যুগে যুগে ইলম সাধকেরা জ্ঞানের মশাল জ্বেলে ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য উন্মোচন করে গিয়েছেন নতুন দুয়ার। এ পথে চলতে গিয়ে মোকাবিলা করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সাথে, পড়তে হয়েছে শাসকের রোষানলে। জাগতিক মোহ, মায়া থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে পারে কয়জন? ব্যতিক্রমী এ বৈশিষ্ট্যকে স্বাতন্ত্র্য রূপে নিজের মাঝে পরিপূর্ণ ভাবে ধারণ করেছিলেন ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)।
‘যুহদ’ বা দুনিয়াবিমুখতার স্বরূপকে দিয়েছিলেন এক অনন্য মাত্রা। সবার কাছে অর্জন করেছিলেন বিশেষ মর্যাদা। ইসলামী জ্ঞানের দুনিয়ার চারজন ইমাম, যারা দিশারী রূপে পথ দেখিয়ে গিয়েছেন মুসলিম উম্মাহ’কে- তাদের মধ্যে সর্বাধিক বৈচিত্র্যে ভরপুর জীবন ছিলো তাঁর।
১৬৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস। জ্ঞান সাধনার তীর্থস্থান হিসেবে সমধিক পরিচিত, মুসলিম খিলাফাতের রাজধানী শহর বাগদাদে জন্মগ্রহণ করলো এক নবজাতক- পরবর্তী সময়ে যিনি হয়ে ওঠেন “আহলুস সুন্নাহ’র ইমাম”। মাতা সাফিয়্যা বিনতে মাইমুনা ও পিতা মুহাম্মদ ইবন হাম্বল। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ‘আহমদ’। পুরো নাম আহমদ ইবন মুহাম্মদ ইবন হাম্বল ইবন হিলাল। কুনিয়াত ‘আবু আবদুল্লাহ’। মা ও বাবা উভয় বংশসূত্রের দিক দিয়েই তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ আরব গোষ্ঠী “শায়বানী” গোত্রীয়। মুসান্না ইবনে হারিসা, আবু বকরের (রাঃ) শাসনামলে পারসিকদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে সেনাপতির কঠিন দায়িত্ব পালন করা সেই বীর যোদ্ধা, ছিলেন শায়বানী গোত্রের।
ইমাম আহমদের (রাহিমাহুল্লাহ) দাদা, হাম্বল ইবন হিলাল ছিলেন উমাইয়্যা খেলাফতের একজন গভর্নর। আরবে প্রচলিত, বংশের মর্যাদাবান পুরুষের নামে পরিচিত হবার রীতি অনুযায়ী, ইমাম আহমদের নামের শেষে তাঁর দাদার নাম জুড়ে দেয়া হয়। এভাবেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন আহমদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) নামে। আহমদের (রাহিমাহুল্লাহ) মাঝে ছিলো পাঁচটি এমন গুণ, যা শুধুমাত্র এমন ব্যক্তিকেই ভূষিত করে যিনি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এবং সহজাত আভিজাত্যের অধিকারী। তা হলোঃ উচ্চ বংশ, অল্প বয়সেই ইয়াতিম হওয়া, আত্মনির্ভরতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা।
সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে উঠলেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন বাগদাদ থেকে। কোরআনকে হৃদয়ে ধারণ করে সে শিক্ষায় আলোকিত হন ছোট বয়সেই। জীবনের প্রারম্ভিক সময় থেকেই বিশ্বস্ত, আল্লাহভীরু এক বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন এবং এ গুণসমূহ তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিলো জীবনের অন্তিম বেলা পর্যন্ত।
তাঁর আদব, বিনয়, সততা, সুমিষ্ট ব্যবহারের কারণে সবাই তাঁকে অন্য কিশোরদের চাইতে আলাদা দৃষ্টিতে দেখতেন। সমবয়সী ছেলেদের পিতার কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ স্বরূপ। একজন পিতা আফসোস করে বলতেন, “আমি আমার সন্তানদেরকে পড়ানোর জন্য বাসায় শিক্ষক রেখেছি। কিন্তু তারা তো তেমন ভালো করতে পারে নি। অথচ দেখো আহমাদ ইয়াতিম হওয়া সত্ত্বেও কেমন এগিয়ে গেছে! তাঁর জ্ঞানার্জন, ব্যবহার দুটোই প্রশংসনীয়।” প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সরকারী ভবনে লেখালেখির কাজ করবার সুযোগ পান।
