সলিমুল্লাহ খান সাম্প্রতিক বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় বক্তা ও টক-শো আলোচক/বিশ্লেষক, শিক্ষক ও লেখক । একাডেমিয়া ও মিডিয়া- এই দুই পরিসরেই তিনি একজন ব্যাপক পড়ুয়া ও মেধাবী বক্তা, বিশ্লেষক ও লেখক হিশেবে পরিচিতি পেয়েছেন। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং লেখক আহমদ ছফার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির যে ধারাটি বিকশিত হয়েছিল সলিমুল্লাহ খান সেই ধারাতে আশির দশক থেকেই বিচরণ করছিলেন।
সলিমুল্লাহ খান আন্তোনিও গ্রামসি চর্চা সূত্রে মার্কসবাদের ইতালীয় ঘরানায় দীক্ষিত হন সেই আশির দশকেই। নব্বই দশকের সূচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণের পটভূমিতে সলিমুল্লাহ খানের মত অনিসন্ধিৎসু মার্কসবাদীরা এক বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটে নিপতিত হন। কিভাবে তাদের অনুসৃত মার্কসবাদকে তারা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জায়েজ করবেন সেটা তাদেরকে বিচলিত করে তোলে। এই সময়ে ক্রমবিকাশমান পশ্চিমা উত্তরাধুনিক এবং উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তাস্রোত সলিমুল্লাহ খানদের মত বিশ্বাসী মার্কসবাদীদের মানস সংকট উদ্ধারে সহায়ক হয়ে ওঠে। অন্যান্যদের মত তিনিও এই ভাষানির্ভর, ভাষ্যনির্ভর, আপেক্ষিক ও বহুত্ববাচক মহাআখ্যান-নস্যাৎকারী অনুআখ্যানমূলক আধুনিকতার ক্রিটিক বা পর্যালোচনার মধ্যে তার নিদান খুঁজে পান। এই সময়কালে তিনি উচ্চশিক্ষা সূত্রে পশ্চিমে অবস্থানের সুবাদে তার ধ্রুপদী মার্কসবাদী বিশ্বাসকে এইসব পশ্চিমা পোস্টমডার্নিস্ট ও পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট চিন্তা দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
এরপরে তিনি যখন দেশে ফিরে আসলেন তখন তার এই উত্তরাধুনিক আবরণে আবৃত নয়া মার্কসবাদী বয়ান দিয়েই তিনি এদেশে আহমদ ছফার সদ্য মরণোত্তর চর্চায় একটা নবতরঙ্গ আনলেন। তার বক্তৃতা ও লেখায় উত্তরাধুনিক পরিভাষায় পরিবেশিত এই নব ছফা ভাষ্য সমকালীন সেক্যুলার অনুসন্ধিৎসু তরুণ মহলে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। তার অনেক গুণমুগ্ধ অনুরক্ত ও অনুসারী তৈরি হয় এদেশের উঠতি বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে। তিনি এদেশে সাহিত্য, মনোবিজ্ঞান-মনোসমীক্ষণ, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে পাশ্চাত্যে উদ্ভূত বিভিন্ন উত্তরাধুনিক চিন্তাকল্পের একজন নিবিষ্ট পড়ুয়া ও ভাষ্যকার হিশেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
যদিও অনেকসময় তার এই অতিতাত্ত্বিক পরিবেশনা ও পরিভাষা এত বেশি বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন রেফারেন্সময় হয়ে ওঠে যে তা শেষপর্যন্ত কোনো অর্থ বা তাৎপর্য উৎপাদন করে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। এই দোষটি অবশ্য তার একার নয়; এটি সাধারণভাবে অনেক উত্তরাধুনিক ও উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তক ও লেখকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরা অনেক ক্ষেত্রেই এক পারিভাষিক ও ধারণাগত ধূম্রজাল ও ধোঁয়াশা তৈরি করে এদের অনুরক্তদের মধ্যে নিজের কারিশমা জাহির করেন। ক্রিটিকাল ফ্যাকাল্টি দুর্বল যাদের তারা এই ধূম্রজালে এমনভাবে আটকে যান যে তারা মনে করেন যে এর জন্য তাদের অপারগ বোধশক্তিই বুঝি দায়ী; তাদের গুরুদের অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন ধারণা ও পরিবেশনা দায়ী নয়।
