আচ্ছা, জীবনে এমন পরিস্থিতি কি এসেছে আপনার, প্রচণ্ড অসহায়, কিছুই করার নেই, মনে হচ্ছে সব এলোমেলো, আর ঠিক হবে না? অথবা ধরুন, নদী বা সমুদ্র পার হচ্ছেন, এমন সময় তীব্র ঝড়, বাতাসের তোড়ে সব ভেঙে যায় যায়, মনে হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন? আপনি সাঁতার জানেন অথবা জানেন না, বুঝতে পারছেন তীব্র এই ঢেউয়ের মোকাবেলা করার সাধ্য আপনার নেই। জীবনের এইরকম মূহুর্তগুলোয় আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি, আল্লাহ ছাড়া আমরা পুরোপুরি অসহায়।
দেখুন, আমি লিখিনি যে, আল্লাহ ছাড়া আমরা কতোটা অসহায়! আমি লিখেছি, পুরোপুরি অসহায়। তখন বুঝা যায় আল্লাহর সামান্যতম ইশারায়ই আমাদের জীবন তছনছ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ হচ্ছেন, আকবার, সবচেয়ে বড়।
সবচেয়ে প্রতাপশালী। আবার, আল্লাহই কিন্তু সবচেয়ে বেশী দয়ালু। সবচেয়ে বেশী ক্ষমাশীল। আর-রাহমান, তাঁর চেয়ে বেশী দয়া আর কারো হতে পারে না। কোনোদিন না।
আমরা যখন পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাগুলো সম্বন্ধে জানি, যখন দেখি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নিষ্পাপ শিশুরা মারা যাচ্ছে বোমার আঘাতে, অথবা প্রতিদিন প্রতিদিন ক্ষুধায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, অথবা মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে, অত্যাচারীর বিচার হচ্ছে না, তখন প্রশ্ন জাগে, আল্লাহ কি এসব দেখেন না? তিনি কীভাবে সহ্য করেন এসব? আল্লাহর দয়া কোথায়? অথচ, ঐ মূহুর্তেও কিন্তু আল্লাহ রাহমানুর রাহীম। আবার একই সময়ে তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সবচেয়ে শক্তিশালী। আমরা আমাদের চোখে কখনো তাঁর ক্ষমতা দেখি, কখনো তাঁর দয়া।
একটু উদাহরণ দেই, চিকিৎসকের কাছ থেকে যখন রোগী পরামর্শ নেয়, তখন সে কী ভাবে? রোগী তো জানে না তার কী হয়েছে, বললে হয়তো কিছুটা জানবে, বুঝবে। কিন্তু এর জন্য চিকিৎসক তাকে যে ওষুধ খেতে বলছেন, তা তার জন্য কেন কার্যকরী, অথবা কীভাবে কাজ করবে সব কিন্তু সে জানে না। তারপরও খায়, পরামর্শ মানে।
অর্থাৎ, জগতে সবকিছু নিজের জ্ঞান দিয়ে চলছে না। আমাদের পক্ষে কখনোই পৃথিবীর সব জানা সম্ভব না। আমরা তাই অন্যের জ্ঞানের উপর বিশ্বাস করি, আস্থা রেখে পরামর্শ মানি। বিশ্বাস জরুরী এবং অপরিহার্য। তাহলে আমাদের যখন মনে হচ্ছে আল্লাহ রাহমানুর রাহীম হওয়া সত্ত্বেও কেনো এতো অন্যায়? তখন উচিত, আল্লাহর জ্ঞানের উপর বিশ্বাস রাখা।
তাঁর সৃষ্টি মানুষের জ্ঞানের উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা যিনি তাঁর উপর বিশ্বাস না রেখে উপায় কী? আর, আল্লাহর কাছে দুআ করা, আমাদের সাধ্যে আর যা যা করার আছে, তা করা। কিন্তু কখনোই এমনটা না ভাবা, আল্লাহর জ্ঞানে এসব নেই, আল্লাহ দেখছেন না। বিশ্বাস হারিয়ে আমরা যেন এমন কথা বলে না ফেলি, যা আমাদের বিশ্বাসের ঘাটতির প্রমাণ দেয়।
ইব্রাহিম বিন আদহাম রাহিমাহুল্লাহ একবার জাহাজে করে কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ আলেম, একজন অসাধারণ মানুষ। আশপাশের সবাই তাঁর ধার্মিকতার কথা জানতো। তিনি সমুদ্রে, হঠাৎ অনেক ঝড়। ঢেউয়ের তোড়ে জাহাজ যেন ভেঙে যায়, সবাই মনে করছে এখনই শেষ হয়ে যাবে সবকিছু, মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তাদের দিকে। ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে, জাহাজ ডানে-বামে দুলছে।
ইব্রাহিম বিন আদহাম ঘুম থেকে জেগে জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়ালেন। অন্য যাত্রীরা তাঁর পাশে ভীড় করলো, “আপনি আল্লাহকে কী বলতে পারেন আমাদেরকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে?” তিনি আসমানের দিকে দু হাত তুললেন। বললেন, أَرَيْتَنَا قُدْرَتَكَ فَأَرِنَا عَفْوَكَ “হে চিরঞ্জীব, সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান, আমাদেরকে আপনার ক্ষমতা দেখিয়েছেন। এইভাবে আমাদেরকে ক্ষমা করে নিরাপদ করুন”।
এই দোয়া করবার সাথে সাথে ঝড় থামার শুরু করলো, বাতাস শান্ত হচ্ছে। ঢেউ থেমে গেলো, সবাই নিরাপদ আশ্রয় পেলো। ইব্রাহিম বিন আদহাম আবার শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। এইরকম ছিলো আল্লাহর সাথে তাঁর যোগাযোগ।
আসুন আমরা দোয়াটির দিকে লক্ষ্য করি। তিনি বলেননি যে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন।বরং বলেছেন যে আপনার ক্ষমতা দেখিয়েছেন, আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে তিনি দোয়া শুরু করেছেন।
এখানে নিরাপদ বা ক্ষমা অর্থে যে আরবি শব্দ ব্যবহার করেছেন তা হচ্ছে আফওয়ান। এর দ্বারা ভিন্নরকম এক ক্ষমা বোঝানো হয়, ক্ষমা, নিরাপত্তা, দয়া একইসাথে। দিন শেষে আমরা তো তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। এই সবের মালিক তো তিনিই। আমি দুআ করি আপনার জীবন নিরাপদ হোক, সুন্দর হোক। যদি কখনো উত্থালপাতাল লাগে, তখন আল্লাহকে বলবেন, “হে আল্লাহ, আপনার ক্ষমতা আমি দেখেছি, এখন আমাকে আপনার দয়া দেখবার সুযোগ করে দিন, আমাকে আপনার কাছে নিরাপদ আশ্রয় দান করুন”।
আমাদের সবার জীবন আল্লাহর দেওয়া আফিয়াতে পূর্ণ হয়ে যাক। আল্লাহর ক্ষমতার পাশাপাশি তাঁর দয়া দেখবার মতো দৃষ্টি আমাদের হোক। জীবনের কঠিনতম মূহুর্তে আল্লাহ আমাদেরকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা দিক যে তখনো তিনি আর রাহমান, বিশ্বাসে তিনি আমাদের অটল যেন রাখেন। আল্লাহুম্মা আমিন।