ইতিহাস যেকোনো জাতিকে তার লক্ষ্য নির্ধারণে সাহায্য করে থাকে। মানবের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে ইতিহাসের ধরাবাহিকতা। যা মানব জাতিকে পরিণত করেছে ইতিহাসের বিষয় বস্তুতে। ইতিহাস তুলে ধরে একটা জাতির কৃষ্টি-কালচার, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কার্য্য ধারার একটা চলমান প্রক্রিয়া। যা যেকোন জাতিকে করে রাখে জীবন্ত ও প্রানবন্ত। এজন্যই ইতিহাসকে বলা হয় ‘living past’।
ইতিহাস একটা জাতির মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করে।পরিচালিত করে পূর্বসূরীদের দেখানো পথে চলতে। যে জাতির ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই সে জাতির ভবিষ্যত কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা তমস্যাবৃত। কোনো জাতি যদি তার নতুন প্রজন্মের হাতে সঠিক এবং সুগঠিত ইতিহাস তুলে দিতে ব্যর্থ হয় তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ বিশৃঙ্খলা, হীনম্মন্যতা এবং পতনের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। দুঃখের বিষয় এই ব্যর্থতার মাঝে আমরাও আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। তাই, ইতিহাসের নির্মোহতা নিশ্চিত করতে এবং তা থেকে সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হতে এখনো পারি নি। ফলত আমাদের ইতিহাস পঠন পাঠনের কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাস রচনার গুরুত্বে রয়েছে নানাদিক কারণ। দীর্ঘকাল ধরে এ দেশে একই ভাষাভাষী বিশাল সংখ্যক মুসলমানের বসবাস। সাড়ে ছয়শত বছরের মুুুসলমানদের রাজত্বের ইতিহাস প্রেক্ষিতঃ আজকের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন তার ইতিহাস নির্মাণ মুসলমানদেরই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। সে গতি এখনো থেমে নেই। বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন বয়ানও তুলে আনার চেষ্টা করছেন। সকলের উদ্দেশ্য যে সরল পথে চলে সঠিক ইতিহাস তুলে আনা বিষয়টি তেমন নয়। ইতিহাস বিনির্মাণের মাঝেও কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় যথেষ্ট স্বার্থসিদ্ধির কিংবা কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুক্ষ্ম বিকৃতির উচ্চ বিলাস। কেউ কেউ ইতিহাস রচনার নামে সত্য ইতিহাসের মাঝে তৈরি করেন নতুন এক মিথ্যার অস্পষ্ট ধূম্রজাল। যেটি সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে বয়ে আনে জাতিতে জাতিতে বিচ্ছেদ, মারামারি, হানাহানি। নামদারী সেসব ইতিহাসবিদদের নামে তখন এক শ্রেণির পুতুল সমাজ জিগির তুলেন অসাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষ ইতিহাস বিনির্মাণে সু-পটুতার লেবাসধারী হিসেবে।
সেই স্রোতেরই মানুষ দেশের এক প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ,ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান। ২০১৮ সালের ২৮শে জুলাই জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণিজন বক্তৃতা:৬ এ তিনি ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসার : ঐতিহাসিক প্রশ্ন সমূহের পুনর্বিবেচনা’ নামে একটি বক্তৃতা পেশ করেন। পরবর্তীতে ‘প্রথমা প্রকাশন’ কর্তৃক বক্তৃতা টি ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ নামে বই আকারে বের হয়। বাংলায় মুসলিম ধর্ম প্রচারকদের আগমন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের শাসন এবং অধিকাংশ স্থানীয়দের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয় নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ হাজির করেন।
