মানুষটাকে আমি চিনতাম না। আগে কখনও তার নামও শুনিনি। একদিনের ঘটনা। কাটাবন গিয়েছি কিছু বই কিনতে। গিয়ে দেখি, এক ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কিছু একটা পড়ছেন। কান পেতে শুনি, তিনি ওয়ায়েস করনীর কাহিনী পড়ছেন। আমরা জানতাম ওয়ায়েস করনী ছিলেন একজন নবী প্রেমী, আশেকে রসুল। উহুদ যুদ্ধে রসুলের দাঁত শহীদ হবার কথা শুনতে পেয়ে তিনি পাথর দিয়ে নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলেছিলেন।
অথচ তিনি কোনদিন আল্লাহর নবীকে স্বচক্ষে দেখেননি।আল্লাহর নবী তার জন্য নিজের জুব্বা রেখে যান। ওসিয়ত করে যান, এই জুব্বা যেন ওয়ায়েস করনীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়য়। হযরত ওমর অনেক খুঁজে ওয়ায়েস করনীর সন্ধান পান। তার সাথে দেখা করেন। রসুলের দেয়া জুব্বা পৌঁছে দেন তার কাছে । ওয়ায়েস করনী হযরত ওমরকে দেখে বলেছিলেন, আপনারা নবীর সাথে ছিলেন। তার পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করেছেন। অথচ আপনাদের দাঁততো দেখি অক্ষত আছে। অথচ এই আমি জীবনে কোনদিন নবীকে দেখিনি। কিন্তু রসুলের দাঁত শহীদ হবার কথা শুনে পাথর দিয়ে নিজের দাঁত ভেঙ্গেছি। তবে আপনারা কেমন নবী প্রেমিক হলেন?
এই কথা শুনে হযরত ওমর দারুণ লজ্জা পেলেন। ওয়ায়েস করনীর এই ঘটনা আমরা অনেক শুনেছি। কত ওয়াজে বক্তারা এই কাহিনী বলে কেঁদেছেন! আমরাও কেঁদেছি। ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘ছোটদের ওয়ায়েস করনী’ বইয়েও এই কাহিনী পড়েছি। সেই ভাই যখন এই বই পড়ছেন, আমি তখন কান পেতে শুনছি। কিন্তু এর পরে যা শুনতে পেলাম, তাতে আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। এই কাহিনী নাকি ভুয়া। পুরোটাই জালিয়াতদের বানানো। দাঁত ভাঙ্গার অমন কোন ঘটনাই ঘটেনি।
আমি এগিয়ে এসে বইটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। বইয়ের নাম “হাদিসের নামে জালিয়াতি” লেখক খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। তখনই বইটি কিনে নিলাম। বাসায় এসে নাওয়া খাওয়া ভুলে বইটা পড়ে শেষ করলাম। বই পড়ে আমিতো অবাক! এতদিন জেনে আসা, বলে আসা অনেক কাহিনীই যে ভুল। মেরাজের রাত্রে আত্তাহিয়াতু লাভ, নবীকে সৃষ্টি না করা হলে দুনিয়া সৃষ্টি হত না, জাবের রাযি আল্লাহু এর দুই ছেলের মৃত্যু ও আবার জীবিত হওয়া…জানতে পারলাম, এ সবই জালিয়াতদের বানানো মিথ্যা কথা।
এই বইয়ের ভাষা, যুক্তি বিন্যাস, যুক্তি খণ্ডন ইত্যাদি আমাকে অবাক করেছে। বাংলা ভাষায় কোন আলেম এতটা প্রাঞ্জল, এতটা সাবলীল ভাবে বই লিখতে পারেন, এ ছিল আমার কল্পনারও বাইরে। পরের বই কিনলাম, ‘রাহে বেলায়াত’। ভূমিকা পড়েই আমি মুগ্ধ। ভূমিকাতে তিনি খুব সুন্দর করে বলেছেন, অনেকে জিকিরকে গুরুত্ব দিতে চান না। ভাবেন, এখন ইসলাম বিপন্ন। সমাজে, রাষ্ট্রে ইসলাম পালন হচ্ছে না। এ সময় জিকিরের মত নফল ইবাদতকে গুরুত্ব দেয়ার কোন মানে হয় না।
অথচ আল্লাহর রসুল ও তার সাহাবীরা একই সাথে সালাত আদায় করেছেন, জিহাদ করেছেন, আবার একই সাথে জিকির আজকার, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদিকেও গুরুত্ব দিয়ে পালন করেছেন। তাই আমাদের উচিত নবীর আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে এ ধরনের সব কাজকেই গুরুত্ব দেয়া। যথাসাধ্য পালন করা উনার এই কথায় আমিও যেন জিকিরকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। অনেক অনেক জিকির সম্পর্কে নতুন করে জানলাম।
এরপর থেকে একের পর একে স্যারের বই কেনা শুরু করি। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী ভরে যায়, স্যারের লেখা বইয়ে। টিভিতে প্রথম যেদিন উনাকে দেখলাম কি যে ভাল লেগেছিল! মনের অজান্তেই মানুষটাকে বড় বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম। দিনে দিনে সে ভালবাসা আরও বেড়েছে। দিনে দিনে তাকে যত দেখেছি, তার কথা যত শুনেছি, তত বেশি মুগ্ধ হয়েছি।
