মক্কার কাজীর কার্যালয়। বিচারকার্য চলছে। একটি চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে ফাতিমা নামক এক মহিলার সাক্ষ্য প্রয়োজনের দেখা দিলো। কাজী তাকে তাৎক্ষণিক ডেকে পাঠালেন। চুক্তি সংঘটিত হবার সময় উপস্থিত অপর সাক্ষী মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন ফাতিমা। কাজী উভয়ের বক্তব্য শুনবার পর আলাদাভাবে দুইজনের সাক্ষ্য শুনতে চাইলেন। বাধ সাধলেন ফাতিমা। কাজীকে জানালেন যে তিনি এরূপ করতে পারেন না। তা শুনে কাজী আশ্চর্য হলেন। বলে কি এই নারী! সাহসিকতার সাথে ফাতিমা বললেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াতে বলেছেনঃ
“তারপর নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তিকে তার স্বাক্ষী রাখো। আর যদি দু’জন পুরুষ না পাওয়া যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা সাক্ষী হবে, যাতে একজন ভুলে গেলে অন্যজন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।”
অর্থাৎ, আল্লাহ স্বয়ং বলে দিয়েছেন যে সাক্ষ্য দেবার ক্ষেত্রে দুইজন মহিলার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে এজন্য যে, যেনো তারা একে অপরকে ভুলে যাওয়া বর্ণনা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। তাই আপনি আমাদেরকে পৃথক রেখে সাক্ষ্য নিতে পারবেন না। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী উপরোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থের এই মাত্রার বোধগম্যতা সত্যিই দুর্লভ। নিঃসন্দেহে ফাতিমা ছিলেন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন মহিলা! মাথায় কি প্রশ্ন আসে না যে, “কে এই মহিলা?” যিনি এতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁর সন্তানের বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই অতুলনীয় হবার কথা। এবং তাইই হয়েছিলো। তাঁর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন পরবর্তীকালের মুহাদ্দিস ও ফকীহ “ইমাম আশ-শাফে’ঈ” (রাহিমাহুল্লাহ)।
মৃত্যু বড় সুনিশ্চিত। কখন কে বিদায় হবেন নেই কোনো ঠিক ঠিকানা। হিজরী ১৫০ সনে মৃত্যুর কাতারে নাম লিখিয়ে “ইমাম আবু হানিফা” (রাহিমাহুল্লাহ) দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। ঠিক একই বছরে, মতান্তরে; (রাবি’আ ইবন আবু সুলাইমানের মতে), ইমাম আবু হানিফা যেইদিন ওফাত লাভ করেন, ঠিক সেইদিনই ইমাম “আশ- শাফে’ঈ” (রাহিমাহুল্লাহ) দুনিয়ার আলো দেখেন। তাঁর পিতৃপুরুষেরা মক্কা থেকে আগত হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়।
জন্মেছিলেন উচ্চবংশে। বংশমর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধর (কুরাইশ)। তাঁর পূর্ণ নাম “মুহাম্মদ ইবনু ইদরিস ইবনুল আব্বাস ইবনে উসমান ইবনে শাফে’ঈ ইবনু উবায়েদ ইবন আবু ইয়াযিদ ইবন হাশেম ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন আবদে মানাফ।” আশ শানকী’তি রহিমাহুল্লাহ বলেন, “বংশসূত্রের দিক দিয়ে ইমামগণের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তাঁর বংশসূত্র অষ্টম পুরুষে গিয়ে নবীজি (সাঃ) পর্যন্ত পোঁছেছে।” ইমাম আশ- শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) অল্প বয়সেই পিতৃহারা হন। তাঁর মা, ফাতিমা শংকিত বোধ করেন, পুত্র হয়তো নিজ বংশের আত্মমর্যাদা লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই শিশুপুত্র মুহাম্মদকে নিয়ে তিনি যাত্রা করেন মক্কার উদ্দেশ্যে।