সহজ ভাষায় সাহিত্যিক ভঙ্গিতে ইতিহাসের বিরল ও অস্বাভাবিক বয়ান নির্মাণে খান সাহেবের জুড়ি মেলা ভার। একটা বিষয় হলো, ইতিহাসের গতিপথ মাড়িয়ে অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে নিরপেক্ষতার যে বেদবাক্য প্রকাশ করে থাকেন। আদতে সেটা কতটুকু তারা রক্ষা করতে পারেন? তাদের ইতিহাস কি আদৌ ইতিহাস হয়ে উঠে? আমরা মনে করি ইতিহাসের রয়েছে নানারকম দিকবিদিক শাখা। রয়েছে নানারকম দৃষ্টিকোণ। যে যেদিক থেকে ইচ্ছে সেদিক থেকে দেখার সুযোগ এখানে গ্রহন করা যায়। ফলে নিজ মর্জি ও স্বার্থে ইতিহাস রচনার কাজ খুব সহজে হাতে আনা যায়। ইতিহাস রচনার সেই ছিদ্রপথ অন্বেষণ করেছেন আকবর আলী খান। এগারোটি অধ্যায়ে সাজানো বইটিতে তিনি তার বিশ্লেষণ ও মতামত তুলে ধরেছেন। দশম অধ্যায়ে তিনি উন্মুক্ত গ্রামতত্ত্ব নামে একটি নতুন কনসেপ্ট যুক্ত করেছেন। যেটি আমরা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
জনাব খান, তার গ্রন্থের শুরুর প্রস্তাবনাতেই ইংরেজ-রচিত বাংলার ইতিহাসে হিন্দু ব্রাহ্মণদের ভীরু ও কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয় নিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদ তথা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উষ্মার কথা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি, বঙ্কিমের রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা'[১]প্রবন্ধ থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। যেটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দ (১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গদর্শন পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। যেখানে বঙ্কিম লিখেছেন :
“আমাদিগের বিবেচনায়, একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গলার প্রকৃত ইতিহাস নাই। সে সকলে যদি কিছু থাকে তবে সে সকল মুসলমান বাঙ্গলার বাদশা, বাঙ্গলার সুবাদার ইত্যাদি নিরর্থক উপাধি ধারণ করিয়া, নিরুদ্বেগে শয্যায় শয়ন করিয়া থাকিত, তাহাদিগের জন্ম, মৃত্যু, গৃহবিবাদ এবং খিচুড়ি ভোজন মাত্র। ইহা বাংলার ইতিহাস নয়, ইহা বাঙ্গলার ইতিহাসের এক অংশও নয়।”[২]
বিদেশি শাসকের লেখা ইতিহাসে পরাধীন জাতি তার নিজের কথা খুঁজে পাবে না, নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে- জাতীয়তাবাদের এই হলো প্রাথমিক স্লোগান। স্বরচিত ইতিহাসের অভাব নিয়ে বঙ্কিমের ক্ষোভ নিঃসন্দেহে তার জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।[৩]
আলোচ্য অংশে বঙ্কিমের যে ক্ষোভ—ব্রিটিশরা ইতিহাস-বইতে হিন্দুদের ভীরু কাপুরুষ হিসেবে দেখিয়েছেন—তার কারণ ভিন্ন। ইংরেজগণ বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল মুসলিম শাসকদের হাত থেকে। আগের প্রায় সাড়ে পাঁচ শত বছরে বাংলা মুসলিম রাজ-শক্তি দ্বারাই শাসিত ছিল। ফলে ইতিহাস লিখতে গেলে এই পর্বের নৃপতিগণের শৌর্য-বীর্য, বিজয়ের কথা আসবেই। ব্রিটিশরা ১৭৮৮ সালে সৈয়দ গোলাম হোসেন সলিমকে দিয়ে এই পর্বের একটি ইতিহাস রচনা করিয়েছিলেন ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ নামে। যেহেতু তার পূর্ববর্তী ইতিহাসের উপাদান তখনও বেশ দুর্লভ ছিল, ফলে অনেক হিন্দু স্কলারের কাছেই এটা ছিল একটি উষ্মার কারণ। যদিও এই উষ্মাকেও ব্রিটিশরা সক্রিয়ভাবে পরিপুষ্ট করেছেন ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত, তাদের সমর্থকগোষ্ঠী রচনার কাজে।[৪]