বাগদাদে বসবাস করবার সুবাদে জ্ঞানের এক বিশাল দুয়ার তার সামনে উন্মুক্ত ছিলো। তখন ইসলামী জ্ঞানার্জন ও গবেষণার দুটো প্রধান ধারা প্রচলিত ছিলো।
- ১) আহলুল হাদীস- সুন্নাহ ও রাসূল(সাঃ) এর হাদীস দ্বারা প্রভাবিত।
- ২) আহলু’র রাঈ- প্রধানত বাণীসমূহ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূলনীতি প্রণয়ন ও যৌক্তিকতার নিরিখে জ্ঞানচর্চা।
আহমাদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) শুরুতে কিছুদিন মাদরাসাতুল আহলু’র রাঈ-তে পড়াশোনা করেন, যা তাকে বিশ্লেষণধর্মী করে তোলে। পরবর্তীতে হাদীসশাস্ত্রের চর্চায় নিজেকে পরিপূর্ণ রূপে নিবেদিত করেন তিনি। শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকে ক্বাজী আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন তাঁর শিক্ষক। যিনি ছিলেন ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) সুযোগ্য ছাত্র।
পরবর্তীতে এর পাশাপাশি হাদীস শিক্ষকদের কাছে যাওয়া শুরু করলেন। জীবনের অন্তিম সময় অবধি চালিয়ে যাওয়া হাদীস অন্বেষণ এর পাঠ মূলত শুরু করেন ১৬ বছর বয়সে। আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনের প্রথম দিকের হাদীস শিক্ষক ছিলেন হুশায়ম ইবনে বশির (রাহিমাহুল্লাহ)। হাদীস সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে তিনি গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, হাদীসের পাঠ শিখতে গিয়ে ইরাক্বী ফিক্বহ, ফতোয়াসমূহ সম্বন্ধে তিনি বেখবর থাকতেন! বরং ফিক্বহী জ্ঞানে তিনি বেশ সমৃদ্ধই ছিলেন, যদিও তাঁর প্রধান আগ্রহ ছিলো হাদীস অধ্যয়ন।
আহমদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)! হাদীস অন্বেষণ কে স্বীয় জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে গোটা জীবন এর জন্য ব্যয় করতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন। ইরাক, সিরিয়া, হিজায, কুফার অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে। সম্ভবত তিনিই প্রথম মুহাদ্দিস ছিলেন, যিনি মুসলিম বিশ্বের সকল অঞ্চল থেকে হাদীস সংগ্রহ করে তা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর লিখিত মুসনাদ-টিই এ ধারণার প্রমাণ দেয়।
দীর্ঘ সাত বছর বাগদাদের স্কলারদের নিকট হতে হাদীস, ফতোয়া, বিভিন্ন ইস্যুতে সাহাবীদের মতামত সহ ফিক্বহের নানান শাখা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেন। এসময় তাঁর প্রধান উস্তাদ ছিলেন উস্তাদ হুশায়ম। এছাড়া ও আবদুর রহমান ইবনে মাহদী, আবদুল্লাহ ইবনে মাহদি, আবু বক্বর ইবনে আব্বাস(রাহিমাহুমুল্লাহ)সহ আরো বিদ্বান শায়খদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। উস্তাদ হুশায়মের (রহিমাহুল্লাহ) কাছে আহমাদ ১৮২ হিজরীতে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাদীস সম্পর্কিত বিস্তর জ্ঞান লাভ করেন, যদিও সে তুলনায় এসময়ে লব্ধ ফিক্বহের পাঠ ছিলো যৎসামান্য। এই জ্ঞান ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় ইমাম শাফে’ঈর সান্নিধ্য লাভের পর!
