আমাদের শৈশবের নায়ক-নায়িকা ছিলেন শাবানা-আলমগীর। কৈশোরের নায়ক-নায়িকা রিয়াজ-পূর্ণিমা, শাবনূর। ডিস এন্টিনা আসার সাথে সাথে যৌবনে আমরা ঢালিউড ছেড়ে প্রবেশ করলাম টালিউড, বলিউড আর হলিউডের রঙ্গিন জগতে। তখন আর শাবানা-শাবনূরের প্যানপ্যানানি কান্না আর ভালো লাগতো না, বিরক্ত হতাম। অথচ ছোটোবেলায় তারাই ছিলেন আমাদের ‘স্বপ্নের নায়িকা’।
আমাদের ভালো লাগা শুরু হলো শাহরুখ-সালমান-আমির-ঋত্বিক-রণবীরকে। আমাদের ভালো লাগা শুরু হলো ঐশ্বরিয়া-কাজল-প্রিয়াঙ্কা-জ্যাকুলিন-আলিয়াকে। একদিকে জিৎ-দেব-সোহাম, কোয়েল-শ্রাবন্তী-পূজাকে, অন্যদিকে ডি ক্যাপ্রিও-টম হ্যাংক্স-ব্রাড পিট, জ্যানিফার লরেন্স-ইমা ওয়াটসনকে। আমাদের পছন্দের নায়ক-নায়িকা সময়ের সাথে সাথে বদলেছে। দশ বছর আগে যার মুভি দেখার জন্য পরীক্ষার খাতায় অর্ধেক লিখে জমা দিয়ে এসেছি, আজ তার মুভি দেখলে বিরক্ত লাগে। আজ আমার যদি ‘প্রিয়’ নায়ক-নায়িকার লিস্ট করি তাহলে দেখবো দশ বছর আগের লিস্টের সাথে কোনো মিল নেই, দশ বছর পর যদি একটা লিস্ট করি, তাহলে দেখবো আজকের লিস্টের সাথে মিল নাই।
ছোটোবেলায় যখন ববিতা-শাবানাকে দেখতাম, তখন তাঁদেরকে ভালো লাগার পাশাপাশি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা কাজ করতো। একটা গান শুরু হলে টিভি বন্ধ করে দিতাম, ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম। বড়ো হবার পর যখন প্রিয় নায়িকার জায়গায় পূর্ণিমা-ক্যাটরিনা-ইমা আসলো, তখন কিন্তু অন্যরকমের ‘ফিলিংস’ কাজ করা শুরু করলো। শ্রদ্ধার জায়গা হারিয়ে গিয়ে সেখানে এসে বসলো হৃদয়ের এক টানটান উত্তেজনা। মিডিয়া এটার নাম দিলো- হার্ট থ্রুব। মেয়েরা যখন শৈশবের আলমগীর-জসীম ছেড়ে পছন্দ করা শুরু করলো শাহরুখ-সোহাম-ডি ক্যাপ্রিওকে, তখন তাদেরকে দেখামাত্র বলা শুরু করলো- “ওয়াও! কী হ্যান্ডসাম, কী কুল!”। অথচ ছোটোবেলায় তারাও কিন্তু আলমগীর-জসীম-রুবেলের বেলায় এসব শব্দ ব্যবহার করতো না। তারমানে, আস্তে আস্তে নায়ক-নায়িকাদের বেলায় আমাদের ‘অন্যরকম’ ফিলিংস কাজ করা শুরু করে।
আলোচনার আরো গভীরে যাবার আগে একটা জিনিস ক্লিয়ার করে নিই। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এমন নায়ক-নায়িকাদের নাম উল্লেখ করার দরকার কী। এদেরকে আমরা সবাই চিনি। অন্তত আমাদের ৯০% এদেরকে চিনেন। সাধু সেজে এমন ভান করার দরকার নেই- আরে, এদেরকে তো আমি চিনি। এদেরকে চেনাটা সমস্যা না, কিন্তু এদেরকে আঁকড়ে ধরে থাকাটা সমস্যা। এদেরকে চেনাটা যদি অসুখ হয় তাহলে তার চিকিৎসার জন্য ওষুধ লাগবে। রোগ নির্ণয়ের জন্য অসুখের বিবরণ দেবার জন্য আমি তাদের নাম মেনশন করলাম।
ওস্কার ওয়াইল্ডের একটা উক্তি আমার খুব পছন্দের। “Every saint has a past” অর্থাৎ, প্রত্যেক সাধু-দরবেশেরই একটা অতীত আছে। আজকে যাকে দরবেশ মনে হচ্ছে, অতীতে তো সে দরবেশ ছিলো না। আজকে আমরা যারা হারাম কাজ ছেড়ে দিয়েছি, চেষ্টা করছি তারা যদি উদ্যোগী না হয়ে হারাম কাজগুলোর প্রতিক্রিয়া না লিখেন, তাহলে আজকে যারা হারামে লিপ্ত, তারা হারাম কাজ ছাড়বে কিভাবে?
