নন্দনতত্ত্ব এক সুগভীর চেতনা। অনন্য উপলব্ধি। নন্দনতত্ত্বের অন্তঃরাত্মায় সুন্দরের রূপময় উপস্থিতি, ভাবের সুগভীর পরিপূর্ণতা। আবার প্রকাশের সুতীব্র আকুতি। নন্দনতত্ত্ব কোন কোন পণ্ডিতের মতে, অনির্বচনীয় হলেও তার স্বরূপ অনাস্বাদিত নয়। কেউ বলেন ‘Aesthetics’ কেউ বলেন ‘সৌন্দর্যশাস্ত্র’, কেউ বলেন ‘বীক্ষা শাস্ত্র’। নামের সীমার বাইরে নন্দনতত্ত্ব বৃহত্তর এক উপলব্ধি।
নন্দনতত্ত্বের তাৎপর্য:
জগতের কোন কিছু আমাদের চোখে সুন্দর হয়ে প্রতিভাত হলে আমরা তাকে ‘নান্দনিক’ বা অনবদ্য বলি। কারো কোন কাজ আমাদের অবাক করলে, আমরা তার সৌন্দর্য ও নৈপুণ্যে অবাক হই। কিন্তু সৌন্দর্যের সংজ্ঞাপ্রদান সহজ কাজ নয়। বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ, শিল্পকলাতাত্ত্বিক অঁদ্রে মালরো (১৯০১ – ১৯৭৬) ‘Psychologie de l’art’ (শিল্পের মনস্তত্ত্ব) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নন্দনতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল, সৌন্দর্য। অথচ নন্দনশাস্ত্রের সবচে’ কঠিন বিষয়ই সৌন্দর্যের তাৎপর্য নির্ধারণ করা।’
ফরাসি চিত্রশিল্পী ও শিল্প গবেষক জেন সাইমন বার্থলেমি ‘TRAITE D’ESTHÉTIQUE’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা যদি প্রাচীন দার্শনিকদের দ্বারে গিয়ে ধর্ণা দেই, তাহলে বুঝতে পারি, সৌন্দর্য হলো সত্য ও উত্তমের মত। বিবেক, যুক্তি ও আচারের অতি ঊর্ধ্বে। এজন্যই সুন্দরের কোন সংজ্ঞা নেই। সুন্দর জিনিসের মধ্য দিয়েই সৌন্দর্য ফুটে উঠে।’
ড. মুহাম্মদ আলি আবু রাইয়ান ‘ফালসাফাতুল জামাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সৌন্দর্যের আলোচনা করতে গেলে এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই, যেখানে কোন সংজ্ঞা চলে না। সেটা হল অনুভূতি ও আবেগের জগত। যুক্তি আর বিবেকের জগত নয়।’
সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এতটা জটিলতা থাকার কারণ, সৌন্দর্য হলো একটা মর্মগত দিক। আর এটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, নিজে নিজে তার কোন অস্তিত্ব রূপ পায় না। অন্যের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব গঠিত হয়। এজন্যই আমরা কোন সৌন্দর্যকে পৃথক অস্তিত্বে দেখতে পাই না। দেখতে পাই মানুষ, বস্তু, কর্ম ও আচার উচ্চারণের ক্ষেত্রে। সেটা এক জান্তব বিষয়। সকল ক্ষেত্রেই তার প্রবেশাধিকার। বস্তুগত বিষয় হোক বা মর্মগত। কখনো সৌন্দর্য থাকে মূল জিনিসের তাৎপর্যের মধ্যে, কখনো বা আবার কোন জিনিসের বাহ্যিক আবরণে। বস্তুর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পূর্ণতা নির্ভর করে এর উপর।
