‘অর্থনীতির জনক’ নামে খ্যাত এডাম স্মিথ বলেছিলেন, জমিতে ফসল চাষ করার একটা পর্যায়ে জমির উর্বরতা ক্ষয় হয়ে যায় তখন সেখানে আর ফসল ফলানো যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষমতার পালাবদল হয়নি এমন ইতিহাস নজিরবিহীন৷
ইয়েমেন থেকে জুরহুম গোত্র যখন মক্কায় আসে তখন হাজেরা আলাইহাসসালাম তাদেরকে থাকার অনুমতি দেন। মিলেমিশে তারা কাটিয়ে দেন অনেক কছর। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম তাদের মধ্যে বেড়ে উঠেন। এই গোত্রে তিনি বিয়েও করেন। জুরহুম গোত্র প্রায় ২০০০ বছর ধরে মক্কায় বসবাস করতে থাকে। এই অঞ্চল পুরোটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরই মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন ইসমাঈল আলাইহিসসালামের সন্তানাদিরা। তাদেরকে তেমন কোন অংশীদারে না রাখলেও তাদেরকে তারা যথার্থ সম্মান দিতো। হজ্জ্বের সব দায়িত্ব জুরহুম গোত্রের কাছে ছিল। তারা সেসবের খেয়াল রাখতো। কিন্তু আদনানী তথা ইসমাঈল আলাইহিসসালামের সন্তানাদিরা অজ্ঞাত থেকে যায়।
কিন্তু ইসমাঈল আলাইহিসসালামের বংশধারা কয়েকশ বছর পার করে একটা সময়ে “কিনানাহ বিন খুযাইমাহ” নামক সন্তানে গিয়ে পৌঁছায়। তখন তারা গোত্র বেইজড জীবন-যাপন করছিল। সেই ব্যক্তির নামানুসারে গোত্রের নাম ছিল “কিনানাহ গোত্র।”
সেই “কিনানাহ বিন খুযাইমাহ”র সন্তানদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে আসেন “ফিহর বিন মালিক বিন নাযার বিন কিনানাহ।” তার গোত্রই হলো “কুরাইশ গোত্র।” মানে “কিনানাহ গোত্র” থেকে পরে একটা সাব/উপ-গোত্র আসে যার নাম “কুরাইশ।” কুরাইশরা তখন মক্কার আশেপাশে বসবাস করতো।
সময় বহমান। সময়ের সাথে সাথে এক সময় জুরহুম গোত্রের শক্তি কমে যেতে থাকে এবং তাদের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। তারা অর্থনৈতিক মান্দায় পড়ে যায়। এসব থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য তারা সবার যাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার বা আচার-আচরণ করা শুরু করতে লাগলো। তারা হজ্জ্ব যাত্রীদের উপর নানা প্রকার অন্যায় অত্যাচার শুরু করে, এভাবে তারা বহুকাল ধরে করে আসলো। এমনকি তারা ক্বাবার অর্থ আত্মসাৎ করতেও একবার চিন্তা করতো না। নিমিষেই তারা নিয়ে নিতো।
শত্রু শত্রুর দুর্বল জায়গা খোঁজে বেড়ায়। বনু খুজায়া সেই দুর্বল জায়গা পেয়ে গেলো। তারা দলবদ্ধ হতে থাকে। জুরহুম গোত্রের এই অত্যচারের ভাগ তাদের উপরও পড়তো। এদিকে আদনানীরা ক্বাবার দেখভাল করার হকদার বেশী জুরহুম গোত্রের চেয়ে। তাই তারা সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। পরিকল্পনা মাফিল এগিয়ে যেতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তা গড়ায় যুদ্ধের ময়দানে। এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে বনু খুজায়া গোত্র।
উপায় না পেয়ে জুরহুম গোত্রের লোকেরা পলায়ন করতে থাকে মক্কার আশেপাশে থেকে। কিন্তু পলায়ন করার আগে জুরহুম গোত্রের নেতা ধন-সম্পদ ও ক্বাবার ভেতরে থাকা অনেক জিনিসপাতি যমযম কূপে ফেলে দেন এবং সেটা সাথে সাথে ভরাট করে দেন। এমনভাবে ভরাট করলেন যে বনু খুজায়া যখন মক্কায় আসলো তখন তারা যমযম কূপ খোঁজে পেলো না। খুজায়া গোত্র শুধু জুরহুম গোত্রকেই উৎখাত করেনি শান্ত হয়নি। সাথে উৎখাত করেছিল কুরাইশদেরকেও।