ফাতিমা ছিলেন আল্লাহভীরু, সতী একজন মহিলা। নিজ পুত্রকে ইলম সন্ধানী বানাবার জন্য তিনি তাঁর গোটা জীবন ব্যায় করেছিলেন। তাঁর এই পরিশ্রম, সাধনা বিন্দুমাত্র ও ব্যর্থ হয়নি। পুত্র হয়ে উঠেছিলেন শতাব্দী সেরা মুজাদ্দিদ। শিশুপুত্রকে মা বললেন, “ ইয়া মুহাম্মদ! আমরা দরিদ্র, অসহায় মানুষ। আমি আমার জীবনের সমস্ত শখ আহ্লাদ তোমার জন্য বিসর্জন দিলাম। আমি চাই তুমি একজন আলেম হয়ে মুসলিম উম্মাহর খেদমত করো।” মায়ের এ ইচ্ছে শিশু মনে দাগ কাটলো। সংকল্পবদ্ধ হলেন তিনি যে, ইলমের সন্ধান চালিয়ে যাবেন আমরণ। এবং তিনি তাইই করেছিলেন। তাঁর ৫৪ বছরের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি ইলমের অন্বেষণ করে কাটিয়েছেন। ক্ষণস্থায়ী এ সময়টুকুতেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তার শাণিত বুদ্ধি, প্রখর মেধা এবং অভাবনীয় স্মরণশক্তির দ্বারা।
মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আলেমদের কাছে যাওয়া শুরু করলেন। পুরনো, ধূলিমলিন কাপড়ে সজ্জিত থাকায় তাকে শিক্ষক তেমন একটা খেয়াল করতেন না। ছোট্ট মনে এ অবহেলা তার সহ্য হলো না। মায়ের কাছে এ কথা জানালেন। মা বুদ্ধি করে তাঁকে উত্তমরূপে নসীহাহ দিলেন, “বাবা! তোমার কাজ জ্ঞান অর্জন করা। তুমি শুধু শুনবে তোমার উস্তাদ কী বলেন! কেউ খেয়াল না দিলেও তোমার তাতে কিই বা আসে যায়!” এবার খুশিমনে হালাক্বায় ফিরে গেলেন মুহাম্মদ।
মায়ের কথামতো শিক্ষক কী পড়াচ্ছেন শুধু সেদিকে মনোযোগ দিলেন তিনি। অল্প সময়েই শিক্ষকের পড়ানো বিষয় গুলো তার মুখস্থ হয়ে যেতো। বাকি সময় টুকুতে তিনি যারা পড়া বুঝতো না তাদের বুঝিয়ে দিতেন ও তাদেরকে পড়াতে শুরু করলেন। কোন কারণে শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তিনি তার সহপাঠীদের ক্লাস নিতেন। বিস্ময়কর প্রতিভা! ব্যাপারটি শিক্ষকের নজরে এলে তিনি আশ শাফে’ঈকে (রহিমাহুল্লাহ) নিজস্ব সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইলমজগতের অন্যতম এ ধ্রুবতারা এভাবে অল্প বয়স থেকেই তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন।
বয়স যখন সাত বছর, সম্পূর্ণ পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন মুহাম্মদ ইবন ইদরিস রহিমাহুল্লাহ। পূর্বের সেসময়ে কোরআন মূখস্তকরণ ছিলো প্রতিটি শিশুর আবশ্যকীয় পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত। সে রীতি অনুযায়ী তিনি অল্প বয়সেই তা মুখস্ত করে ফেলেন। কন্ঠের মাধুর্য লোকেদের বিমোহিত করতো। বাড়িতে এসে তারা ভীড় জমাতো তিলাওয়াত শুনবে বলে। দিকে দিকে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থের তখন জয়জয়কার। ইমাম মালিক রচিত এ বিশুদ্ধ গ্রন্থের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো চারিপাশে। আশ-শাফে’ঈ (রহিমাহুল্লাহ) ভাবলেন, কেনো আমি এ হাদীস গ্রন্থের পাঠ থেকে নিজেকে বিরত রাখছি! যেই ভাবা, সেই কাজ!