যেহেতু সৌন্দর্য একটা মর্মগত আপেক্ষিক বিষয় তাই কোন বর্ণনা, মান ও পরিমাণের নির্দিষ্ট নিগড়ে একে বাঁধা যায় না। এর সংজ্ঞা অনির্ণায়িত থাকার পেছনে আরেকটি কারণ কার্যকর রয়েছে, নান্দনিকতার মান ও স্তর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মানুষের রুচি ভিন্নতা। শিল্পকলাকেও নন্দনতত্ত্বের একটা ক্ষেত্র বলে ধরা হয়। কিন্তু শিল্পকলা মানেই কিন্তু নন্দনতত্ত্ব নয়। অনেক শিল্পে নান্দনিকতা থাকে না। কখনো শিল্পে কদর্যতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। কখনো আবার শিল্পী নিজেই নন্দনতত্ত্বের ধার ধারেন না। অনেকেই শিল্পকলা আর নন্দনতত্ত্বের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অনেক লেখায়ই এই দুই প্রকল্পের মধ্যে কোন ফারাক উল্লেখ করা থাকে না। অনেক বই লেখা হয় নন্দনতত্ত্বের নামে। অথচ তাতে শিল্পকলার আলোচনা ছাড়া আর কোন আলোচনা পাওয়া যায় না।
এর আগাম কারণও অবশ্য বিদ্যমান আছে। অনেক দার্শনিক শিল্পকলাকেই কেবল নন্দনতত্ত্বের একমাত্র প্রয়োগক্ষেত্র মনে করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দার্শনিক হেগেল (১৭৭০ – ১৮৩১)। তিনি বলেছেন, ‘নন্দনতত্ত্বের পরিভাষাগুলো আমি নান্দনিক শিল্পকলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতি। কারণ নন্দনতত্ত্বের মূল আলোচ্যবিষয় হল শিল্পের নান্দনিকতা।’ কোন সন্দেহ নেই যে, শিল্প ও নান্দনিকতার সাথে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক বিদ্যমান। শিল্পের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু কখনো শিল্পে সৌন্দর্য আসে, কখনো আবার আসে না। তাছাড়া নন্দনতত্ত্ব শিল্প থেকে নির্মুখাপেক্ষী হতে পারে না কখনোই। নন্দনের বিস্তৃত ময়দানই হলো শিল্প। কিন্তু প্রকৃতি ও মানুষের আরো যেসব ক্ষেত্র রয়েছে, সেখানেও নান্দনিকতা বিদ্যমান।
যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষা সংস্কারক জন ডুয়ি (১৮৫৯ – ১৯৫২) শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্বের মাঝে সম্পর্ক স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ দুয়ের মাঝে সম্পর্ক হলো, শিল্প একটা সৃজনশীল কাজ। আর নান্দনিকতা হল এক ভাললাগার অনুভূতি।’
ইসলামে নান্দনিকতা:
ধর্ম ও নান্দনিকতার মাঝে সম্পর্ক নিয়ে যারা আলোচনা করেছেন, তারা এ দুয়ের মাঝে সম্পর্কের কোন নির্দিষ্ট মানদণ্ড দাঁড় করাতে পারেননি। অনেক গবেষক মনে করেন, নান্দনিকতা একমাত্র ধর্ম থেকেই আগত। আরেকদল মনে করেন, নন্দনতত্ত্বের সাথে ধর্মের কোনই সম্পর্ক নেই। দুটিই প্রান্তিক বক্তব্য। বক্তাগণ হয়ত চূড়ান্ত ধর্মনিরেপেক্ষ, অথবা যাজকশ্রেণীর। আমরা এখানে ধর্ম হিসেবে শুধু ইসলাম সম্পর্কে কথা বলবো। ইসলাম মানব, জগত আর জীবন সম্পর্কে যে ধারণা দেয়, তা সুস্পষ্ট। বৈশ্বিক অস্তিত্ব, উপাসনা, মানুষ আর জীবনের মধ্যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে ইসলামের দৃষ্টিতে। আর এসব কিছুর পূর্ণতায় বিশ্বাসী ইসলাম। পূর্ণতা কখনোই সম্ভব নয় নান্দনিকতা ব্যতীত। নান্দনিকতার ব্যাপক অর্থই আমাদের উদ্দেশ্য। নন্দনতত্ত্বের অপূর্ণাঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্থ অর্থ, যা নান্দনিকতাকে কেবল সীমাবদ্ধ মনে করে শিল্পকলা, কাব্য, সাহিত্য আর সুরের মধ্যে, সে অর্থ আমাদের উদ্দেশ্য নয় কোনমতেই।