তারপরেও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কল্যাণে মুসলমান রাজত্ব যুগের ইতিহাস যে নিতান্ত বিকৃত হইয়াছে, একথা এদেশীয় বঙ্গভাষার ইতিবৃত্তকার মহাত্মা রজনীকান্ত গুপ্ত মহাশয়ই তার রচিত ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে’ প্রকাশ করেন।তিনি বলেন, “আজ পর্যন্ত ভারতের প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হয় নাই। কোন কোন সংকীর্ণ হৃদয় বিদেশির হস্তে পড়িয়া, ভারতের ইতিহাস অনেক স্থলেই কলঙ্কিত ও অনেক স্থলে অতিরঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে।”
অতঃপর আকবর আলি খান উল্লেখ করেছেন- বঙ্কিমের বিখ্যাত সেই আহবান, ‘কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে।’..’বাঙালির ইতিহাস চাই, নইলে বাঙালি বাঁচিবে না’।
এটা স্পষ্ট যে, বঙ্কিম এখানে বাঙালির যে ইতিহাস চাচ্ছেন তা হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইতিহাস। তার বাঙালি শব্দের অর্থ ‘বাঙালি হিন্দু’। ব্রাহ্মণ ব্যতীত বাংলার অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় যেমন, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউকেই তিনি বাঙালি পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এমনকি বাঙালি সাধারণ কথিত নিম্ন শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষকেও তিনি বাঙালি বলে মনে করতেন না। মূলত, এটা ছিল দীর্ঘকালের টিকে থাকা বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার সিলসিলার প্রয়োগ। বঙ্কিম সেই ব্রাহ্মণ্য চিন্তার দরজা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তাই তারকাছে এখানকার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্ম জৈন কিংবা বৌদ্ধ ও বিশেষ কোন অগ্রাধিকার পায় নি। থাক তো মুসলমান ধর্ম। এটাকে একধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বলা যায়। ইংরেজদের ব্যপারে বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদারতাবাদী। ইতিহাস রচনায় তার ইংরেজ দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনা করার অন্যতম কারন হলো ইংরেজের রচনা কিংবা তাদের সমর্থিত লেখকদের লেখায় মুসলমান ইতিহাসের বাহুবলের কথা ফুটে উঠেছিল। কিন্তু, এখানে বঙ্কিমের স্বজাতিকে দেখানো হয়েছে পরাজিত হিসেবে। যা উষ্মারই কারণ হ’য়েছে। তাইতো
“বঙ্কিম আহ্বান জানিয়েছেন নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে। এবং এও দাবি করছেন যে, সে ইতিহাস হবে বাহুবলের ইতিহাস, কারণ বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত পরতন্ত্র একমাত্র বাহুবলের সাহায্যেই ধ্বংস করা যায় কিন্তু এই বাহুবলের ইতিহাস বঙ্কিম খুঁজেছেন প্রাক-বৃটিশ যুগে। উপনিবেশের পর্বে পরাধীন জাতির ঐতিহাসিক মুক্তির যে আধুনিক চেতনা, তার শর্তগুলো উপস্থিত করেও বঙ্কিম কিন্তু উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাহুবল প্রয়োগের কথা বলছেন না। তিনি শোনাচ্ছেন কেবল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতির বাহুবলের কাহিনী৷ এর ফলে এক দিক থেকে তিনি নিজেই নিজের প্রস্তাবটি ভেস্তে দিচ্ছেন।”[৫]
বলা যায়, এটি ছিল বঙ্কিমের মুসলিম বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ার ফল। নচেৎ বাঙালি পরিচয়, যা কিনা মধ্যযুগে মুসলমান শাসনের সময় বাংলার শাসক ও অধিবাসীদের পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাকেও হিন্দুত্বের রঙে রঙ্জিত করার অপচেষ্টা চলে ; এমন কি বাঙালির ভাষা, যা সেন এবং সেন পরবর্তী সময়েও ঘৃণা করতো ব্রাহ্মণরা। মুসলিম শাসনের সময়ে গণযোগাযোগ এবং তাদের ধর্মপ্রচারের স্বার্থে এবং মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণরা যে ভাষার ব্যবহার শুরু করেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই যবন স্লেচ্ছদের ভাষাকে সংস্কারের নামে কিভাবে পৈতে পরানোর চেষ্টা হয়েছে তাও আমরা দেখতে পাই শব্দসম্ভারের বিবর্তনের দিকে তাকিয়ে।[৬]
