ঈদুল ফিতর আমাদের ইসলামি সংস্কৃতির একটি মৌলিক উৎসব। একবিংশ শতাব্দীর এই জামানায় ইসলাম ও জাহিলিয়্যাত (কুফর) এর লড়াই এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে আজকে আমাদের আলাদা করে আলোচনা করতে হচ্ছে কিভাবে আমাদের এই মৌলিক সংস্কৃতির মৌলিকত্ব ধরে রাখব। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ঈদুল ফিতরের উদ্দেশ্য থেকেই দূরে সরে গেছি।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের আনন্দ উৎযাপনের জন্য যে দুইটি উৎসব নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর। এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি সামান্য কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করব কিভাবে আমরা ঈদুল ফিতরকে বাদ দিয়ে অনৈসলামি সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন হিসেবে উৎযাপন করছি।
একটি ছোট বাচ্চার সবচেয়ে আনন্দের দিন কোনটা? সেটা হচ্ছে তার জন্মদিন। কারণ, এদিন সে অনেক খেলনা গিফট পায়, সবার অনেক আদর পায়, অনেকে বেড়াতে আসে, কেক কেটে খুব আনন্দ উৎযাপন হয়, এই দিনে সে অনেক আনন্দ করে। এই বাচ্চাটির কাছে তার জন্মদিন সবচেয়ে আনন্দের দিন। ঈদের চেয়েও। প্রতি বছরই কিন্তু খুব আয়োজন করে তার জন্মদিন পালন হচ্ছে। আমাদের সমাজের পিতামাতারাই সন্তানদের এভাবে বড় করছেন যে জন্মদিন হয়ে যায় তার সবচেয়ে আন্দন্দের দিন।
একজন গৃহিণীর সবচেয়ে আনন্দের দিন হয় ম্যারিজ ডে। এইদিন প্রিয়তম স্বামীর কাছে কিছু না কিছু গিফট পায়। হয়তো ঘরে ছোট খাটো আয়োজনও হয়। এটা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে দিবস পালনের কথা বললাম। রাষ্ট্র সবচেয়ে ঘটা করে কোন উৎসব পালন করে? নববর্ষ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন ভালোবাসা দিবস।
যাদের কথা বললাম তারা তো সবাইই মুসলিম, রাষ্ট্রও ৯০ ভাগ মুসলিমের, তবু কেন অনৈসলামি উৎসবগুলো আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন হয়? আর ঈদের দিন কেন হয়ে যায় আমাদের ঘুমের দিন? অন্যদিকে সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা নববর্ষকে বাঙালির ঈদ বানাতে ব্যস্ত। এজন্য তারা সর্বোচ্চ লেভেলের চেষ্টা করছে। আর তাদের চেষ্টার ফল আমরা দেখতেই পাই প্রতি নববর্ষে, বহু মুসলিম এই দিনটিকে ঘটা করে পালন করে। রাষ্ট্রও ব্যাপকভাবে এর পৃষ্ঠপোষকতা করে।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েও পারসিকরা নওরোজ পালন করত। আর মুসলিমরা এর বিপরীতে পালন করত দুই ঈদ। কিন্তু কিভাবে ১৪০০ বছর পর আমরা মুশরিকদের উৎসবের দিকে ফিরে যাচ্ছি? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় মুশরিকদের বিপরীত করতে আদেশ করতেন। অথচ আমাদের বাংলা নববর্ষ তৈরি হয়েছে ভারতীয় মুশরিকদের বিভিন্ন পূজা-উৎসবের উপাদানগুলো একত্র করে।
জন্মদিন, মৃত্যুদিন, ম্যারিজ ডে, ভালোবাসা দিবস, বিজয় কিংবা স্বাধীনতা দিবস এসব পালন করা অধিকাংশ বা প্রায় সব আলিমদের মতেই নাজায়েজ। যদি জায়েজও হত, এগুলো অবশ্যই অনৈসলামি উৎসব। একটা অনৈসলামি দিবস কিভাবে আমাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন হতে পারে যেখানে আমাদের নিজস্ব উৎসব আছে? আমরা আল্লাহর নির্ধারণ করা উৎসব বাদ দিয়ে অনৈসলামি এবং ক্ষেত্রবিশেষ কুফরি দিবস পালন করছি। এমনটা কেন?