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মুয়াত্তা পড়বেন। কিন্তু এতো বিশাল গ্রন্থ খরিদ করবার সামর্থ্য যে তার নেই! চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, এক বন্ধুর থেকে কিছুদিনের জন্য ধার নিলেন। বন্ধুকে নয়দিন পর বইটি ফেরত দিলেন। ইতোমধ্যে হৃদয়ের কালিতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে সম্পূর্ণ গ্রন্থ! মাত্র নয় বছর বয়সী একটি ছেলে নয়দিনে মুয়াত্তার মতো গ্রন্থ মুখস্থ করে ফেলেছে, যেখানে ১৮৫০টির মতো বর্ণনা উল্লেখিত রয়েছে! এ কথা সত্যিই মনে বিস্ময় জাগায়। এমনই প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিলো তাঁর। একপ্রকার ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী ছিলেন ইমাম আশ-শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ)। বই পড়বার সময় অপর পাশের পৃষ্ঠা হাত দিয়ে ঢেকে রাখতেন, যেনো সেখানে চোখ না পড়ে যায়। নাহলে তো মুখস্থ করবার সময় গুলিয়ে ফেলবেন।
শিশুকাল থেকেই জ্ঞানার্জনের প্রতি ছিলেন প্রবল উৎসাহী। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাহ এবং তাঁর হাদীসের প্রতি ছিলো তার অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। একসময় তার প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হলো। ফাতিমার ইচ্ছে হলো ছেলেকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শেখাবেন। সেই উদ্দেশ্যে পাঠালেন হুদাইল গোত্রে। ইমাম আশ-শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর জীবনের ১৭ বছর ব্যয় করেন তাদের সাথে। একটানা কেবল এখানেই সময় দেন নি বরং ছুটে চলেছেন জ্ঞানের খোঁজে। পাশাপাশি অর্জন করেন স্কিলগুলো। প্রাঞ্জল শ্রুতিমধুর আরবী ভাষা আয়ত্তকরণ, কাব্যিক প্রতিভার বিকাশ, তীরচালনা, আরবী সাহিত্য – এ সকল গুণাবলি পূর্ণতা লাভ করে এ সময়।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইদরিস রহিমাহুল্লাহ তাঁর উস্তাদ, মক্কার হারাম শরীফের তৎকালীন মুফতি মুসলিম ইবনে খালিদ আল-জাঞ্জীর (রহিমাহুল্লাহ) থেকে তিনি ফতোয়া দেবার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হন। সাবালক হওয়ার আগেই তিনি ফতোয়া দেয়ার পার্মিশন পেয়ে যান।
একদা তিনি হারাম শরীফের পাশে সমবেত লোকেদের ফিক্বহুস সিয়াম শিখাচ্ছিলেন। সময়টা ছিলো রমজান মাস। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তিনি পাশে থাকা পানির পাত্র খুলে পানি পান করলেন! সবাই বিস্ময়ে হতবাক! এ কী করলেন ইমাম! আমাদেরকে সিয়াম সংক্রান্ত মাস’আলা শিখাচ্ছেন, আর তিনি নিজেই রোজা ভঙ্গ করে ফেললেন। তাদের এ হতবিহ্বল অবস্থা দেখে আশ-শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ব্যাখ্যা করলেন, “আসলে আমি এখনো বালেগ হইনি। তাই আমার উপর রোজা ফরজ নয়। যেহেতু বাহিরে প্রখর রোদ, আপনাদেরকে পাঠদান করাতে আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তাই পানি পান করে নিলাম।” তাঁর জ্ঞানের বহর ছিলো এরকম ই সুবিশাল।
ফতোয়া দেবার অনুমতি পেয়ে গেলেন ইমাম শাফি’ঈ! সাধারণ কেউ হলে এ প্রাপ্তি তাঁকে পরিতুষ্ট করতো হয়তো। কিন্তু তিনি থেমে থাকলেন না। জ্ঞানের জন্য তার প্রবল পিপাসা ছিলো। তাই তিনি আমৃত্যু ছুটে চলেছেন জ্ঞানের অন্বেষণে। সেসময় ইমাম মালিকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো দিগবিদিক। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লোকেরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার সোহবত লাভ করতেন। কেননা তিনি ছিলেন জ্ঞান ও হাদীসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