কোরআনে স্বাভাবিকভাবেই কোন জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধ পরিভাষার কোন ধার ধারা হয়নি। বরং প্রাকৃতিকভাবেই সকলের বোধগম্য শব্দে উদ্দেশ্যকে উচ্চারণ করা হয়েছে। সৌন্দর্য, নান্দনিকতা বোঝাতে কোরআনে বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
- আল-জামাল
- আল-হুসন
- আল-বাহজাহ
- আয যী-নাহ প্রভৃতি।
সৌন্দর্যের কয়েকটি উপাদানের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল-হিলয়াহ (অলঙ্কার), আর-রীশ (পেখম), আয-যুখরুফ (সাজ-সজ্জা)। নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য প্রকাশের কয়েকটি মাধ্যমও উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। যেমন, আস-সুরুর (পুলক), আল-আজাব (বিস্ময়), লাজ্জাতুল আ’য়ুন (দৃষ্টিনন্দিত হওয়া) প্রভৃতি।
নান্দনিকতার প্রকৃতি কেমন হতে পারে, এটা কোরআনে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সূরা বাকারার ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল, ওর রং কী? মূসা আ. বললেন, ‘আল্লাহ বলছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।’ বোঝা যাচ্ছে, আনন্দ হল সৌন্দর্য দেখার পরের একটা অনুভূতি। আনন্দ পাওয়া অনেকাংশে সৌন্দর্যকে নির্ণয় করতে পারে। সৈয়দ কুতুব ‘তাফসিরে যিলালুল কোরআনে’ লিখেছেন, ‘এই গাভীর শক্তি, সৌন্দর্য, হ্রষ্টতা প্রতিভাত হওয়া ছাড়া কখনোই দর্শকের আনন্দ আসতে পারে না।’
জান্নাত সম্পর্কে সূরা যুখরুফের ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদের কাছে চক্রাকারে পরিবেশন করা হবে স্বর্ণের থালা ও পান পাত্র। সেখানে তা-ই আছে মন যা চাইবে, আর চোখ যাতে তৃপ্ত হবে। তোমরা তাতে চিরকাল থাকবে।’ এখানে দৃষ্টি-নান্দনিকতার কথা বলা হয়েছে। নয়ন তৃপ্ত হওয়াও সৌন্দর্য দেখার পরবর্তী একটা অনুভূতি। সূরা আহযাবে ৫২ নং আয়াতে আল্লাহর রাসূল সা.কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, ‘এরপর আপনার জন্যে কোন নারী হালাল নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয় যদিও তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে দাসীর ব্যাপার ভিন্ন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ের উপর সজাগ নজর রাখেন।’ বোঝা যাচ্ছে, কোন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়াও নান্দনিকতার একটি প্রকাশ।
এভাবেই বিভিন্ন আয়াতে আমরা মানব মনের উপর সৌন্দর্যের প্রভাবের আলোচনা পাই। কারণ মানব মনের উপর সৌন্দর্যের আলোকপাতের পরিমাণ থেকেই নান্দনিকতার মাত্রা নির্ণয় করা সহজ হয়। ইমাম গাজালী রহ. নন্দনতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক বিষয়ের নান্দনিকতা লুকিয়ে আছে তার উপযুক্ত পূর্ণতার মাঝে।’