মক্কার শাসনভারের দায়িত্ব এখন বনু খুজায়া গোত্রের কাছে। তারা যা বলবে তাই হবে। হজ্জ্ব যাত্রীদের সবকিছুর দায়িত্বও এখন তাদের কাঁধে। এভাবে তারা মক্কার শাসনভারে ছিল প্রায় ৩০০ বছরের মতন। এই ৩০০ বছরে তারা যমযম কূপের খোঁজ পেল না যার কারণে পানির জন্য তাদের কিছুটা কষ্ট করতে হতো।
অন্যদিকে আরেক শক্তি উঠে আসছে, সেদিকে কারো খেয়াল নাই। কুরাইশ গোত্রের একজন ব্যক্তির নাম ছিল “কুসাই ইবনে কিলাব।” তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও দুর্দান্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তিনি ভাবলেন মক্কার দায়িত্বভার তাদের উপর আনা যায় কি-না। মানুষটি ছিলেন দুর্দান্ত পলিটিক্যাল তাই চট করে বুদ্ধি পেয়ে গেলেন। মক্কার অভিভাবক তখন খুজাযা গোত্রের “হুলাইল ইবনে হাবাশিয়া” নামক এক ব্যক্তি। কুসাই কী করলেন, তিনি হুলাইলের কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করলেন। এভাবে আস্তে আস্তে তার কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। হুলাইলের ছেলেমেয়ে ছিলো। তিনি তার মেয়েকে বিয়ে দেন “কুসাই ইবনে কিলাব”-এর সাথে। এবার তিনি ঢুকে গেলেন খুজায়া গোত্রের ভেতরে, ধরা যায় আপন একজন মানুষ।
কুসাই আস্তে আস্তে হুলাইলের বিশ্বাস অর্জন করলেন। মানুষের সেবাযত্ন এমনভাবে করতে লাগলেন যে মানুষজন হুলাইলের ছেলেদের চেয়ে তাকে বেশী ভালোবাসতে লাগলো। হায়াত শেষ হলে হুলাইল মারা যান। কুসাই ভাবলেন যে মক্কার দায়িত্ব একমাত্র তাদের হাতেই আসা উচিৎ কারণ তারা ইসমাঈলীয় বংশোদ্ভূত খাঁটি আরব। এবং অন্যান্য গোত্রের তুলনায় তাদের হক বেশি বা অগ্রাধিকারযোগ্য।
কুসাই আগে থেকে ফিহিরের বংশের সবাইকে একত্রিত করছিলেন এবং যখন সময় আসলো তখন খুজায়া গোত্রের সাথে যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে কারা মক্কার দায়িত্বে থাকবে। যুদ্ধে জিতে যায় কুরাইশরা। মক্কার অবিভাবক বনু খুজাযাকে হারিয়ে এখন নতুন অবিভাবকের মুকুট পড়ে “কুরাইশ।”
এবার কুরাইশরা মক্কায় অবস্থানরত খুজায়া গোত্রকে উৎখাত করে তাদের বংশের সবাইকে মক্কায় নিয়ে আসলো। তারপর সবার থাকার জন্য নির্ধারিত স্থান করে দেয়া হলো। এভাবে তারা বসবাস করতে থাকে মক্কায়।
কুসাই এবার ভাবলেন মক্কায় ভালোভাবে শিকড় গড়া চাই। তাই তিনি ক্বাবার উত্তরে ছোটখাটো একটা জায়গায় আলাপ-আলোচনা করার জন্য “দারুন নাদওয়া” স্থাপন করেন। দারুন নাদওয়া ছিল কুরাইশ নেতাদের বৈঠকের জায়গা যেখানে তারা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সমালোনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপনীত হতো। মূতল তা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণমুখী একটি নির্ধারিত জায়গা।
দারুন নাদওয়া প্রতিষ্ঠিত করলেন কুসাই, তিনিই হলে সভাপতি। কুসাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অধিকার লাভ করেন, যা হলোঃ
১)সকল আলোচনার পর সিধান্ত থাকতো তার হাতে।
২)যুদ্ধের পতাকা থাকতো তার হাতে।
৩)কাফেলার নেতৃত্ব।
৪)ক্বাবার রক্ষণাবেক্ষণ।
৫)হাজিদের পানি পান করানো।
৬)হাজিদের মেহমানদারি তার কাঁধেই ছিল।
কুসাইয়ের ২ পুত্র ছিলেন।
১)আব্দুদ দার ২)আব্দে মানাফ।
কুসাই ছিলেন বিচক্ষণ ও একজন উন্নত মানের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তার জীবদ্দশায় পুত্র আব্দে মানাফ সম্মান ও নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হলেও মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার ছেলে আব্দুর দারকে অসিয়ত করে যান। তারা সবাই তা দ্বিধাবোধ ছাড়াই মেনে নেন। কিন্তু সমস্যা বাধে আব্দে মানাফের মৃত্যুতে।