১৮৬ হিজরিতে যাত্রা শুরু করেন বসরার উদ্দেশ্যে। সেইই ছিলো শুরু। এরপর থামেননি আর। ছুটে চলেছেন পিপাসার্ত পথিকের ন্যায়। এ যাত্রা ছিলো না কোন সহজসাধ্য সফর! তা ছিলো জ্ঞানের পেয়ালা অকুন্ঠচিত্তে পান করবার এক দুরূহ প্রয়াস। পদে পদে মোকাবিলা করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সাথে। তবু তিনি পিছপা হননি। চিরকালের জন্য আর্থিক দৈন্যতাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন। হজ্জ করবার জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন পাঁচবার! তন্মধ্যে তিন বার, বাগদাদ ও মক্কার মধ্যবর্তী ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব, অতিক্রম করেন পায়ে হেঁটে! ভাবা যায়?
মক্কায় প্রথমবার হজ্জ্ব করতে গেলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে জ্ঞানের সূর্য ইমাম শাফে’ঈর(রহিমাহুল্লাহ)। শাফে’ঈর জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। ফিক্বহ সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে মনে প্রশ্নের উদ্ভাবন হলে তিনি ইমাম শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) শরণাপন্ন হতেন। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ’র কাছে হাদীস শিখবার পাশাপাশি তিনি শাফে’ঈর কাছে ফিক্বহী নীতি ও আয়াতসমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যা চর্চা করেন।
ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলেন, -আমরা সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ’র ক্লাস করছিলাম। আহমাদ আমাকে এসে বললেন, ‘চলো। তোমাকে আজ একজন এর কাছে নিয়ে যাবো। আমি নিশ্চিত তাঁর মতো কোন ব্যক্তির দেখা তুমি আগে পাওনি।’ এই বলে তিনি আমাকে জমজমের পাশে নিয়ে যান। সেখানে শ্বেতশুভ্র পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি ক্লাস নিচ্ছিলেন। তাঁর মুখ ছিলো উদ্ভাসিত, দীপ্তিময়। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। কিছুক্ষণ পর আমি আমাদের ক্লাসে ফেরত যেতে চাইলে আহমাদ বললেন, “ইনিই আমার শায়খ।” আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। “তুমি এমন কাউকে ছেড়ে আসতে চাইছো যিনি আয যুহরীর থেকে হাদীস বর্ণনা করেন! যিনি কিনা ইমাম শাফে’ঈর গুরু ইমাম মালিকের শিক্ষক! আর ইনি তো কেবল একজন নবীন!” তিনি আমাকে বললেন, “হে আবু ইয়াকুব! তাঁর কাছ থেকে নির্দ্বিধায় জ্ঞান কুড়াতে পারো। তাঁর সমতুল্য কাউকে আমার এ চক্ষুদ্বয় এখনো দেখেনি।”
আশ শাফে’ঈর (রহিমাহুল্লাহ) প্রতি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রাহিমাহুল্লাহ) এ শ্রদ্ধা ছিলো তাঁর ফিক্বহী জ্ঞানের কারণে। পরবর্তীকালে বাগদাদে ইমাম শাফে’ঈর আগমন ঘটলে আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর সাথে পুরোটা সময় ব্যয় করতেন। তিনি তাঁর সাথে অধ্যয়নে বসতেন, আলোচনা করতেন এবং শাফে’ঈর মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্য লিপিবদ্ধ করতেন ও তা থেকে শিখতেন। ইমাম আহমাদের (রহিমাহুল্লাহ) পুত্রের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, ইমাম শাফে’ঈর (রাহিমাহুল্লাহ) বাগদাদ অবস্থানকালে তাঁর পিতা ঐচ্ছিক ইবাদাতগুলো আদায় করতেন না। কেননা তিনি চাইতেন, সম্পূর্ণ সময় কাজে লাগিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে।