তেইশ বছর বয়সে ইমাম আশ-শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) মদীনায় যাবার ইচ্ছে পোষণ করেন। মক্কার গভর্নর তাকে সুপারিশপত্র লিখে দেন। সুপারিশপত্র দেখে ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বেশ বিরক্ত হলেন। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ায় তিনি যুবক ইমাম আশ-শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) অন্তর্নিহিত প্রতিভা সম্বন্ধে বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহর অবাধ্য হয়ো না। আল্লাহ তোমার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহ তোমার অন্তরে যে নূর দিয়েছেন আল্লাহর অবাধ্য হয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিও না। আর আজকে চলে যাও। কাল এসে আমাকে শুনাবে যে তুমি কি জানো।’
আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পরবর্তী দিন আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে ‘মুয়াত্তা’ থেকে পড়া শুরু করলাম। যখনই তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি পড়া বন্ধ করতে চাইতাম, তিনি আমাকে পড়া চালিয়ে নিতে বলতেন। এভাবেই কয়েকদিনে সম্পূর্ণ মুয়াত্তা শেষ হবার পূর্ব পর্যন্ত আমি পড়ে যেতে থাকলাম।’ ইমাম আশ শাফে’ঈর পাঠভংগি, সুরেলা কন্ঠ, সাবলীল উচ্চারণ সবকিছু মিলিয়ে শ্রুতিমধুর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তাই ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর এ পড়া তন্ময় হয়ে শুনছিলেন।
পাঠদান শুরু হলো। এ প্রক্রিয়া বহাল ছিলো ১৭৯ হিজরীতে মালিক ইবন আনাসের (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত্যু পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ইমাম শাফে’ঈ তাঁর কাছ থেকে ফিক্বহ এর জটিল বিষয় গুলো সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু তিনি কেবল ইমাম মালিকের কাছে জ্ঞানার্জন সীমাবদ্ধ রাখেন নি বরং জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেছেন দেশে দেশে। ভ্রমণের এ নেশা তাকে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে করেছে পরিচিত, অভিজ্ঞতার ঝুলিকে করেছে সমৃদ্ধ।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। ততোদিনে ইমাম আশ শাফে’ঈর (রহিমাহুল্লাহ) জ্ঞানের পরিধি অনেকটা বিস্তৃত হয়েছে। ভাবলেন, এবার কিছু রোজগারের কথা চিন্তা করা উচিত। উল্লেখ্য, তখনো তিনি নিতান্তই দরিদ্র। কিন্তু কোন উপায়ে উপার্জন করবেন! এ ভাবনার অবসান ঘটালেন ইয়েমেনের গভর্নর। মক্কায় এসে তিনি বিশ্বস্ত কারো খোঁজ করছিলেন। এক ব্যক্তি তাকে ইমাম শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) সন্ধান দেয়। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, উচ্চবংশ প্রভৃতি কারণে তিনি ছিলেন সবার কাছে পরিচিত। তাকে ইয়েমেনের নাজরান প্রদেশে ক্বাজীর পদে অধিষ্ঠিত করা হলো।
নাজরান ছিলো এমন একটি প্রদেশ, যেখানকার লোকেরা অন্যায়, প্রতারণায় লিপ্ত ছিলো এবং ক্বাজী, গভর্নরদের তারা ঘুষ দিয়ে, চাটুকারিতা করার মাধ্যমে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতো। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা ইমাম আশ শাফে’ঈকে (রাহিমাহুল্লাহ) পেলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি ঘুষ প্রদানের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিলেন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামলেন। কিন্তু এ পথ তো এতো সহজ নয়। পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। কেবল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব নিয়ে অবিচল থাকলেই টিকে থাকা সম্ভব। শাফে’ঈকেও (রাহিমাহুল্লাহ) পরীক্ষার মুখোমুখী হতে হয়েছিলো।
নাজরানের গভর্নর স্বয়ং ছিলেন একজন দুর্নীতিবাজ। ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ক্ষমতাকে দমিয়ে রেখে সাধারণ জনগণকে তাঁর জুলুম থেকে রক্ষা করছিলেন। তাই লোকেরা যখন তাঁর কাছে এ ব্যাপারে কানপড়া দিলো সে আরো পেরেশান হয়ে উঠলো এবং সরাসরি “খলীফা হারুন অর রশীদ”কে পত্র লিখে পাঠালো যে, “আমার প্রদেশের ক্বাজী একজন শিয়া।” উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে ছিলো আব্বাসী খিলাফত, যারা শিয়াদের একেবারেই বরদাশত করতো না এবং কারো সাথে শিয়াদের সংশ্লিষ্টতা পেলেই তাকে হত্যা করা হতো। তাঁর উপর তিনি কিনা আহলে বায়াতের প্রশংসা করে কবিতা ও লিখেন। গভর্নর ভাবলেন, খলীফা নিশ্চয়ই তাকে এবার মৃত্যুদন্ডই দিবে।