তিনি লেখার আরেক জায়গায় বলেন,
“এখন তো দেখিতে পাই,বাঙ্গালার অর্ধেক লোক মুসলমান। ইহার অধিকাংশই যে ভিন্ন দেশ হইতে আসত মুসলমানদিগের সন্তান নয়, তাহা সহজেই বুঝা যায়।কেননা ইহারা অধিকাংশই নিম্ন শ্রেণির লোক- কৃষিজীবী। রাজার বংশাবলি কৃষিজীবী হইবে, আর প্রজার বংশাবলি উচ্চশ্রেণি হইবে, ইহা অসম্ভব।”[৭]
বাংলা অঞ্চলের মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে প্রথম বিস্ময় ও প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্কিম বাবু। তিনি যখন ব্রিটিশের অধীন শাসন যন্ত্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা(১৮৫৮-১৮৯১), তখন তিনি H. Beverley-র রিপোর্টে খেয়াল করেন যে মুসলমান কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। সে রিপোর্টে হেনরি ভেবারলি সিদ্ধান্ত দেন যে, মুসলিম শাসনের পর ব্রিটিশ শাসনের ছদ্মবেশে যে খ্রিষ্টিয় শাসন শুরু হয়েছিলো,তাতে গণহারে খ্রিষ্টিয় ধর্মে ধর্মান্তকরণ হওয়ার ছিলো, কিন্তু সেটা হয় নি।বরং এসময়টায় ইসলাম ধর্মে যে নির্জীবতা দেখা দেওয়ার কথা ছিলো তাও ঘটে নি। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে এসময়টাতে মুসলিম বৃদ্ধি পেয়েছে খুব ঘটা করেই। যেটা বঙ্কিম কে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিলো মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। তিনি বলেন-
“দেশীয় লোকের অর্ধেক অংশ কবে মুসলমান হইল? কেন মুসলমান হইল? কোন জাতীয়েরা মুসলমান হইয়াছে? বাঙ্গলার ইতিহাসে ইহার অপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব আর নাই।”
অর্ধেক লোক মুসলমান হইয়াছে এ দুঃখ বঙ্কিম সহ্য করার পিছনে মূল কারণ ছিলো, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অথবা তার জন্য সান্ত্বনা এই ছিলো যে, এদের অধিকাংশই নিম্ন শ্রেণির লোক -কৃষিজীবী।
বঙ্কিম ঢাকার মুসলমানদের তিরস্কার করে লিখেছিলেন,”ঢাকায় দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে।কাক,কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটি সমভাবে কলহ প্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়া বাড়িতে কাক আর কুকুর। আদালতে মুসলমান।”[৮]…
ভারতবাসীকে তিনি ইংরেজের দাসে পরিণত করতে যে নেমক খেয়েছিলেন সে নেমকের বিনিময়ে তিনি পুরোমাত্রায় কাজ করেছেন। নেমকহারামি বা ইংরেজের সাথে কোন বিশ্বাস ঘাতকতা করেন নি।যদ্দরুন এই সাম্প্রদায়িক কলুষ চিন্তার প্রভাব পড়ে বঙ্কিম পরবর্তী হিন্দু ইতিহাসবিদদের মানস তন্ত্রে। বাংলার ধ্বংস প্রাপ্ত মুসলমান সমাজের বুকের উপর দাড়িয়ে তারা এক শতাব্দীর ধরে রাশি রাশি বানোয়াট সাম্প্রদায়িক রঙ্গিন সুত্রে রচনা করেছেন ইতিহাস। এসব কাহিনির পূর্ণ রুপ লাভ করে গত শতকের চল্লিশের দশকে, তৎকালীন কোলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাবু অধ্যাপকদের হাতে। সাড়ে পাঁচশত বছর ব্যাপী মুসলিম শাসনামলের উজ্জ্বল দিকগুলোকে পাইকারি হারে বাদ দিয়ে সর্বক্ষেত্রে সাধ্যমত কলংক লেপন করেছেন এসব রথি-মহারথিরা।