উপরে কোরআন থেকে আমরা বাহ্যিক নান্দনিকতার উদাহরণ দেখালাম। ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ ‘রাওজাতুল মুহিব্বিন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘নান্দনিকতা দুই ধরণের। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ। অভ্যন্তরীণ নান্দনিকতা হল সত্ত্বাগতভাবে মানব স্বভাবের কাছে প্রিয়। যেমন, জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি, বদান্যতা, পবিত্রতা, সাহসিকতা প্রভৃতি। আর বাহ্যিক সৌন্দর্য হল অনেকটা আপেক্ষিক। অনেক জিনিসে আল্লাহ সেটা প্রদান করেছেন। অনেক জিনিসে তা প্রদান করেননি। অনেকটা প্রয়োজনের চেয়ে সেটা বেশিই, আল্লাহর নিকট। আর সেটা হল উত্তম সুর, সুন্দর চিত্র ইত্যাদি।’
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইমাম গাজালী নান্দনিকতাকে কোন জিনিসের পূর্ণতা হিসেবে অভিহিত করছেন আর ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহ বাহ্যিক নান্দনিকতাকে অতিরিক্ত বলছেন। তারা কোন সংজ্ঞা দিতে চাননি, একটা ধারণা দিতে চেয়েছেন, তাই উভয়েই উভয়ের অবস্থান থেকে ঠিক আছেন। ইমাম গাজালী নান্দনিকতাকে একটা অবিভাজ্য মৌল হিসেবে দেখেছেন। তাই বস্তুর পূর্ণতার জন্য তার কাছে নান্দনিকতা আবশ্যক। আর ইবনুল কায়্যিম দেখেছেন বিভাজ্য আংশিক হিসেবে। তাই তার কাছে এই বাহ্যিক নান্দনিকতা অতিরিক্ত। মূল্যবোধকেন্দ্রিক নান্দনিকতাই তার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইবনুল কায়্যিমের কথারও একটা যৌক্তিকতা আছে। কারণ, কেবল মূল্যবোধহীন নান্দনিকতাকে নান্দনিকতা বলে স্বীকার করলেও একে গ্রহণ করার কোন বৈধতা দেয়া হয়নি। সূরা বাকারার ২২১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, অবশ্যই মুমিন ক্রীতদাসী তার চেয়ে উত্তম।’ মূল্যবোধহীন নান্দনিকতাকে এখানে নাকচ করা হয়েছে।
উসুলে ফিকহের উলামায়ে কেরাম শরীয়তের বিধি-বিধানের উপর ব্যাপক অনুসন্ধান করে ইসলাম ধর্মে নান্দনিকতার অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। শরীয়তের বিধি-বিধান মানুষের উপর অবতীর্ণ হয়েছে সৃষ্টিজগত ও মানুষের স্বার্থ রক্ষার খাতিরে। কিন্তু মানুষের জন্য যা কিছুই অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজন বটে, তবে সব এক কাতারে না। এখানে স্তরভেদ আছে। সাধারণত
এগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে।
- ১. ‘জরুরিয়্যাত’ (যা মানুষের জীবনের জন্য আবশ্যকীয়)
- ২. ‘হাজিয়্যাত’ (আবশ্যক না বটে, তবে অতীব প্রয়োজনীয়)
- ৩. ‘তাহসিনাত’ (আবশ্যক ও প্রয়োজনীয় কোনটাই না, তবে পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের জন্য দরকার)
কিন্তু এখানে নান্দনিকতার স্থান কোথায়? উপমায় এর উত্তর আমাদের সামনে তুলে ধরছেন ইমাম গাজালী। তিনি বলছেন, ‘মানবদেহ দিয়েই উদাহরণ পেশ করা যাক। প্রথম প্রকারের উপমা হল, মাথা হৃদপিণ্ড কলিজা। দ্বিতীয় প্রকারের উপমা হল, চোখ হাত পা। আর তৃতীয় প্রকারের উপমা হল, ভ্রুর কিঞ্চিত বক্রতা, ঠোটের রক্তিমাভা, চোখের ডাগরতা ইত্যাদি। আরেকটি উদাহরণ মানুষের বাহ্যিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে। প্রথম প্রকার, পানি, বাতাস ও ন্যুনতম খাদ্য। দ্বিতীয় প্রকার, অষুধ, মাংস ও শাক-সবজি। তৃতীয় প্রকার, গাছের শ্যমলতা, আলোর ঔজ্জ্বল্য, ফুলের ঘ্রাণ, খাদ্যের স্বাদ ইত্যাদি।’