চিঠি পেয়েই খলিফা তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য হুকুম দিলেন। ইমাম আশ শাফে’ঈসহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরো নয়জনকে আটক করে খলীফার দরবারে পাঠানো হলো। বাকি সবাইকে হত্যা করা হলেও বাকপটুতার কারণে রেহাই পেয়ে গেলেন তিনি। কীভাবে তিনি রক্ষা পেলেন? তিনি বংশসূত্রের জের তুলে মনে করিয়ে দিলেন, আপনারা(আব্বাসীরা) আমাদের ভাই মনে করেন, অথচ শিয়ারা আমাদের দাস মনে করে। আমরা তো আপনাদেরই বেশি ভালোবাসি। অন্যদিকে তাঁর জ্ঞান গরিমা সম্বন্ধে অবগত ছিলেন হারুন অর রশীদের পছন্দের ইমাম, মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শায়বানীর (রহিমাহুল্লাহ)।
তিনিও খলীফার কাছে তাঁর হয়ে কথা বললেন। অতঃপর খলীফা তাঁকে আশ শায়বানীর জিম্মায় ছেড়ে দিলেন। বিচারের এ প্রক্রিয়া সংঘটন হয়েছিলো ১৮৪ হিজরীতে। ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) মক্কায় ফিরে যান তিন বছর পর, যখন তাঁর বয়স ছিলো সাইত্রিশ বছর। এ দীর্ঘ সময় তিনি ইমাম আশ শায়বানীর (রাহিমাহুল্লাহ) সান্নিধ্যে কাটান। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনা তার জীবনের জন্য আল্লাহ প্রদর্শিত একটি দিকনির্দেশনা ছিলো। যেনো তিনি তার জীবন প্রশাসনিক কাজে ব্যয় না করে ইলম সাধনার তরে উৎসর্গ করেন। তিনি সবসময় বলতেন, “আমার জীবনে সবচেয়ে বড় উপকার করেছিলো সেই নাজরানের গভর্নর। সে যদি আমায় এ কাজে না ফাঁসাতো, বাগদাদ গিয়ে আমি যা শিখেছি, তা আমার অজানা ই থেকে যেতো!”
খলীফা হারুন অর রশীদ তাঁকে ৫০ হাজার দিনার দিলেন একটি সুসজ্জিত বাড়ি ক্রয় করবার জন্য, যাতে সেখানে তিনি নিরিবিলিতে বসবাস করতে পারেন। কিন্তু ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) কী করলেন জানতে চান? তিনি শহরের সকল ভিক্ষুকদের ডেকে এনে তাদের মাঝে সম্পূর্ণ অর্থ বিলিয়ে দিলেন। খলীফা ভাবলেন, হয়তো শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ওস্তাদ ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) ন্যায় শাসকের কাছ থেকে হাদীয়া গ্রহণ পছন্দ করছেন না। এবার তিনি তার দেহরক্ষীকে বলেন, সে যেনো ৫০ হাজার দিনার ইমামকে দিয়ে বলে যে সে নিজের পক্ষ থেকে এটি হাদীয়া দিয়েছে। ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এবারও গ্রহণ করলেন না। বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘যেখানে আমি খলীফার থেকেই তা গ্রহণ করিনি, কেমন করে আমি তা তোমার থেকে গ্রহণ করি!’
ইমাম শায়বানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইরাকী ফিক্বহের প্রচারক। তার কাছে ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ফিক্বহের নানা শাখা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। কিছুকাল পরে তিনি মক্কায় ফিরে গেলেন। পাঠদান শুরু করলেন আবারো। হজ্জ্বে আগত নানান শিক্ষার্থী, স্কলারদের সাথে পরিচয় হলো। এসময়েই ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম আশ শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) সান্নিধ্য লাভ করেন। দীর্ঘ নয় বছর মক্কায় কাটিয়ে ১৯৫ হিজরীতে দ্বিতীয়বারের মতো ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বাগদাদ সফর করেন। তাঁর দ্বারা প্রবর্তিত ফিক্বহ পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে এ সময়েই। তিনি ফিক্বহকে একটি পরিপূর্ণ শাস্ত্রে রূপ দেন। সম্পূরক কোন নীতি নয়, বরং সাধারণ নিয়ম প্রবর্তন করেন। এই সফরকালীন সময়েই তিনি ফিক্বহের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে “আর-রিসালাহ” বইটি কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। যা ফিক্বহের জগতে যুগান্তকারী অবদান হিসেবে আজও সমাদৃত।