ইমাম শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ের ব্যাপারে ইমাম আহমদের (রাহিমাহুল্লাহ) উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভর করতেন। বাগদাদ ছেড়ে যাবার সময় তাঁকে তিনি বলে যানঃ “হে আবূ আবদুল্লাহ ! আপনার দৃষ্টিতে যখনই কোন হাদীস সহীহ মানে উন্নীত হবে আপনি তা আমাকে অবশ্যই জানাবেন।” অর্থাৎ, যদিও ইমাম শাফে’ঈ ছিলেন আহমাদের শিক্ষক, তবুও শাফে’ঈ রহিমাহুল্লাহ হাদীসের মান নির্ণয়ে তাঁকে উস্তাদ রূপে গণ্য করতেন।
ইমাম আহমাদের (রাহিমাহুল্লাহ) মাঝে একটি চমৎকার গুণ ছিলো। তা হলো- অধ্যবসায়, দৃঢ়সংকল্প। কোনকিছু করবার জন্য মনস্থির করলে তা সম্পন্ন করে তবেই ক্ষান্ত হতেন। যতো বাঁধা ই সামনে আসুক, কখনো হাল ছাড়তেন না। ১৯৮ হিজরীতে তিনি শেষবার হজ্জ্ব করেন। উদ্দেশ্য ছিলো- সান’আয় যাবেন, উস্তাদ আবদুর রাযযাক ইবনে হিমামের কাছে হাদীস শিখবেন। পথিমধ্যে হজ্জ্ব করবার সময় ঘটলো এক চমৎকার ঘটনা! ক্বাবা তাওয়াফ করবার সময় তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন দেখতে পেলেন উস্তাদ রাযযাক ও হজ্জ্ব করতে এসেছেন। তিনি তো মহাখুশি। যাক! কষ্ট করে আর তাহলে ইয়েমেনে যেতে হবে না! তিনি উস্তাদের সাথে কথা বলে পরবর্তী দিন দেখা করার সময় নির্ধারণ করে নিলেন।
এরপর ইমাম আহমাদ যা বললেন, তা শুনবার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না! আহমাদ বললেন, “আমি আমার নিয়্যাত করে ফেলেছি আবদুর রাযযাকের সাথে সান’আয় গিয়ে দেখা করবো। আর জ্ঞান মানুষের কাছে আসে না, মানুষই জ্ঞানের কাছে যায়।” তিনি হজ্জ্ব শেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সান’আয় গিয়ে তবেই উস্তাদ রাযযাকের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে হাদীস শিখেছিলেন।
২০৪ হিজরী। চল্লিশ বছরে পা দিলেন আহমাদ। এ সময়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন শুধুই একজন ত্বলিবুল ‘ইলম। ছাত্র হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এ ভাবনা থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করে গিয়েছেন। তিনি বলতেন, “সে ই জ্ঞানী, যে জ্ঞান অন্বেষণ করে। আর যে মনে করে, অর্জিত জ্ঞান তাঁর জন্য যথেষ্ট- সে আসলে নিতান্ত ই বোকা।” চল্লিশ বছর বয়সে তিনি শিক্ষক হিসেবে ‘হালাক্বাহ’ পরিচালনা করা শুরু করলেন। রাসূল(সাঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণে তিনি অধিক নিষ্ঠাবান ছিলেন। নবী মুহাম্মদ(সাঃ) চল্লিশ বছর বয়সে আল্লাহর কাছ থেকে নবুয়্যত প্রাপ্ত হন। উম্মতের শিক্ষক রূপে দায়িত্ব পালন করবার জন্য আল্লাহর দ্বারা আদিষ্ট হন। তাই ইমাম আহমাদ শিক্ষকের আসনে বসবার জন্য এ বয়সকেই বেছে নেন।
