ইসলামের ভেতরে যে চিন্তার ঐতিহ্য আছে তার দিকে নজর ফিরাতে হবে ও তাকে পাঠ করতে হবে। আমাদের ইতিহাসে যেসব আলেমগণ সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি,রাষ্ট্র, মানবিক-সম্পর্কের বিবিধ অভিব্যক্তি নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের পুনর্পাঠ ও পুনর্বিচার জরুরি। এই পাঠের উদ্দেশ্য ত্রিবিধ ।
১) তারা কী কী নিয়ে চিন্তা করেছেন
২) কীভাবে চিন্তা করেছেন
৩) তারা তাদের সমকালের অপরাপর চিন্তাকে উপস্থাপন করেছেন কি-না ও ইসলামের বিশ্ববীক্ষার সাথে সেগুলোকে কীভাবে সমন্বিত করেছেন বা বৈপরীত্য দেখিয়েছেন।
আমাদের কালকে ব্যাখ্যা ও প্রভাবিত করতে পূর্বসূরি মুসলিম চিন্তকগণ আমাদের অনুপ্রেরণা এবং চিন্তা ও প্রয়োগপদ্ধতির দিশা দিতে পারেন। পাশ্চাত্যে জগতে প্রায় সব বিষয় নিয়েই বিপুল পরিমাণ চিন্তা হয়েছে। ইসলাম কিন্তু কোন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নয়, এখানে অপর চিন্তাকে গ্রহণ করবার সুযোগ আছে যদি না তা ইসলামের মূল স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। সমাজ-রাজনীতি ও ইহজাগতিক কায়কারবার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ফুকো-দেরিদা, দুর্খেইম, হেবারমাস,আগামবেনকে ব্যবহার করা যেতেই পারে, অসুবিধা নেই।
কিন্তু তাতে পরিপূর্ণ অবগাহন, একীন ও নির্ভরশীলতায় সমস্যা আছে। ইসলাম নিজের কাঠামোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই অপর কোন চিন্তাকে গ্রহণ করে। কারো পছন্দ হোক বা না হোক, ইসলাম পরকালকেই সামনে রেখে ইহকালকে সাজাতে বলে। ইহকালকে বুঝতে, ইসলামের ভাষায় যাকে ‘জাহিলিয়াত’ বা ‘জাহালাত’ বলে তাকেও বুঝতে, পশ্চিমা-অপশ্চিমা নানা চিন্তকদের ব্যবহার করতে তো পারিই। কিন্তু সামগ্রিক কেবলা যেন ওই মক্কামুখী পশ্চিমই হয়, অপরাপর পশ্চিম যেন না হয়, এই নজর ইসলামের থাকে।
বিশ্ববীক্ষায় না মিললেও ‘আধুনিক চিন্তার’ অনেক কিছু ইসলামের সমাজ বা রাজনীতি ভাবনার সাথে মিলে যেতে পারে বা ইসলামের অনেক অনুষঙ্গও মানুষের কাছে ঐশী বরাত ছাড়াও চিন্তার উৎপাদ হিসেবেও উপস্থিত হতে পারে। মানুষের চিন্তাশক্তি দিয়েও সত্যের অনেক আঁচ পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া, নবুয়তী চিন্তার আঁচ জগতের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে আছে কেননা প্রত্যেক জাতি/সম্প্রদায়ের কাছেই নবী এসেছিলেন (সুরা ইউনুস-৪৭) বলে বলা হয়েছে। সেই আঁচের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী সংস্পর্শে অনেকেই ‘শুদ্ধ চিন্তা’ করতে পারে। মানুষ যেহেতু আকলমান্দ প্রজাতি, তাই তার চিন্তাশীলতার ফল বা বুদ্ধি ও উপলব্ধির নির্ণয় হিসেবেও অনেক কিছু তার সামনে উদ্ভাসিত হতে পারে।