তাদের ইতিহাসের ধারালো কাচি থেকে রক্ষা পায় নি এই উপমহাদেশের অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়। তাদের ইতিহাসে কোন মুসলমানের জায়গাতো ছিলোই না, সাথে ছিলোনা বঙ্গের আদি ও স্বাধীন কওম বদ্ধ জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কোন আলাপের বহুলতা। তারা মুসলমানকে দেখিয়েছে অত্যাচারী, সাম্রাজ্যবাদী রুপে অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে আদিবাসীদের উপর আর্য্যবাদীদের অত্যাচারের কথা প্রায় চেপে গিয়েছে। আর সদর্বে প্রচার করে বেড়িয়েছে এদেশ শুধু তাদেরই। যাবতীয় অধিকার শুধু তাদেরই। আর এসকল চিন্তার মূল পথপ্রদর্শকই ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার অনুগত ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম বাবু।
তিনি তার প্রবন্ধে, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখনো মানুষ হইবে না।” কথায় যে ইতিহাস রচনার আবেদন পেশ করেছিলেন সেটা ছিলো সম্পূর্ণ মুসলিম বিদ্বেষীতা। তার প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি মন্তব্য দেখলেই আমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারি।
আর এধরণের সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার শুধু বঙ্কিমকে দিয়েই শেষ ছিল বিষয় টা তা না। বরং তিনি ছিলেন এ ধারার মহান পুরুষ। যা আজকের দিনের মুসলমানরা এখনো ইন্ডিয়াতে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অধিকারের জায়গায় মুসলমানদেরকে সর্বদা বঞ্চিত করা হচ্ছে। এজন্যই ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির জনক এম. এন. রায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিলেন-
“পৃথিবীর কোন সভ্য জাতিই হিন্দুদের মতত ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এত অজ্ঞ নয়। ইসলাম সম্বন্ধে এমন ঘৃণার ভাবও কেউ পোষণ করে না।…ইসলামের অসাধারণ বৈপ্লবিক গুরুত্ব ও ব্যপক সংস্কৃতির তাৎপর্য সম্বন্ধে অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দুরই খুব সামান্য জ্ঞান আছে। এ সম্বন্ধে এদের কোন মূল্যায়ন নেই।” পাশাপাশি, এই বিপরীতধর্মী ইতিহাসবীদদের ক্ষুদ্রতা, নীচতা ও সাম্প্রদায়িক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, “শিক্ষা দিক্ষার জগতে আজকের দিনে সবচেয়ে বড় ‘কালোবাজার’ চলছে ইতিহাসের পট্টিতে।”[৯]
মূলত, একথা বলতে তৎকালীন চলমান সাম্প্রদায়িক ইতিহাস বিনির্মানের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন।
বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যের অনেক বড়ো একজন লেখক ও সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু তার মাঝে কট্টর সাম্প্রদায়িকতা বলবৎ ছিলো। যে দোষ তিনিই প্রথম দুষ্ট ছিলেন বিষয়টি এরকম নয়। তার ও আগে-পরে বহু বাঘা বাঘা জ্ঞানী ব্যক্তিগনও এ দোষে দুষ্ট ছিলেন। ‘ঔপনিবেশিক শাসন—মন ও মননের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এবং ফেলেছে তার দৃষ্টান্ত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যে বিদ্যাসাগর, তার বেলাতেও (আমরা) দেখতে পাই।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের নির্দেশে বিদ্যাসাগর পাদ্রি ও লেখক ক্লার্ক মার্শম্যান রচিত Outlines of the History of Bengal পাঠ্য-পুস্তকটির অনুবাদ করেন। বইয়ের শেষাংশে সিরাজ-উদ-দৌলা থেকে বেন্টিংক পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস রয়েছে। বিদ্যাসাগরের অনুবাদটি ইংরেজ শাসকদের খুব পছন্দ হয়, তারা বিদ্যাসাগরের অনূদিত বইটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মার্শম্যান স্বয়ং এই অনুবাদের