আল্লাহ তাআলা কুরআনের মধ্যে পিতা-মাতার হক সম্পর্কে সন্তানের প্রতি ছয়টি উপদেশ করেন। আজ এই চাকচিক্যময় ভুবনে বিচরণ করার পিছনে কার অবদান রয়েছে? নিঃসন্দেহে মাতা পিতা ছাড়া আর কেউ নয়। আজ আমরা যে যেই অবস্থায় আছি, এর পিছনে একমাত্র আমাদের মাতা-পিতারই অবদান রয়েছে। তাদের জন্যই আজ আমরা এই ধরণীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি। আজ মাতা পিতার জন্য এই পৃথিবীর মুখ দেখতে পেরেছি।
মা যখন সন্তান প্রসব করে তখন তার ব্যথার পরিমান থাকে ৫৭+ ইউনিট । আর একজন স্বাভাবিক মানুষ সর্বোচ্চ ব্যথা সহ্য করতে পারে ৪৫ ইউনিট। কিন্তু এই ৪৫ ইউনিট ব্যাথা সহ্য করার চাইতে মৃত্য যন্ত্রনা শ্রেয়। এমনকি অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে সহ্য করতে না পেরে। কিন্তু ৫৭+ ইউনিট যন্ত্রনা সহ্য করেও আমাদের মায়েরা কখনো আত্মহত্যার কথা ভাবেনা সন্তানের প্রিয় মুখ দেখবে বলে।
কিন্তু যখন আমরা একটু বড় হয়, যৌবনে পা রাখি; তখন আমরা আমাদের মাতা-পিতাকে ভুলে যাই। নানা ধরনের কষ্ট দিয়ে থাকি। অনেক সময় বৃদ্ধাশ্রমে পর্যন্ত–ও দিয়ে থাকি। এমন অনেক ঘটনা আছে যে, মাতা পিতাকে বৃদ্ধ বয়সে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
যারা মাতা-পিতার প্রতি অমনোযোগী, মাতা-পিতার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলে, মাতা-পিতার কথার আওয়াজের উপর তাদের কথার আওয়াজ থাকে, তাদের জন্য আমার আজকের এই লেখা। আল্লাহ তাআলা পিতা মাতার হক সম্পর্কে তাদের সন্তানাদির উদ্দেশে কুরআনী ভাষায় ছয়টি নসিহত করেছেন।
১. وَبِالوٰلِدَينِ إِحسٰنًا পিতা-মাতার সাথে সদা সদ্ব-ব্যবহার করো:
যে–মা দশ মাস দশ দিন নিজের গর্ভে ধারণ করে আমাদেরকে এই পৃথিবীর মুখ দেখেয়িছেন। শুধু তাই নয়, একদম ছোট থেকে নিয়ে যে–অবস্থায় আছি, এই অবস্থায় নিয়ে আসার পেছনে অনেক পরিশ্রম করেছেন।
অবুঝ থাকা অবস্থায় বিছানায় প্রস্রাব করে দিতাম। কিন্তু মা সানন্দের সহিত তা পরিষ্কার করতেন। প্রচন্ড শীতের সময় যখন প্রস্রাব করে দিতাম, মা ওই প্রস্রাব করা জায়গায় নিজে শায়িত হয়ে আমাকে–আপনাকে শুকনো জায়গায় শুয়াতেন। এমন মাতা-পিতার প্রতি সবসময়–সর্বাবস্থায় সদ্ব্যবহার করতে বলেছেন। ভালো ব্যবহার করতে বলেছে।
২. فَلا تَقُل لَهُما أُف তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না:
যখন মাতা–পিতা বার্ধক্যে(বৃদ্ধবস্থায়) উপনীত হয়, তখন তারা ছোট শিশুর মতো আচরণ করতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বায়না করে। বিভিন্ন দাবি–দাওয়া করে। তখন আমরা তাদের এই দাবি-দাওয়া শুনে, তাদের এই বায়না শুনে উফ শব্দটি বলবো না। যাতে তারা উফ শব্দটি শুনে তাদের হৃদয় ব্যথিত না হয়। যাতে তারা কষ্ট না পায়। কেননা যখন আমরা শিশু পেয়েছিলাম তখন আমাদের দাবি-দাওয়ার শেষ ছিল না। কিন্তু মাতা পিতা এই দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য অফুরন্ত চেষ্টা করেছিলেন। কখনো বিরক্ত হতেন না।
কথিত আছে, একবার এক বৃদ্ধ পিতা তার সন্তানের কাছে শিশুদের মত বায়না করত। সন্তানটি তার পিতার শিশুসুলভ আচরণে বিরক্ত হয়ে যায়। সেটি বৃদ্ধ পিতা উপলব্ধি করতে পারে। সে একবার তার সন্তানকে নিয়ে একটি বল সহ পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়।বৃদ্ধ লোকটি বলটিকে নিচে নিক্ষেপ করল ছেলেটি গিয়ে বলটিকে নিয়ে আসল। বৃদ্ধ লোকটি বলটি পুনরায় ছুড়ে মারলো পাহাড়ের নিচে। সন্তানটি পুনরায় বলটি কুড়িয়ে নিয়ে আসলো।
