এই এক সমস্যা। ইদানিং কারো সাথে পরিচয় হলে, অনলাইনে বা অফলাইনে, অনেকে প্রশ্নটা করে:
-আপনি কোন দল করেন?
-আমি কোন্দল করব কেন! কোন্দল করা ভালো না।
-না মানে, আপনি কোনো দলের সাথে জড়িত কিনা?
-জ্বি। আমি মুসলমান।
-সেটা তো আমরা সবাই-ই। বলছিলাম, আপনি কোন সংগঠন বা আদর্শের অনুসারী?
-ভাই, আমার সংগঠন ইসলাম। আমি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কন্সেপ্টে বিশ্বাসী।
বেশীরভাগ প্রশ্নকর্তা এই উত্তরে সন্তুষ্ট হন না! সম্ভবত কোনো একটা দলের নাম শুনতে তারা পছন্দ করতেন। তর্ক করা যেতো। তাদের ভাবখানা এমন, উনি তো শুধু মুসলমান। উনার সাথে কী তর্ক করব!
তর্ক বর্তমানে আমাদের জাতীয় সমস্যা। সবাই তর্ক করতে চায়। জিততে চায়। এটাকে ঈমানী দায়িত্ব মনে করে। কারো ভুল দেখলে সংশোধন করা উচিৎ। তবে এটার জন্য তর্ক কোন ভালো উপায় না। দাওয়া আর তর্কের পার্থক্যই এরা বুঝে না। যদি সত্যিই আপনার নিয়ত হয় অন্যের সংশোধন- তর্ক নয়, আলোচনা করুন। তাদের জন্য দুআ করুন। মধ্য রাতের মোনাজাতে তাদের জন্য চোখের পানি ফেলেন।
আর পারলে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন। আস্থা অর্জন করেন। দেখবেন, মানুষ আপনার কথা শুনবে। ধর্ম নিয়ে আমিও আলোচনা করি। তবে সবার সাথে না। কাছের কিছু মানুষের সাথে। শেখার জন্য করি। শুধু শেখানোর জন্য নয়। ফিতনা সৃষ্টি করাকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমি সে ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী ঘরের জিম্মাদার, যে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্বেও ঝগড়া পরিহার করে। [আবু দাউদ: ৪৭২৫] তর্কের চেয়ে জান্নাতের ঘরটা আমার কাছে বেশি প্রিয়।
তর্কশাস্ত্রের সবচেয়ে বিপদজনক শাখা ইলমুল কালাম। অর্থাৎ আক্বীদাগত বিষয়ে যুক্তিভিত্তিক তর্ক।
এটা এতটাই বিপদজনক যে, প্রথমদিকের আলেমগন নিষিদ্ধ মনে করতেন। যারা ইলমুল কালাম চর্চা করে; ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ প্রমুখ (রঃ) তাদেরকে ‘যিন্দিক’ বলেছেন। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটাতে বলেছেন।
পরবর্তী আলেমগন বৃহত্তর কল্যাণে কিছু শর্তসাপেক্ষে কালামশাস্ত্র চর্চা করেছেন। কিন্তু এটা আলেমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে সবাই ফক্বীহ, সবাই মুজতাহিদ। আক্বীদাগত বিষয়ে তর্ক দেখলে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। অথচ কুতর্ক থেকে দূরে থাকাটাও দ্বীনের কাজ। আমরা বিভেদের আগুন নিভাতে না পারি, অন্তত যেন তাতে বাতাস না দেই।
একটা ফল ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়তে থাকে, যতক্ষণ সবুজ থাকে। পেকে গেলে পচন শুরু হয়। আমাদের অন্তরও ফলের মত সবুজ থাকা দরকার। প্রাকটিসিং মুসলিমদের অন্তরে শয়তান কখনো কখনো এই ওয়াসওয়াসা তৈরি করে। তারা পেকে যায়। তখন তারা ভাবতে শুরু করে, তারাই ঠিক। বাকিরা ভুল। অথচ কে যে সিরাত্বাল মুস্তাক্বীমে আছে, তার ফয়সালা হবে হাশরে। তাই উমর (রা:)-সহ অন্তত ৩০ জন সাহাবী নিজেদের ব্যাপারে মুনাফিকীর ভয় করতেন। এই ভয় অন্তরে থাকা সাহাবাদের সুন্নাত।
আমাদের অন্তরেও এই ভয় থাকা জরুরি। অথচ আমরা কত নিশ্চিন্ত! আসুন, অন্তর সবুজ রাখার চেষ্টা করি। সকল সালাতে, সব মোনাজাতে প্রাণের আকুতি দিয়ে বলি- ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাক্বীম। আমাদেরকে সরল পথ দেখান। মৃত্যু পর্যন্ত এই দুআ করে যাই। এটাই হোক আমাদের মানহাজ।
অন্যের ভুল ধরায় মজা আছে। নিজের মাঝে ওই ভুল নেই, ভেবে একধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। হওয়ার কথা ছিলো উল্টোটা। যার ভুল ধরা হয়েছে, তাঁর উচিৎ ছিলো আত্মতৃপ্তি পাওয়া। একটা ভুল তো অন্তত সংশোধন করা গেলো। আসেন, এবার অন্যকে বাদ দিয়ে একটু নিজেকে নিয়ে বসি। প্রতিদিন অন্তত একটা নিজস্ব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ভাবি। সেটা সংশোধন করি। প্রতিদিন না পারলে অন্তত প্রতি সপ্তাহে, মাসে। মির্জা গালিবের একটা পংতি অনুবাদ করেছিলাম, কবি নিজেকে সম্বোধন করে বলেছেন:
উমর ভার গালিব ওহি গালতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।
জীবনভর গালিব তুমি, এই ভুলটাই করে গেলে
ধূলো ছিলো চেহারাতে, আয়না সাফ করে গেলে।