‘ইসলাম-ইসলামী’ এই পরিভাষাগুলো ব্যাপকার্থে। ইসলাম যেমন সংকীর্ণ না, ‘ইসলামী’ পরিভাষাটিও তেমন সংকীর্ণ না। আমাদের চোখ দিয়ে যা দেখি, মোটাদাগে সবকিছুই ইসলামিক; যদি না সেটা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। প্রতিদিন সূর্য উঠে, সূর্য থেকে মুসলিম-অমুসলিম সবাই উপকৃত হয়। এই সূর্যের নামে কুরআনের একটা সূরা আছে। সূরা আশ-শামস। তাহলে সূর্যটা শুধু যে ইসলামিক তাই নয়, সেটা কুরআনিকও বটে।
রাতে চাঁদ উঠে। কবিরা চাঁদ নিয়ে কবিতা লিখেন। সাহাবীরা নবীর সৌন্দর্যকে [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] তুলনা করেছিলেন চাঁদের সাথে। ঐদিকে বাঙ্গালি কবি সুকান্ত চাঁদকে দেখেছেন ক্ষুধার্তের ঝলসানো রুটির সাথে। এই চাঁদ নিয়েও কুরআনে একটা সূরা আছে। সূরা ক্বামার। তারমানে চাঁদটা যেমন ইসলামিক, তেমনি কুরআনিক।
তাই বলে, চাঁদের নামের সাথে, সূর্যের নামের সাথে কি আমরা বলবো ‘ইসলামি সূর্য’ কিংবা ‘ইসলামি চাঁদ’? না, আমরা এমনভাবে বলে এগুলোকে ‘সংকীর্ণ’ করবো না। ঠিক তেমনি, আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি- গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, ঘর-বাড়ি, চেয়ার-টেবিল সবকিছুই মোটাদাগে ‘ইসলামিক’। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- “তিনিই যমিনে যা আছে, সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা বাকারা- ২:২৯]
তারমানে বুঝা গেল, পৃথিবীতে যা যা আছে, সবকিছু আমাদের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন; যদি না তা ‘হারাম’ হয় তাহলে তা ভোগ করা আমাদের জন্য অনুমোদিত। সূর্য ইসলামিক, কিন্তু সূর্যকে পূজা করা শিরক। গাছপালা ইসলামিক, কিন্তু গাছপালার পূজা করা শিরক। মাটি ইসলামিক, কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি শিরক। কলম ইসলামিক, এই কলম দিয়ে যখন আল্লাহর নাফরমানি করা হবে, সেটা শিরক-কুফর।
অর্থাৎ, মৌলিক প্রায় সকল বস্তুই ইসলামিক (‘প্রায়’ শব্দটি আছে)। আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি, সেটার মৌল হল ইসলামিক; পদ্ধতির বেলায় সেটা হয় হালাল নতুবা হারাম, হয় ঈমানের স্বপক্ষে নতুবা বিপক্ষে।
আমরা উদাহরণস্বরূপ কবিতার কথাই বলি। যেসব কবিতার মধ্যে শিরক-কুফর আছে, মেয়েদের শরীরের রগরগে বর্ণনা আছে, হারাম বস্তুর প্রশংসা-স্তুতি আছে সেগুলো অনৈসলামিক। তার বিপরীতে যেসব কবিতায় তাওহীদের কথা আছে, প্রকৃতির নির্মল বর্ণনা আছে, মানুষের সত্য-সুন্দর জীবনাদর্শ ফুটে উঠেছে সেগুলো ইসলামিক। সেই কবিতা যদি কোনো কাফিরের কলম থেকেও আসে, তবুও সেটা ‘ইসলামিক’।
বিশ্বনবীর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] সমসাময়িক আরবের একজন কবি ছিলেন। তার নাম ছিলো উমাইয়্যা ইবনু আবুস সালাত। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি।
একদিন বিশ্বনবীর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] তাঁর এক সাহাবীকে বললেন, “তুমি আমাকে উমাইয়্যার কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শুনাও।” সেই সাহাবী নবীকে কবিতা শুনাতেই লাগলেন। একপর্যায়ে দেখা গেল, বিশ্বনবীর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] উমাইয়্যার একশোটি কবিতা আবৃত্তি শুনেন। [সহীহ মুসলিম: ৫৭৭৮]
ঐ কাফির কবি তো ইসলাম গ্রহণ করেননি, তবুও বিশ্বনবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] তার কবিতা শুনেন কেন? কারণ, ঐ কবির কবিতায় তাওহীদের বাণী ছিলো। বিশ্বনবীর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেন, “সে তো প্রায় মুসলমানই হয়ে গিয়েছিল!” [সহীহ মুসলিম: ৫৭৮২]
তারমানে আমরা বুঝলাম, ইসলামিক/ইসলামি পরিভাষাটি ব্যাপকার্থে। এই পরিভাষাটি আমাদেরকে সংকীর্ণ হতে শেখায় না, আমদেরকে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে বলে না। ইসলাম আমাদেরকে শেখায় উদারচিত্তে সবকিছু গ্রহণ করতে; যতক্ষণ না সেটা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। তাহলে আমরা কি বলতে পারি- যা কিছু অনৈসলামিক নয়, তাই ইসলামিক?