এভাবে পুনরায় করতে থাকায় সন্তানটি অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। বৃদ্ধ লোকটি এটি উপলব্ধি করতে পেরে হেসে বলল, যখন তুমি ছোট ছিলে, তখন তুমি এ পাহাড়ের চূড়ায় থেকে বল নিক্ষেপ করতে; আর আমি প্রতিবারের মত বলটি কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আমি কখনো বিরক্ত হইনি।(এই গল্পটি আরিফ আজাদ ভাইয়ের লেখিত বইয়ে(মা মা মা ও বাবা) পড়েছি।
৩.ٍّ وَلا تَنهَرهُما তাদেরকে ধমক দিও না:
যেখানে উফ শব্দটি বলা পর্যন্ত নিষেধ সেখানে ধমক দেওয়া তো দূরের কথা। এরপরেও আল্লাহ তায়ালা কোরআনে পাকের এরশাদ ফরমান, তোমরা তাদেরকে ধমক দিও না। কারণ কিছু হতভাগা সন্তান আছে, যারা মাতা-পিতাকে কথায় কথায় ধমক দেয়। পিতা-মাতার প্রতি অসন্তুষ্টি দেখায়। আল্লাহ তাআলা এটি জানেন। তাই উফ শব্দ বলা বারণ করা সত্ত্বেও পুনরায় ধমক দিয়ে কথা বলার জন্য নিষেধ করেছেন।
কথিত আছে, এক সন্তান তার পিতাকে মারতে মারতে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর লোকটি তার সন্তানকে বলল,তুমি থামো! কেননা আমি–ও আমার পিতাকে মারতে মারতে এতোটুক পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম। আমরা আমাদের মাতা-পিতাকে কখনো ধমক দিয়ে কথা বলবো না। আমাদের স্বরকে তাদের স্বরের নিচে রাখবো।
৪. وَقُل لَهُما قَولًا كَريمًا এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা:
তাদের সাথে নম্র আচরণ করো।তাদের সামনে কখনো নিজেকে কঠোর করিও না। কেননা তোমার উপর তোমার পিতা–মাতার সন্তুষ্টি তো আল্লাহর সন্তুষ্টি।
আর যদি তোমার উপর তোমার পিতা–মাতা নারাজ থাকে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা ও তোমার উপর নারাজ থাকবে।
৫. وَاخفِض لَهُما جَناحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحمِ তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও:
মাতা-পিতার সামনে নিজেকে এমন ভাবে উত্থাপন করো, যেন তুমি তাদের কাছে দুর্বল। তাদের কথার উপর কথা বলার সামর্থ্য টুকু নেই।
৬. وَقُل رَبِّ ارحَمهُما كَما رَبَّيانى صَغيرًا বল, হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন:
এটি মাতা পিতার জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে। কেননা, তারা শৈশবে আমাদের জন্য খুব কষ্ট করেছেন। আমরা তাদের বিন্দুমাত্র ঋণ পরিশোধ করতে পারব না। কিন্তু আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে উভয়ের জন্য দোয়া করতে পারব। তাদের উভয়ের জন্য কল্যাণ কামনা করতে পারব।
হযরত আব্দুল্লাহ্ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি প্রশ্ন করলাম, সবচাইতে উত্তম আমল কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যথাসময়ে নামাজ আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি পুনরায় আবার জিজ্ঞাসা করলাম অতঃপর কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী–৫৯৮০)
তাই আমরা মাতা পিতার সাথে সবসময়ই সদ্য ব্যবহার করব। বরং এটি একটি উত্তম আমলও।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন–আমীন!
দলিল: সুরা বানী-ইসরাঈল- ২৩ ও ২৪