়ে মানুষ তা ভুলে যায়। সেই মানুষগুলোকে আল্লাহর দ্বীনের কথা মনে করিয়ে দিতে কিংবা সত্যের পথে পরিচালনার দিক দেখিয়ে দিতে যুগে যুগে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন বহু নবী-রাসুল। যাদের কাজ ছিল আল্লাহর দ্বীনকে মানুষের সামনে পুনরুজ্জীবিত করা বা আবারও তাদেরকে একত্ববাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া।
নবীগণের মধ্যে ইব্রাহীম আলাইহিসসালাম হলেন আল্লাহর অন্যতম একজন প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় পরীক্ষা নিয়েছেন এবং সবকটায় তিনি পাশ করেছেন। তিনি হলেন খালিলুল্লাহ!
ইব্রাহীম আলাইহিসসালামের ঘরে কোন সন্তান ছিল না। আল্লাহ তার স্ত্রী হাজেরা আলাইহিসসালামের গর্ভে একটি সন্তান দান করলেন যিনি হলেন ইসমাঈল আলাইহিসসালাম। কিন্তু সন্তানের সাথে বেশিদিন না কাটাতেই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল রেখে তাদেরকে মক্কা উপত্যকায় রেখে চলে আসেন। হাজেরা আলাইহিসসালাম ও ইসমাঈল আলাইহিসসালাম সেখানেই তাদের জীবন কাটাতে থাকেন। এদিকে ইয়েমেন থেকে আগত একটি গোত্র তাদের পারমিশন নিয়ে মক্কায় থাকা শুরু করে। তারা সবাই একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতেন।
কিছুকাল পরে ইব্রাহীম আলাইহিসসালাম মক্কায় আসেন এবং প্রিয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিসসালামকে সাথে নিয়ে আল্লাহর নির্দেশে ক্বাবা ঘর তৈরি করেন। তারপর তারা দু’আ করেন ‘হে আমাদের রাব্ব! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করুন, এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য হতেও আপনার অনুগত এক দল লোক সৃষ্টি করুন, আর আমাদেরকে হাজ্জের আহকাম বলে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, করুণাময়।’ [সূরাহ বাকারা-১২৮]
একত্ববাদ ছড়িয়ে পড়লো সব জায়গায়। মানুষজন এক আল্লাহর ইবাদতেই মগ্ন রইলো বহুকাল।
মক্কায় তথা আরব অঞ্চলে একত্ববাদ ছেয়ে গেল, সবাই আল্লাহর ইবাদত করতো। তারা হজ্জ্বের মৌসুমে হজ্জ্ব করতে আসতো এবং ইব্রাহীমের ধর্মের নিয়মকানুন সব পালন করতো। কালের আবর্তনে তারা ভুলে যেতে থাকে এসব। ইব্রাহীমের দ্বীনের অনেক অনেক বৈশিষ্ট্য ভুলে থাকলেও কিছু সংখ্যক বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে রয়ে যায়।
আরবরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতো। এটাই ছিল তাদের আয়-রোজগারের একমাত্র পথ৷ মক্কার পাওয়ার তখন বনু খুযায়া গোত্রের কাছে। তাদের দ্বারাই পরিচালিত হতে থাকে সবকিছু। সেই গোত্রের সর্দার ছিলেন ‘আমর বিন লুহাই’ নামক এক ব্যক্তি। তিনি শুধু একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না বরং বড় একজন মানুষ ছিলেন। যার কারণে সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। তারও পেশা ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য। এ জন্য ছুটে যেতে হত রোমান রাজ্যে কিংবা পারস্য রাজ্যে।
একবার প্রয়োজনে তিনি শাম অঞ্চলে যান। সেখানে তিনি একটি মূর্তির দিকে বিস্ময়কর হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কেন জানি মূর্তিটি তার ভেতরে এক অনুভূতি নেড়ে দিলো। চিন্তা করলেন, একে তাহলে দেশে নিয়ে যাওয়া যায়। এখানেও তো অনেকে মূর্তিপূজা করছে, এ কারণে তারা এত্তো শক্তিশালী, তাদেরকে কেউ হারাতে পারে না। তিনি ভাবলেন তার অঞ্চলেও এভাবে মূর্তিপূজা করলে তাদেরও শক্তিসঞ্চয় হবে। সিদ্ধান্তে তিনি অটুট থাকলেন। এই মূর্তিকে তিনি নিয়েই ছাড়বেন। এটা ছিল বিশাল বড় এক মূর্তি যার নাম “হুবাল।”
হুবাল নামক মূর্তি নিয়ে তিনি ফিরে আসলেন মক্কায়। সেটা তিনি রাখলেন ক্বাবায়। তারপর মানুষদেরকে তা উপাসনা করার নির্দেশ দিলো। মানুষজন তার কথা মতন মূর্তির উপাসনা করতে শুরু করলো এবং সম্মান দিতে লাগলো। এভাবেই তারা ইবরাহীমের দ্বীনকে বিকৃত করে মূর্তিপূজা করা শুরু করলো তথা আল্লাহর সাথে শিরক করা শুরু করলো।