এখন আলোচনা করব আমাদের মৌলিক উৎসব ঈদুল ফিতর কিভাবে অনেক বেশি আনন্দঘন উপায়ে উৎযাপন করা যায়:
(ঈদুল ফিতরের অনেক আমল ও সুন্নাত আছে, সেগুলো দেখে নিবেন ইনশাআল্লাহ, তবে এগুলো আমাদের আলোচ্য বিষয় না)
১। ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহতে পুরো পরিবার নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। এই নামাজ মাসজিদে আদায়ের চেয়ে খোলা ময়দানে পড়তে বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে। আর ঈদগাহতে মহিলাদের জায়গাও রাখা হয়।
২। বাচ্চাদের আমরা সাধ্যমত ঈদি দেব ইনশাআল্লাহ্। ‘সালামি’ নয়, পায়ে ধরে সালাম করা আমাদের সংস্কৃতি না। ঈদ উপলক্ষ্যে দিব, সালাম উপলক্ষ্যে না।
৩। ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন পোশাক কেনার চর্চা তো ব্যাপক। আসলে আমরা রসুলুল্লাহর পুঙ্গানুপুঙ্খ অনুসরণ করলে আমাদের উচিৎ হবে না প্রতি ঈদে এতো দামি দামি পোশাক কেনা। হ্যাঁ, ঈদের দিন সবচেয়ে উত্তম পোশাকটি পড়তে হবে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষ্যে শপিং করতে গিয়ে রমাদানের অনেক সময় নষ্ট হয়, আর অর্থ অপচয় তো আছেই। তাই যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই আমরা কিনব।
আলমারি ভর্তি পোশাক রেখে নতুন পোশাক কেনাকে উৎসাহ দেয়া যায় না। দুইটার যে কোনো একটা করতে পারেন, হয় অন্য সময় না কিনে যা যা প্রয়োজন সব ঈদ উপলক্ষ্যে কিনবেন। আর অন্য সময় কিনে থাকলে ঈদের সময় নতুন করে আবার কেনার দরকার নাই। তবে মা-বাবাকে, আত্মীয় স্বজনকে পোশাক গিফট দিয়ে তাদের মন জয় করার সুযোগ হাতছাড়া করা উচিৎ নয়। (আমাদের স্বতন্ত্র উৎসবের ন্যায়, আমাদের স্বতন্ত্র লিবাসও আছে, এগুলোকে আমরা উৎসাহিত করব, নিজেরা পড়ব, অন্যকেও উপহার দিব)
৪। আপনি কি আপনার বাচ্চার জন্মদিন প্রতি বছর পালন করে থাকেন? কিন্তু চেষ্টা করেও এই চর্চা বাচ্চার জেদের কারণে (বা অন্য কারণে) বন্ধ করতে পারছেন না? তাহলে ঈদের দিনকে বেছে নিন আপনার বাচ্চাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত করার দিন হিসেবে। দরকার হলে কেক কেটে আনন্দ করুন। বাচ্চাকে বোঝান আনন্দের দিন আমাদের এটা, জন্মদিন না। জন্মদিনের গিফট ঈদের দিন দিন। যারা আপনার বাচ্চাকে জন্মদিনের গিফট দিতে চায় তাদের বলে দিন ঈদের দিন যেন সেটা দেয়। পারলে পরিচিত সবাইকেই ঈদের দিন হাদিয়া দিন, যাদেরকে জন্মদিনের গিফট দিয়ে থাকেন।
স্ত্রীকে ম্যারিজ ডে তে যে গিফট দিয়ে থাকেন সেটা দিন ঈদের দিন। এতো মানুষকে হাদিয়া দিতে গিয়ে চাপ পড়লে দরকারে দুই ঈদে ভাগ করে নেন। তবু ঈদের দিনেই যেন আমরা অন্যকে খুশি করতে পারি। অন্য কোনো দিনকে খুশি করার দিন হিসেবে নিব না।
৬। ঈদের দিন ভালো পোশাক পরিধানের পাশাপাশি সবার ঘরেই ভালো রান্নার আয়োজন হয়ে থাকে। তাই এটা আলাদা করে বলার কিছু নাই। গরিবের ঘরেও এদিন ভালো আয়োজন হয়। তবে বেশি আয়োজন করতে গিয়ে অপচয় না হয় এবং মা-বোনদের যেন কষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখব ইনশাআল্লাহ।
৭। ফিতরা ঈদের নামাজের আগেই পরিশোধ করে দিব, এ ছাড়াও ঈদের দিন গরিব মিসকিনকে যথাসাধ্য সাহায্য করে তাদের খুশিতে ও দুয়ায় শামিল হব ইনশাআল্লাহ।
৮। এইদিন আমরা প্রতিবেশীদের দাওয়াত করব, আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করব। সবাই মিলে মিশে আনন্দ উপভোগ করব। অবশ্যই হালাল হারামের ব্যাপারে সতর্ক থাকব, বিশেষ করে ফ্রি মিক্সিং থেকে সতর্ক থাকব যা আমাদের সমাজে রক্ষা করে চলা অনেক কঠিন।
৯। ঈদ উপলক্ষ্যে সেকুলার পত্রিকাগুলো ঈদসংখ্যা নামে কিছু একটা বের করে। আর সিনেমা নাটকওয়ালারাও ঈদ উপলক্ষ্যে হারাম জিনিসের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটায়। উপলক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়া হল ইসলামের উৎসব ঈদকে অথচ হালাল হারামের কোনো তোয়াক্কাই করা হয় না। ইসলামের উৎসব ঈদ হলেও সেকুলারদের প্রকাশিত ঈদসংখ্যায় ইসলামের নাম গন্ধ থাকে না।
আমরা যারা পত্রিকা ম্যাগাজিন বা নাশিদ কিংবা ইসলামি নাটক তৈরির সাথে জড়িত, আমরাও ঈদ উপলক্ষ্যে বিশেষ কিছু আয়োজন করতে পারি। কিন্তু অবশ্যই সেখানে যেন ইসলামের দাওয়াত থাকে, ঈদ উৎসবের উদ্দেশ্যের বিপরীত কিছু যেন না থাকে।
আরেকটা কথা, পবিত্র রমাদানের রেশ মুছতে না মুছতেই নাটক সিনেমাওয়ালারা ঈদকে উপলক্ষ্য করে এতসব হারাম প্রচার শুরু করে দেয়, এর তীব্র বিরোধিতা করা উচিৎ আমাদের। যে যেভাবে পারি বিরোধিতা করব, হাত দিয়ে, মুখ দিয়ে, না হলে অন্তত অন্তরে ঘৃণা দিয়ে।
আল্লাহ্ আমাদেরকে ঈদুল ফিতরের আনন্দ তাঁর মর্জিমত পালন করার তৌফিক দিন, তাকে অসন্তুষ্ট করে নয়, বরং আনন্দ যেন তাকে সন্তুষ্ট করে উদযাপন করতে পারি। আল্লাহুম্মা আমিন।