সলিমুল্লাহ খানের ক্ষেত্রে আরেকটি পর্যবেক্ষণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হল সলিমুল্লাহ খান বক্তা ও আলোচক হিশেবে যতটা সংবেদী, সঞ্চারী ও সফল, লেখক হিশেবে কিন্তু ততটা নন। এর কারণ হল তিনি তার লেখায় মৌলিক পূর্ব বঙ্গীয় গদ্য ভাষা নিয়ে যে নিরীক্ষা করেছেন তা তার ভাষাকে আড়ষ্ট ও কৃত্রিম করে তুলেছে। তা মৌলিক হয়তো হয়েছে কিন্তু প্রাঞ্জল ও পঠনসহায়ক/সুখপাঠ্য হয়নি।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকার শাহবাগে “গণজাগরণ মঞ্চ” বলে একটি সেক্যুলার সমাবেশ গড়ে ওঠে। একাত্তরে যারা বাংলাদেশ গঠনের বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে “যুদ্ধাপরাধী” কিংবা “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী” সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবীতে এই সমাবেশ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল।
সলিমুল্লাহ খান এই শাহবাগ আন্দোলনের একজন তত্ত্বায়নকারী হিশেবে হাজির হলেন। ‘সর্বজন’ নামক একটি অনলাইন প্রকাশনায় তিনি এই শাহবাগ আন্দোলনের সেক্যুলার, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের তিন আদর্শের আলোকে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। তার এই ‘সর্বজন’ ধারণার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্রুপদী পরিসরকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুললেন। অর্থাৎ সেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নারী ইত্যাদি বর্গকে জায়গা করে দিলেন বা আগের চাইতে বেশি স্পষ্ট করে তুললেন।
তাত্ত্বিকভাবে এসব প্রসারণমূলক সংযোজনা তিনি করলেন ঠিকই কিন্তু তিনি সমকালীন দেশি বিদেশি রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ নির্বাচনে বিরাট ভুল করে বসলেন। তিনি এই পপুলিস্ট বিচার কার্যক্রমের আড়ালে পরিচালিত ভারতীয় আধিপত্যবাদ নির্দেশিত নির্বাচন ব্যবস্থাসহ গণতন্ত্র-বিধ্বংসী ফ্যাসিবাদী উত্থানকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলেন। ফলে তিনি যে রাজনৈতিক অবস্থান নিলেন তা যুদ্ধাপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে এদেশে রাজনৈতিক ইসলাম ও মধ্যপন্থী মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা নির্মূলের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
একারণে আমরা দেখলাম এদেশের মারাত্মক পক্ষপাতমূলক টেলিভিশন মিডিয়াতে তিনি একজন নিয়মিত টক-শো আলোচক/বিশ্লেষক হিশেবে তার এই সেক্যুলার বাংলাদেশের বয়ান গাইছেন আর সেটা আল্টিমেটলি আওয়ামী অপশাসনকেই জাস্টিফাই করছে। তার তাত্ত্বিক অবস্থান যতই সহীহ মনে হোক না কেন তার বাস্তবিক রাজনৈতিক অবস্থান মজলুমের বিরুদ্ধে জালিমের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। কারণ তিনি আসলে ডীপ মার্কসবাদে নোঙর করে বাকীসব উত্তরাধুনিক তত্ত্ব চর্চা করেন। ফলে তিনি একাত্তরের যে ব্যাখ্যা ও বয়ান খাড়া করেন তা এদেশের নাগরিকদের আকাঙ্খিত মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাকে অগ্রাহ্য করে এবং এক আরোপিত সেক্যুলার বাংলাদেশ চাপিয়ে দিতে চায়।
কাজী নজরুল ইসলামের উপরে তার লেখা এক প্রবন্ধে ও একটি টক শোতে তিনি পরিস্কার করে বলেছেন যে বাংলাদেশের জন্য তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা অনুসৃত সেক্যুলার আধুনিকায়নের পথই শ্রেয়। বাংলাদেশের কন্টেক্সটে তিনি হয়তো হেফাজতে ইসলামের মত অরাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও মাদরাসা শিক্ষাভিত্তিক উলামাদের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া মেনে নেবেন; কিন্তু ইসলামের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রকাশ ও বিকাশের কোনো পরিসর তার চিন্তাকাঠামোতে নেই। এদিক থেকে বলা যায় তার রাজনীতির মূল যেহেতু ডীপ মার্কসবাদ, তাই তার রাজনীতি আপাতঃদৃষ্টিতে অনেক ইনক্লুসিভ শোনালেও তা শেষপর্যন্ত ইসলামিকতাকে যথেষ্ট জায়গা দেয় না; এবং প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে এদেশে ইন্দো-পশ্চিমা ইসলামোফোবিক ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টকেই অনুসমর্থন দেয়।