আর রাজী উদ্ধৃত করেন, “জেনে রাখো, বাগদাদে থাকাকালীন ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) আর রিসালাহ রচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে মিশরে তিনি এটি পুনরায় সংশোধন করেন এবং উভয় সংস্করণই বিপুল জ্ঞানের ভান্ডার।” তাঁর রচিত এ গ্রন্থ তাঁকে এক ভিন্ন মর্যাদায় আসীন করে। এটি ছিলো ফিক্বহের অনন্য এক গ্রন্থ।
বাগদাদের সর্বশেষ সফরে ইমাম আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বল্প সময় অবস্থান করেন। বাগদাদ থেকে মিশরে স্থানান্তরিত হবার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো খলীফা আল মামুনের দ্বারা সর্বপ্রথম সরকারি ভাবে ভ্রান্ত মতবাদ অনুসরণকারী মু’তাজিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা। ফেতনা থেকে দূরে থাকতে চাইলেন তিনি। খলীফা মামুন তাঁকে কাজী হবার প্রস্তাব দেয়। তিনি জানতেন এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া হলে তার উপর ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিকের ন্যায় নির্যাতন নেমে আসবে। অন্যদিকে ফিরাসাহ’র বদৌলতে তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের অন্তর্নিহিত প্রতিভা বুঝতে পারছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর যোগ্য ছাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাই তাঁর উপর সব দায়িত্ব ন্যস্ত করে তিনি মিশর গমন করেন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন।
আরবী ভাষা সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিলো। শাব্দিক গুঢ় অর্থ বুঝতে তিনি সমর্থ হতেন। তার পাঠদান পদ্ধতি থেকে তাঁর এ বিশেষ জ্ঞান আঁচ পাওয়া যেতো। তাঁর ছাত্রেরা বলেন, “যখন ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাফসীর এর পাঠদান করতেন, মনে হতো যেনো তিনি আয়াতের নিহিত অর্থ চাক্ষুষ দেখছেন।”
ইমাম আশ-শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) ব্যতিক্রমী অর্জনের মাঝে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিলো ইলম- উল আনসাব। বাংলায় যাকে বলা হয় বংশতালিকা সম্পর্কিত জ্ঞান। মিশরে তাঁর সাথে দেখা হয় বহুল প্রচলিত সীরাত গ্রন্থ রচয়িতা ইবনে হিশামের (রাহিমাহুল্লাহ)। ইবনে হিশাম স্বয়ং ছিলেন ইলমের এ সেক্টরে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “ইলমুল আনসাবে পারদর্শী হবার ক্ষেত্রে ইমাম আশ শাফেঈ’র মতো ওস্তাদ কাউকে আমি কখনো দেখিনি, যিনি এমনকি পিতৃসূত্র মুখস্থকরণের পাশাপাশি মাতৃসূত্রীয় বংশপঞ্জি ও আয়ত্ত করতেন।”
ফতোয়া গ্রহণের ক্ষেত্রে ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) ন্যায় তিনিও কোরআন ও সুন্নাহকে প্রায়োরিটি দিতেন। মদীনায় ততোদিনে ফিক্বহের বিভিন্ন শাখা অনুসৃত মতবাদ প্রচলিত হয়ে যাওয়ায় তাদের চর্চায় বহু মতের মিশেল ঘটেছিল। তাই তিনি মদীনার লোকেদের সুন্নাহকে স্বীয় ফিক্বহপদ্ধতির অন্তর্গত করেননি। ইমাম নববী বলেন, ‘শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) সবসময় ছড়ি বহন করতেন। আমরা এ ক্ষণস্থায়ী জগতের মুসাফির, সর্বদা তা মনে জাগ্রত রাখবার জন্য তিনি এ কাজ করতেন।’