ছোটোবেলায় মুভি দেখতে গিয়ে মা-খালাদেরকে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখতাম। শাবানার সাথে তারাও কান্না করতেন। বড়ো হয়ে আমরাও ‘বড় ছেলে’ দেখে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছেছি। আঁচলের জায়গা পরিবর্তন হয়ে এসেছে টিস্যু, কিন্তু চোখ মুছামুছি ঠিকই রয়ে গেছে। তারমানে, আমরা মুভি-নাটক হৃদয় দিয়ে অনুভব করা শুরু করলাম। হৃদয়ের খোরাক আমরা খুঁজতে লাগলাম নাটক-সিনেমা-গানে। তারপর একদিন আমরা অভিযোগ করা শুরু করলাম- ইশ! কুরআন পড়লে আমার কান্না আসে না কেনো? নবী-সাহাবীর ঈমানদীপ্ত ঘটনাগুলো পড়ে আমিও কেনো অশ্রুসিক্ত হই না? মাযলুম মুসলিমদের ঘটনাগুলো শুনে আমার হৃদয়ও কেনো হুহু করে উঠে না? কেনো কেনো কেনো?
আমাদের চোখ দিয়ে পানি আসছে না, এটা একটা রোগ। তাহলে আসুন, একজন ডাক্তারের কাছে যাই। দেখি ডাক্তার আমাদেরকে কী ওষুধ দেন…“হৃদয়ের খোরাক নিতে যারা বিবিধ কবিতা শোনে (মুভি দেখে, গান শুনে), দেখবে- কুরআন শোনার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে। এমনকি একটা পর্যায়ে কুরআন শোনার প্রতি বিরক্তও হতে পারে। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে মাত্রাতিরিক্ত ঘুরাঘুরি যে করে, দেখবে- বায়তুল্লাহর হজ্জ্ব করার জন্য আন্তরিকতা ও ভালোবাসা তার হৃদয়ে অবশিষ্ট থাকে না। পারসিক ও রোমান পণ্ডিতদের বিভিন্ন বাণী থেকে শিষ্টাচার আর প্রজ্ঞাবান চয়নের নেশা যাকে পেয়ে বসেছে, ইসলাম ও এ থেকে উৎসরিত জীবনশৈলী শিষ্টাচারের প্রতি ঐ পরিমাণ টান তার অন্তরে থাকে না।” [ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম: ১/৪৮৪] যেই ডাক্তার এই প্রেসক্রিপশন দিলেন, তিনি হলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)।
তারমানে আমরা কুরআন পড়ে কান্না করতে পারছি না? কারণ, আমরা অন্যকিছু পড়ে, অন্যকিছু শুনে কান্না করছি। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো হাদীস পড়ে আমাদের হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠছে না? কারণ, আমরা বিখ্যাত মনীষীদের বাণী, কবিতা থেকে আমাদের হৃদয়ের খোরাক নিয়ে হৃদয়টা ভরে ফেলেছি। সেই হৃদয়ে আর নবিজীর জন্য জায়গা অবশিষ্ট নেই, সাহাবীদের জন্য মুহব্বত জন্মানোর জন্য স্পেইস খালি নেই। Memory Full.
আমাদের সবার জীবনে নায়ক-নায়িকা আছে। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোনো নায়ক-নায়িকা নেই। তবে দেখতে হবে, সেই নায়ক-নায়িকা আসলে কে? সেটা কি টিভির পর্দার কোনো নায়ক-নায়িকা নাকি হৃদ-মাজার জুড়ে থাকা মুহাম্মদ (সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তার সাহাবীরা?
আমরা কি বুঝতে পারছি, শৈশব থেকে যৌবন, আমরা ভুল মানুষকে আমাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছি? ভুল মানুষকে আমরা ‘নায়ক-নায়িকা’ বানিয়েছি? তারমানে এতোদিন আমরা একটা ভুল ট্রেনে চড়েছিলাম। ভুল ট্রেন আমাদেরকে ভুল গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছিলো। এখন কী করতে হবে? নজীবানুবাদে কবি যাকিয়া আল-উতাইবি আমাদেরকে একটা সমাধান দিচ্ছেন।
দেখুন তো পছন্দ হয় কিনা…
“ভুল কোনো ট্রেনে যদি উঠেই পড়ো
পরের স্টেশনেই নেমে যেয়ো।
ট্রেন যত দূরে যাবে
তোমার ফেরার কষ্ট তত বেশি হবে।”
আপনি কি ভাবছেন, এতোদিন এতো পাপ করলাম, এবার আল্লাহর দিকে ফিরবো কিভাবে? আল্লাহ কি আমাকে মেনে নিবেন? ঠিক এই কথাটি যদি আপনি ভেবে থাকেন, তাহলে দেখুন তো আল্লাহ এই কথাটি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন কিনা… “ও আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছো (পাপাচারে লিপ্ত হয়েছো), তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের সমস্ত গুনাহগুলো মাফ করে দিবেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা যুমার: ৩৯:৫৩]
যে আল্লাহ আপনার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবার গ্যারান্টি দিচ্ছেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিবেন না?