ইমাম শাতেবী রহ. তার বিখ্যাত ‘মুআফাকাত’ গ্রন্থে আরো খোলাসা করে বলেছেন। ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের স্বার্থগত দিক থেকে একে তিনি ভাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম প্রকার, ধর্ম ও কর্মের জন্য যেসব আবশ্যকীয়, সেটা হল পাঁচটি বিষয়ের সুরক্ষাপ্রদান।
- ১. ধর্ম
- ২. মানুষ
- ৩. বংশ
- ৪. সম্পদ
- ৫. বুদ্ধি।
দ্বিতীয় প্রকার হলো, সকল প্রকার ইবাদত উপাসনা, সামাজিক রীতি-নীতি ও আচার-আচরণ। তৃতীয় প্রকার হলো, উত্তম গুণাবলি অর্জন ও মন্দ গুণাবলি বর্জন।”
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, নান্দনিকতা হল ‘তাহসিনাত’ তথা তৃতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত। কোন বিষয়ে পূর্ণতার জন্য নান্দনিকতা জরুরী। শুধুমাত্র খাদ্য আছে, তাহলে আমাদের জীবনের প্রয়োজন মিটে যেত বটে, তবে খাদ্যে স্বাদ না থাকলে বিভিষিকাময় অবস্থা তৈরি হত প্রায়ই। এজন্য নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে দুটি কথা বলা যায়।
এক. কোন বিষয়ের মধ্যে নান্দনিকতা আছে বটে, তবে আবশ্যক ও প্রয়োজনীয় উপাদান নেই, তাহলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ের নিম্নতায় আছে। প্রকৃতপক্ষে এটা কোন সুন্দরই না।
দুই. আবশ্যকীয়তা ও প্রয়োজনীয়তার পূর্ণতার জন্যে প্রাথমিকভাবেই নান্দনিকতার পরিকল্পনা রাখা দরকার। একটা ভবন শুরু করার পূর্বেই যদি নান্দনিকতার পরিকল্পনা রাখা না হয়, তা আবশ্যিক ও প্রয়োজনীয় জিনিসের অস্তিত্ব প্রদানের পর আর নান্দনিক করা যাবে না ভবনকে। নান্দনিকতা বস্তুর গাঠনিক উপাদানই। বস্তুর চূড়ায় অবস্থান নান্দনিকতার। সাথে সাথে এই নান্দনিকতা আবশ্যকীয়তা ও প্রয়োজনীয়তার পর্যায়ে নেই।
চোখ দেখার জন্য আবশ্যক। চোখের সুস্থতা অবলোকনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। চোখের বর্ণ ও ডাগরতা নান্দনিক বিষয়। কিন্তু তা চোখের গঠনের ভেতরই প্রযুক্ত। তবুও দৃষ্টির কাজ, বর্ণ ও ডাগরতার উপর নির্ভরশীল বিষয় নয়। এভাবেই বোঝা যাচ্ছে, কোন কিছুর সৌন্দর্যের জন্য নয় কেবল, বরং পূর্ণতার জন্যও নান্দনিকতার প্রয়োজন আছে। মানুষ এই নান্দনিকতার জন্যই কাঙাল, বস্তুগত বা মর্মগত যে কোন বিষয়ে। কোরআন ও হাদিসের পরিভাষায় এই পূর্ণতারই আকুতি জানানো হয়েছে ‘ইতকান’ বা ‘ইহসান’ শব্দ ব্যবহার করে। ইসলাম সর্বদাই কামনা করেছে, মুমিন গা-ছাড়াভাবে ধর্মকে না মেনে গভীর ও পূর্ণতার অনুভবে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে পালন করবে।
সুতরাং ‘তাহসিনাত’ শব্দ ব্যবহার করার কারণেই যে এটার কোন মূল্য নেই অথবা এর উপর অন্যকে আগ্রহী করা যাবে না, বিষয়টা এমন না। বরং এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইসলাম যখন ‘ইতকান’ ও ‘ইহসান’এর পর্যায়ে পৌঁছতে বলে, বোঝা যায়, প্রথম দুই স্তর মানুষ পেরিয়ে যাক, এটাই ইসলামের কাম্য।