তাঁকে কেউ বয়স জিজ্ঞেস করলে তিনি সেই ব্যক্তিকে তার নিজস্ব কাজে মন দেবার উপদেশ দিতেন। এ শিক্ষা তিনি ইমাম মালিকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কেননা, ইলম অন্বেষণকারীদের বয়স জানা থাকলে, কম বয়সীরা পুরনো যুগের মানুষ বলে উপেক্ষা করতে এবং বয়সে বড় লোকেরা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রতি একশো বছরের শিরোভাগে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মতের জন্য তার দ্বীনকে সঞ্জীবিত করবেন।” [সুনানে আবু দাউদঃ৪২৯১]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “উমর ইবন আব্দুল আজিজ (রহঃ) ছিলেন প্রথম শতকের মুজাদ্দিদ আর আমি আশা করি এই শতকের মুজাদ্দিদ হলেন ইমাম আশ শাফে’ঈ।” ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর প্রশংসা করেছিলেন এবং অনাগত ভবিষ্যতে ইলমের জগতে তিনি যে সমাদৃত হবেন তা বুঝতে পেরেছিলেন। দিনের সমস্ত সময় তিনি পাঠদানে মনোনিবেশ করতেন। ইলমের বিভিন্ন শাখার লোকেরা তার কাছে জ্ঞানলাভ করতে আসতো। রাবি’আ ইবন সুলাইমান বলেন, “আশ শাফে’ঈ সুবহে সাদিকের পর পর ই তাঁর পাঠচক্রে বসতেন। তখন তাঁর কাছে কোরআনের ছাত্রদের আগমন হতো। সূর্য উঠবার পর তারা চলে যেতো এবং লোকেরা হাদীসের অর্থ, ব্যাখ্যা জানবার নিমিত্তে আসতো। সূর্য একটু চড়া হলে বিতর্ক ও বিশ্লেষণ সংক্রান্ত শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটতো। এরপর মধ্যপ্রভাতে কাব্য, আরবী ভাষা শিক্ষা, ব্যাকরণশৈলী সম্পর্কিত পাঠচর্চা হতো। এভাবে তা ক্রমাগত চলতেই থাকতো দুপুর হবার আগ পর্যন্ত।”
আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) সুকন্ঠের অধিকারী ছিলেন। একজন সুবক্তা হবার জন্য যেসব গুণ প্রয়োজন তার সবগুলোই তাঁর মাঝে উপস্থিত ছিলো। কাব্যিক ভাষাশৈলীর ব্যবহার তাঁর কথাকে আরো শ্রুতিমধুর করে তুলতো। এ গুণ তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বনু হুদায়েল গোত্র থেকে। শ্রোতা তার কথা সম্মোহিতের মতো শুনতো। তিনি যখন পাঠদান করতেন, এমনকি বেদুইনেরাও মুগ্ধ হয়ে তাঁর পাঠে মনোনিবেশ করতো। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তোমরা কি ইসলামের কথা শুনতে এসেছো?’ জবাবে তারা বললো, ‘আমরা তো শাফে’ঈর কথা শুনতে এসেছি। দেখো না, সে কি চমৎকার ভাবে কথা বলে!’
স্বীয় শিক্ষক ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) ন্যায় তিনিও ‘ফিরাসাত’ বা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। যা কিনা একজন বিতার্কিকের জন্য অধিক প্রয়োজনীয় একটি গুণ। এ গুণ প্রয়োগ করে তিনি লোকেদের অন্তর্নিহিত অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞাত হতেন এবং কে কোন বিষয়ে কতোটা সক্ষম হতে পারবে সে ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করতেন।
নশ্বর এ দুনিয়ার যাবতীয় কলুষতা থেকে মুক্ত একটি শুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন ইমাম আশ-শাফেঈ (রহিমাহুল্লাহ)। তাঁর অন্তরে ছিলো জ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালোবাসা। ছিলেন একজন সত্যান্বেষী। অকাট্য সত্যের খোঁজ পাবার পর তা যদি প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে ও যেতো, তবুও তিনি নির্ভীকভাবে সত্যের প্রচার ও প্রসার চালিয়ে যেতেন। প্রতিষ্ঠা করতেন পরম সত্যকে। এ নীতির উপর অটল থাকবার কারণে তাঁকে সময়ে সময়ে নানা ভ্রান্ত মতাদর্শীদের সমর্থক রূপে গণ্য করা হতো। কিন্তু তিনি সেসবে কখনো কান দিতেন না।
নিঃসন্দেহে দেশ বিদেশে ভ্রমণ একজন ফক্বীহর জন্য অশেষ উপকারী। তা চিন্তার খোরাক জোগায়, ভাবনার দুয়ার প্রশস্ত করে, সূক্ষ্ম বিষয় গুলো ভাববার প্রয়াস করে দেয়। ইমাম আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর জীবনে বেশ অনেকটা সময় ভ্রমণে কাটিয়েছেন। এ সময়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন জ্ঞানপিপাসা নিবারণে, সেখানকার অধিবাসীদের স্বভাব, আচরণ পর্যবেক্ষণ করে।
তিনি ইমাম লাইস ইবন সাদের (রহিমাহুল্লাহ) ফিক্বহ সম্বন্ধে বিস্তর পড়াশোনা করেন। ইমাম আবু হানিফাকে (রাহিমাহুল্লাহ) বিশদভাবে জানেন, বাগদাদ থাকাকালীন আশ শায়বানীর (রাহিমাহুল্লাহ) সান্নিধ্য লাভ করে। অধিকা জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আবু হানিফা ও ইমাম আবু লায়লার মধ্যকার মতের অমিল নিয়ে ক্বাজী আবু ইউসুফ রচিত বইসহ আরো অনেক গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। সাধারণভাবে বলা যায়, তাঁর সময়ে প্রচলিত সকল ধরণের দর্শন সম্বন্ধে ই তিনি জ্ঞানার্জন করেছেন।
আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এমন সকল কিছু পরিশীলন করেছিলেন যা এমন একজন ফক্বীহের জন্য উপকারী হতে পারে, যিনি কোরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে একটি আইনসম্মত দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চান। এমনকি তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের চর্চা ও করেছেন। ছিলেন একজন সুদক্ষ চিকিৎসক।
ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন বিতর্কে পারদর্শী একজন ব্যক্তি। কিন্তু তিনি কখনো জয়ী হবার উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক করতেন না বরং উদ্দেশ্য থাকতো সত্যকে জয়ী করা। তিনি কখনোই চাইতেন না প্রতিপক্ষ অসতর্কতাবশত ভুল করুক। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তিনি সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতেন। স্বাভাবিক স্বরে, ঠান্ডা মেজাজে কথা বলতেন বিতর্কের সময়েও।
একবার আবু ইউনুস সিদ্দি নামের একজনের সাথে তিনি বিতর্ক করেন। বিতর্কে পরাজিত হয়ে সে রাগে ক্ষোভে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসবার সময় ইমাম শাফে’ঈ তার হাত ধরে বললেন, “ যদিও আমরা কিছু ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি, তাই বলে কি আমরা দ্বীনি ভাই নয়?” এভাবে সবসময়ই তিনি নরম, আন্তরিক ব্যবহার দ্বারা প্রতিপক্ষের মন জয় করে নিতেন।
ইমাম আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) মিশরে যাবার পর মালিকী মাজহাবের অনুসারীদের প্রত্যাশা ছিলো যে তিনি স্বীয় শিক্ষকের ফিক্বহের প্রসারে অবদান রাখবেন। কিন্তু তারা যখনই তাকে নিজস্ব চিন্তাচেতনার চর্চাকারী হিসেবে দেখলো, গোঁড়া মালিকী মাজহাবীরা তাকে শত্রু স্বরূপ দেখতে লাগলো। কেননা কিছু ক্ষেত্রে ইমাম মালিকের মতের সাথে তিনি ভিন্নতা পোষণ করতেন। ইমাম মালিক ছিলেন তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। অথচ জীবনের শেষ সময়ে এসে তাঁকে ‘মালিকী বিরোধী’ আখ্যা দেয়া হয়। মিশরে তিনি আমর ইবনে আল-আসের (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) মসজিদে শিক্ষা দান করতেন, যেখানে লাইস ইবনু সা’দ (রাহিমাহুল্লাহ) দরস দিতেন। এখানেই তিনি “কিতাবুল উম্ম” রচনা করেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর জন্য অধিক দু’আ করতেন। তাঁর পুত্রকে তিনি বলেনঃ “হে পুত্র! ইমাম শাফে’ঈ এ দুনিয়ার জন্য সূর্য এবং শরীরের জন্য সুস্বাস্থ্য স্বরূপ। যা কখনোই পুনরুদ্ধারযোগ্য নয়।” ২০৪ হিজরীর এক শুক্রবারে ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবনে একটি বড় আক্ষেপ ছিলো যে, তিনি ইমাম লাইস ইবনু সা’দের (রাহিমাহুল্লাহ) সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন নি। তাই তাঁকে লাইস ইবনু সা’দের পাশে কবরস্থ করা হয়। তিনি সময়ের যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তাই ৫৪ বছর বয়সেই ইলমের জগতে রেখে গিয়েছেন যুগান্তকারী অবদান। তিনি বলে গিয়েছেন, “সময় হলো তরবারির ন্যায়। যদি তুমি সময়কে কাটতে না পারো, তবে তোমাকেই তা কেটে ফেলবে।”
ইমাম আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইলমের জগতের এক প্রজ্বলিত তারকা। তাঁর জ্ঞানের আলোকচ্ছটা এতোই দীপ্তিময়, যুগের সকলেই তাঁকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হিসেবে স্বীকার করেছেন। ইলমের সকল শাখায় পদচারণা করবার মাধ্যমে স্বীয় জ্ঞানপিপাসা করেছেন নিবারণ.. এ পথে ছুটে চলেছেন অবিরাম, নিরন্তর। জ্ঞানার্জনের মহান সংকল্প সাধনের ক্ষেত্রে তাঁর সমগ্র জীবনের প্রচেষ্টা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে যুগে যুগে।