মক্কাবাসীর এসব কর্মকাণ্ড দেখার পর বাকী আরবের গোত্রসমূহ ভাবলো, তারা কেন আর পিছিয়ে থাকবে! তাদেরও উচিৎ মূর্তিপূজা করা। এভাবে একে একে সব৷ গোত্র মূর্তিপূজা করা শুরু করলো। একেক এলাকার গোত্রগুলো একেক মূর্তির পূজা করতো। এভাবে সমস্ত আরব হয়ে গেল শিরকের কারখানা বা মূর্তিপূজার গোড়াপত্তন। হুবাল মূর্তি ছাড়াও তাদের আরও ৩টি মূর্তি ছিল যেগুলোর নাম হলো ১)লাত ২)মানাত ৩)উযযা।
নূহ আলাইহিসসালামের কাওমের ৫জন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তারা আল্লাহর ইবাদত করে তাদের সময় কাটাতেন। মানুষজন তাদেরকে খুব বেশী ভালোবাসতো। সেই ৫ জন ব্যক্তির নাম হলোঃ
১)ওয়াদ্দ
২)সুওয়া
৩)ইয়াগূস
৪)ইয়া’উক্ব
৫)নাসার
এই ৫ ব্যক্তির মৃত্যুর পর কাওমের লোকেরা একটু দ্বীন থেকে সরে যেতে শুরু করে। শয়তান এই সুযোগ নিয়ে তাদের সামনে এসে বলে যে, তোমরা যদি তাদের মূর্তি বানিয়ে রাখতে তাহলে তাদেরকে দেখে তোমাদের ভেতরে ইবাদত করার জন্য প্রেরণা আসতো। এমন সুবুদ্ধি পেয়ে লোকেরা সেই ৫ ব্যক্তির মূর্তি বানায় তারপর সেগুলো রেখে দেয় একটা জায়গায়। যখনই তারা তাদেরকে দেখতো তাদের হৃদয়ে ইবাদতের অনুপ্রেরণা জাগতো। এসব দেখে আসছিলো তাদের ছোট ছেলে-মেয়েরা। তারা বড় হওয়ার পর বুঝে উঠে পারেনি আসল কাহিনী কী এবং তারা এগুলোর উপাসনা করা শুরু করে দেয়। এক কথায় মূর্তিপূজা শুরু করে দেয়। এটাই পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজার প্রচলন। কালের আবর্তনে এসব মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। মানুষজন এসব ভুলে যায়।
আমর বিন লুহাই যেসময় হুবাল মূর্তি নিয়ে আসে তখন শয়তান দেখলো, এখনই মোক্ষম সময়, এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সে লুহাইকে দিয়ে যেকোনোভাবে হোক সেই মূর্তির সন্ধান দিলো। লুহাই এসব মূর্তি খোঁজে বের করেন। তারপর এসবের উপাসনা করা শুরু করে মানুষেরা। এক সময় কয়েকটা গোত্র এই মূর্তিগুলো তারের গোত্রে নিয়ে যায় এবং উপাসনা করা শুরু করে। তারা ভাবলো যে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে হলো এসব মূর্তির উপাসনা প্রয়োজন। তারা এসব মূর্তিদেরকে আল্লাহত প্রতিনিধি মনে করা শুরু করে এবং উপাসনা চালিয়ে যায়।
মূর্তিপূজায় তারা থেমে থাকেনি। অনেকে পশুর পূজা করত, তারার পূজা করত, অনেকে গাছের পূজা, অনেকে চাঁদের পূজা আবার অনেকে সূর্যের পূজা করত। কোন কাজ করার আগে সেটা ভালো কী মন্দ হবে তার জন্য একটা প্রথা শুরু করলো যার নাম ত্বিয়ারাহ। আরও জঘন্য জঘন্য জিনিস তারা গ্রহণ করে নেয়। এসব সব শির্কের অন্তর্ভুক্ত।
মূর্তিপূজার প্রচলন হওয়ার পর দেখা গেল যে তারা সবকিছু মূর্তির উপর বেইজড করে সবকিছু করতো। আস্তে আস্তে তারা আল্লাহকে ভুলে গেল। তারা যখন বেশি বিপদে পড়তো তখন আল্লাহকে ডাকতো কিন্তু কেটে গেলেই আবার শিরকে নিমজ্জিত হতো। প্রথমে ক্বাবায় মূর্তি থাকলেও একটা সময়ে তারা মূর্তি বানিয়ে নিজেদের ঘরে রাখতো। তারা কোন কিছু কোরবানি করলে তা তাদের মূর্তির নামে উৎসর্গ করত। এক সময় তারা মূর্তি দিয়ে ক্বাবা ঘর ভরে ফেললো। এসবের উপাসনার মাধ্যমে তারা তাদের জীবন কাটাতো। যুগ যুগ ধরে তা এভাবেই চলছিল। আমর বিন লুহাই মূর্তি পূজার পদ্ধতি ও রীতিসমূহ মানুষদেরকে যা বলে গিয়েছে সব তার মনগড়া কথাবার্তা। কিন্তু মানুষজন এসব হুবহু পালন করত।
এভাবে আসল দ্বীন চর্চা না করার ফলে এবং একজন ক্ষমতাশীল ব্যক্তির প্রচরণায় পড়ে আরবরা ইব্রাহিমের (আলাইহিসসালাম) দ্বীন থেকে ছিটকে পড়ে। অবাক করা বিষয় হলো এসব মূর্তির উপাসনা ও দ্বীন বিকৃত করা সত্ত্বেও তারা মনে করত তারা ইব্রাহীমের (আলাইহিসসালাম) সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে। তবে পরবর্তীতে হাতে গুণা কিছু সংখ্যক মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন আল্লাহ এক এবং তার কোন শরীক নেই। তারা মূর্তিপূজাকে পরিত্যাগ করেছিলেন।
ইসলাম আসার পরে একবার আমর বিন লুহাইয়ের কথা রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আমর ইবন আমির খুয’আহকে তার বহির্গত নাড়ি – ভুঁড়ি নিয়ে জাহান্নামের আগুনে চলাফেরা করতে দেখেছি। সেই প্রথম ব্যক্তি যে সা-য়্যিবাহ উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলন করে।