মানে, ইসলামে চিন্তায় মোলাকাত অস্বীকৃত হওয়ার কথা না। তবে, ইসলামের তাওহীদ-রিসালাত-আখিরাতের যে কাঠামো সেই কাঠামোর ভেতর থেকে যে শব্দাবলী বা পরিভাষা উদগত হয়েছে, সেই পরিভাষাকে ব্যবহার করে অন্য আধুনিক চিন্তাকে সমুন্নত করা ও সাবস্ক্রাইব করাকে ইসলামি চিন্তায় সমস্যাজনক মনে করা হয়। অনেক চিন্তাই আছে যেগুলোকে ইসলাম তার নিজস্ব বলে দাবি করে, যদিও সেইসব চিন্তার ঐতিহাসিকতা আছে এই অর্থে যে, ইসলাম কোন নতুন ধর্ম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে না।
ইসলামি চিন্তাকে প্রাসঙ্গিক ও প্রতাপশালী করতে হলে ইসলামের ভেতরে যে চিন্তাস্রোত আছে, তাঁকে তো আনতে হবে সামনে এবং তাকে এ কালের মানুষের বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপনের জরুরতও আছে । ‘ইসলামগন্ধী আধুনিকচিন্তা’ বা ‘আধুনিকতান্ধী ইসলাম চিন্তা’ তো দেখিই আমরা। এটির সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলাপ দরকার ।
তবে, ইসলামের নেটওয়ার্ক অব কনসেপ্ট দিয়ে গ্রহণযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য, ইসলামী-অনইসলামী, পছন্দনীয়, অপছন্দনীয় বোঝা সম্ভব। আর, ইসলাম কিন্তু উৎস নির্বিশেষে চিন্তার অন্তর্নিহিত গুণকে মূল্য দেয়, যেমন সহিহ বুখারিতে উল্লেখিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা.) আয়াতুল কুরসির সত্য ফজিলত জেনেছিলেন শাইতানের কাছ থেকে এবং এ প্রসঙ্গে নবি (সা.) বলেছিলেন, “সে তোমাকে সত্যই বলেছে, যদিও সে মহা মিথ্যাবাদী।”
আবার, সুরা হুজুরাতের ৬ নং আয়াতে খবর ও খবরের উৎস দুটোকেই যাচাই করার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানকে তার অন্তর্নিহিত মূল্যে যাচাই এবং প্রয়োজনবোধে খবর দাতা বা উৎপাদনকারীর আদত ও আদালাত নিরীক্ষণও ইসলামের জ্ঞানবিচার পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়াও, জ্ঞান (আল-কালিমাতুল হিকমাহ) মুমিনের হারানো দৌলত (সুনান আল তিরমিজির হাদিস) এটাও কিন্তু মনে রাখার মতো বিষয়; বিশ্বের যেকোন স্থানে যে জ্ঞানশাস্ত্র বা বিশ্লেষণ পদ্ধতির জন্মই হোক, তা থেকে উপকার হাসিল করা মুমিন তার জন্যে প্রয়োজনীয় ভাবে।
নিজেদের সমাজকে বিনির্মাণ করতে কোরআন-হাদিস ও তার চিন্তন-কাঠামোকে ব্যবহার করে সমাজ-রাষ্ট্র, সমাজ-সভ্যতা নিয়ে যা যা চিন্তা করা হয়েছে এবং একালের বিশ্বচিন্তাকেও বিবেচনায় রেখে ও বিচার করে আমাদের সামনে এগুনোর জোর প্রস্তুতি নিতে হবে। এবং একটা প্রজন্মও গড়ে তুলতে হবে যারা এভাবে উম্মাহকে এগিয়ে নিবে রাহবার হয়ে। ইসলাম শুধু আল্লাহ ও রাসুলের কথাতেই “শুনলাম আর মানলাম” বলে আত্মসমর্পণ করতে বলে, আর জগতের সব ব্যাপারে, প্রায় সবক্ষেত্রেই কোন না কোন মাত্রায় বিচারমূলক পদ্ধতি গ্রহণের কথা বলে।