কাজটি করেন, যেটি ১৮৫০-এ A guide to Bengal, being a close translation of Iswar Chandra sharma’s Bengali version of Marshman’s History of Bengal নামে প্রকাশিত হয়। তাদের দিক থেকে এই আগ্রহের কারণ ছিল এই যে, একই মুসলিম শাসনের বিপক্ষে এবং বৃটিশ শাসনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। নবাবি শাসনের যে ছবি বইতে রয়েছে তাতে বিদ্যাসাগরের নিজের সংযোজন যুক্ত হয়েছে। বইয়ের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ”বাঙ্গালার ইতিহাস। অবিকল অনুবাদ নহে। কোনও কোনও অংশ আবশ্যকবোধে গ্রন্থান্তর হইতে সঙ্কলনপূর্বক সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই পুস্তকে অতি দুরাচার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনারোহণ অবধি, চিরস্মরণীয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক মহোদয়ের অধিকার সমাপ্তি পর্যন্ত বৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে।” মার্শম্যানের বইতে যেসব জায়গায় নবাবি শাসনের কৃতিত্বের কথা আছে বিদ্যাসাগর তা বাদ দিয়েছেন বা সংস্কার করেছেন। সিরাজ-উদ-দৌলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তার শাসনামলে প্রায় কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনো স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।”’ (সিরাজুল ইসলাম : ১৪১)[১০]
এই মনোবৃত্তি যে শুধু বিদ্যাসাগরেরই ছিল তা কিন্তু নয়, এটা তারও অগ্রজ রাজা রামমোহনের মধ্যেও ছিল। তিনি একটি অঞ্চলের বৃহত্তর ভাষিক নৃগোষ্ঠী বাঙালিদের পরিচয়কে হিন্দু ধর্মীয় পরিচয়ে একাকার করে ফেলেছিলেন, যা তার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। তার চেয়েও বড় কথা ব্রিটিশ শোষণে বাংলায় যে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় এবং দেশের তিন ভাগের একভাগ লোকের মৃত্যু হয়, তিনি সেই ব্রিটিশ শাসনকে দেখেছেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে।[১১]
বঙ্কিমের এসকল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসূত লেখনির যারা সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদ করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্। তিনি খেদের সঙ্গে লিখেছেন-
“যে সকল মুসলমানকে ভারতের ইতিহাসের জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না, আজ সেই মুসলমান বাংলা দেশে ইতিহাসের চর্চ্চা ছাড়িয়া দিয়াছে।… ভারতের মুসলমান ইতিহাস প্রায়শ: মুসলমানদের বিকৃত চরিত্রের চিত্র মাত্র।….. বিদেশীগণ বা বিধর্ম্নীগণ মুসলমান রাজকন্যা বা রাজকুমারী রাজমহিষীগণ সম্বন্ধে যে সমস্ত স্বকপোলকল্পিত কুৎসিত আখ্যায়িকার সৃষ্টি করিয়াছে, অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ মূলে তাহার খন্ডন করা মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। রাজ সিংহ ও চন্দ্রশেখর এর লেখক কে খালি খালি গালি দিলে চলবে না। ঐতিহাসিক সার্চ্চ লাইট দ্বারা তাহার অসত্যতা বা অর্দ্বসত্যতা জগতের সামনে প্রকাশ করিয়া দিতে হইবে।[১২]
সুতরাং বই সূচনায় উথাপিত স্বপ্নের ইতিহাস ছোঁয়ার আকাঙ্খা চিন্তার জটাজাল খুলে দেখলে আকবর আলী খানের নির্মিত ইতিহাসের বয়ানের লক্ষ্য বুঝতে আর দেরি হয় না। মূলত তিনি ইতিহাস বিনির্মানের নামে নতুন করে পুরোনো হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাসুন্দি তুলে আনার প্রয়াস চালিয়েছেন। যা তাকে বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের লোকাল এজেন্ট হিসেবেই পরিচিত করে তোলে। (চলবে)