আব্দে মানাফের ছিল ৪ জন সন্তান যাদের নাম হলো ১)আব্দুশামস ২)হাশিম ৩)মুত্তালিব ৪)নাওফাল।
পিতা আব্দে মানাফের জীবদ্দশায় তারা একটা শব্দও করেনি ক্ষমতার জন্য। কিন্তু যেই তাদের পিতা আব্দে মানাফ মারা গেলেন তখন তারা নড়ে চড়ে বসলো। তারা বুঝতে লাগলো, না এভাবে হয় না, ভাগ আমাদেরও চাই। শুধু শুধু আব্দুদ দার কেন ক্ষমতা ভোগ করবে। তারা সব ভাইয়েরা একত্রিত হলেন।
একত্রিত হয়ে তারা আলোচনা করলেন এভাবে তারা ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না। কেনই বা আব্দুদ দারের সন্তানেরা একা এসব ভোগ করবে। তারা সিন্ধান্ত নিলেন যে কাবা ঘরের চাবি সংরক্ষণ, হাজীদের যমযমের পানি পান করানো, হাজীদের মেহমানদারী করা, যুদ্ধের ঝান্ডা ধরার যে কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন তা তারা আব্দুদ দারের সন্তানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিবেন। এবার কুরাইশদের মধ্যে ফাটল ধরলো। কুসাই হয়তো কোনদিন ভাবেননি তার মৃত্যুর পর এভাবে তার বংশ দুই ভাগ হয়ে যাবে। লোকেদের মধ্যে কেউ কেউ গেলো বনু আব্দুদ দারের পক্ষে কেউ কেউ গেলো বনু আব্দে মানাফের পক্ষে।
পক্ষে লোক থাকাটা স্বাভাবিক কিন্তু তা যে তাদেরকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়ে যাবে তা তারা হয়তো কোনদিন ভাবেনও নি। বনু আব্দুদ দার ও বনু আব্দে মানাফ গোত্রে ও তাদের মিত্ররা প্রস্তুতি নিতে লাগলেন যুদ্ধের জন্য। প্রত্যেক গোত্রের নেতা ক্ববার পাশে এসে আতরে হাত ডুবিয়ে ওয়াদা করলেন যে কোন ফয়সালা না হওয়া অব্দি তারা তাদের মিত্রকে কখনো ছেড়ে যাবেন না বা চুক্তি ভঙ্গ করবেন না।
টানটান উত্তেজনা অবস্থায় দুই পক্ষ থেকে সন্ধির আওয়াজ আসলো। বিচক্ষণ ব্যক্তিরা বুঝলেন যুদ্ধ করে লাভ নেই, উল্টো নিজেদের ক্ষতি। এর চেয়ে সন্ধি করে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিলেই হয়। সন্ধি করার সময় দুই পক্ষ একটা সিধান্তে গেল, যে বনু আব্দে মানাফ হাজিদেরকে পানি পান করাবে ও মেহমানদারির দায়িত্ব নিবে। এবং বনু আব্দুদ দার ক্বাবা ঘরের চাবি সংরক্ষণ, যুদ্ধে পতাকার ঝান্ডা ও সভার দায়িত্ব পালন করবে। তবে দারুন নাদওয়ার দায়িত্বে উপর গোত্রর সমানভাবে শরীকানা ছিল। উপরোক্ত বর্ণিত চুক্তিরে তারা একাত্মা পোষণ করেন এবং চুক্তি মেনে নেন। এ কারণে কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলো।
সন্ধি চুক্তি অনুযায়ী যে যার যার মতন দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তবে তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রতিযোগিতা বিরাজমান ছিল। কিন্তু তা কখনো যুদ্ধে যাওয়ার মতন পরিস্থিতি তৈরী করেনি।
এদিকে বনু আব্দে মানাফের ছেলে আব্দুশামস তখন গোত্রের প্রধান নেতা। সবকিছুর দেখভাল তিনিই করছিলেন এবং সুন্দরভাবে পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো যে, তিনি ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন এতে মক্কায় খুব কম সময় থাকা হত যার কারণে তার ছোট ভাই “হাশিম”-এর উপর দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি হাজীদের দেখভাল ও সেবাযত্ন করতেন। সবাই থাকে খুবই শ্রদ্ধা করতো। একসময় “হাশিম” যার আসল নাম “আমর” হয়ে উঠেন কুরাইশদের মধ্যমণি।