তার বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কখনো কাউকে আঘাত দিয়ে, কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না। কারও কোন কথায় রাগ, ক্ষোভ কিংবা চরম প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। হাসিমুখে সবার কথা শুনতেন। অত্যন্ত নরম, দরদপুর্ণ ভাষায় জবাব দিতেন। তার কথায় আবেগের বাড়াবাড়ি থাকতো না। থাকতো কুরান হাদিসের দলীল, মনোমুগ্ধকর সব যুক্তি। তার মত করে এমন ভাষায় দ্বিতীয় কোন আলেমকে কথা বলতে দেখি নি। এমন মানসিকতার দ্বিতীয় আরেকজন মানুষের কথা কোথাও শুনিনি।
মনে পড়ে, সেদিন বিকেলে টিভিতে খবর দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি, খবরের মাঝখানে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের লেকচারের অংশবিশেষ দেখানো হচ্ছে। বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় খাঁ খাঁ করে উঠল। খবরের ভেতরে তার লেকচার দেখাচ্ছে কেন? তার কিছু হয়নিতো? একটু পরেই জানতে পারলাম, একটা রোড এক্সিডেন্টে তিনি…
আমার সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল। চোখের পাতা হয়ে এলো ভারী। বুকের ভেতরের অব্যক্ত কান্না গুমরে গুমরে উঠছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবী এত নীল কেন? পৃথিবী কেন আজ এত আলোহীন? কেন কোথাও কোন অক্সিজেন নেই, বাতাস নেই, যেখানে আমি প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারি? মনে হচ্ছিল, কি বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল আমার! কত কি জানার ছিল, কত কি বলার ছিল, বোঝার ছিল। কে দেবে তার জবাব? কোথায় মিলবে তার উত্তর?
তার জানাযার দৃশ্য দেখে আমি বারে বারে কেঁদেছি। আবেগে আপ্লুত হয়েছি। হাজার হাজার মানুষ। কিংবা হয়তো লক্ষ ছাড়ানো জনতা। সবার চোখে জল।বুক ভাঙ্গা কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী। এই প্রথম টের পেলাম, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কেবল আমার একার নয়। লক্ষ লক্ষ জনতার। মমতার, ভালবাসার।
আরেকজন আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে কত হন্য হয়ে খুঁজেছি, পাই নি। অনেক আলেমকেই হয়তো ভাল লাগে, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের কথা, কাজে হতাশ হতে হয়। তাদের মনোভাব, যুক্তিহীন আবেগে ভেতরে বিরাগ জন্মে। স্যারকে সবসময় খুব মিস করি। স্যার কথা বলতেন মেপে মেপে। তাতে কারও প্রতি কোন বিরাগ থাকতো না, অহংকার থাকতো না। বেফাঁস, এলোমেলো, অদূরদর্শী কথা বলা থেকে স্যার নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতেন। ভারসাম্যপুর্ন আচরণ, কথা-কাজে তিনি ছিলেন অনন্য। তাই তো বিজ্ঞ আলেম থেকে সাধারণ শিক্ষিত, নব্য তরুণ…স্যার অনায়াসে ঠাঁই করে নিতেন সবার হৃদয়ে।
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মত মানুষ ক্ষণজন্মা। তারা পৃথিবীতে বারবার আসেন না। এক জীবনে এমন মানুষের সন্ধান মেলে হয়তো দুই এক বার। আমি সৌভাগ্যবান, এই জীবনে তার মত মানুষের কর্মময় জীবনের সংস্পর্শে এসেছি। আমি হতভাগা, সে সৌভাগ্য বড় দ্রুতই হারিয়ে ফেলেছি। আজ তার দুটো বই কিনে আনলাম। দোকানীর সাথে কথায় কথায় স্যারের প্রসঙ্গ এলো। মনের অজান্তেই আবার চোখ ভিজে এলো। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল, অব্যক্ত বেদনায়। অনেক কষ্টে কান্না চাপতে হলো।
দয়াময়ের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে স্থান দেন। আমাদেরকেও যেন সেই পথের পথিক করেন। আমিন।