বাগদাদের বিশাল মসজিদে তিনি ক্লাস নিতেন। বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, প্রায় পাঁচ হাজার শ্রোতা তাঁর হাদীসের মজলিসে যোগদান করতো। এদের মাঝে সবাইই কি হাদীসের শিক্ষার্থী ছিলো? না! বরং মাত্র পাঁচশো মানুষ তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্য নোট করতেন। বাকিরা জড়ো হতেন তাঁর মুগ্ধকর বাচনভঙ্গি, আদব শেখার জন্য। তাঁর মজলিসে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রশান্ত পরিবেশ বজায় থাকতো। আহমাদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) পাঠদানের সময় অহেতুক হাস্যরস, কৌতুক একদম ই অপছন্দ করতেন। তাঁর ছাত্র, শিক্ষক সকলেই তাঁর এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত ছিলো। শায়খগণ আহমাদ উপস্থিত থাকাবস্থায় মজার ছলে কোন কথা বলতেন না। ছাত্রেরা ও তাঁকে সমীহ করে চলতো।
কারো কাছ থেকে ঋণ নেবার ক্ষেত্রে তিনি অত্যাধিক কঠোর নীতি অবলম্বন করতেন। ইয়েমেনে উস্তাদ আবদুর রাযযাক ইবনে হিমানে’র কাছে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি অর্থসংকটে পড়েন। সেখানে অর্থোপার্জন মোটেও সহজ ছিলো না। সান’আয় পৌঁছাবার পর আবদুর রাযযাক (রহিমাহুল্লাহ) আহমাদকে (রাহিমাহুল্লাহ) কিছু দিনার দিয়ে বললেন, “ এটা রাখো। আমরা এমন ভূমিতে রয়েছি যেখানে টাকা উপার্জন এতো সহজ নয়।” বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে বললেন, “আমি স্বাচ্ছন্দ্যে আছি। এ অর্থের প্রয়োজন নেই।”
দারিদ্র্যকে তিনি স্বচ্ছলতার উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কেননা তিনি অর্থসম্পদের উৎস, বৈধতা সম্পর্কে অনেক বেশি চিন্তিত থাকতেন। কারো কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করতেন না। এমনকি খলীফাদের হাদীয়া ও নাকচ করে দিতেন। জীবন যাপনের জন্য তাকে বিভিন্ন কাজে রত হতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। কখনো লোকেদের জিনিসের বোঝা ঘাড়ে বহন, কখনো শস্যের কুঁড়ো সংগ্রহ করবার কাজ করেছেন। জীবনের পদে পদে আসা নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠেছেন সবর ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল অবলম্বন করে।
আয যাহাবী, আলী ইবনে আল যাহম থেকে বর্ণনা করেনঃ “আমাদের একজন প্রতিবেশী ছিলো। সে একটি বই আমাদের পাঠিয়ে জানতে চাইলো হস্তাক্ষর টি আমাদের পরিচিত কিনা। আমরা তা দেখেই চিনতে পারলাম! কারণ তা ছিলো আহমাদ ইবনে হাম্বলের লিখা! এ বই কিভাবে তাঁর কাছে আসলো জানার জন্য আমরা পীড়াপীড়ি শুরু করলাম। অতঃপর সে আমাদের ঘটনার বর্ণনা দিলো। সে বললো, ‘আহমাদ ইবনে হাম্বলের সাথে একই উস্তাদের কাছে আমরা অধ্যয়ন করতাম। হঠাৎ দেখা গেলো, কিছু দিন ধরে আহমাদ ক্লাসে আসছেন না। আমরা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ তিনি তো অনুপস্থিত হবার মতো নন। দল বেঁধে সবাই তার আবাসস্থলে গেলাম। বাহির থেকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তা আমাদের অবাক করেছিলো। বাহিরে যাবার জন্য পরিধেয় একমাত্র পোশাকটি চোর নিয়ে যাওয়ায় তিনি বের হতে পারছেন না! আমরা, তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে কিছু অর্থ ধার হিসেবে দিয়ে হলেও সাহায্য করতে চাইলাম; কিন্তু তিনি কোনভাবেই তা গ্রহণ করতে রাজি হলেন না! তখন আমার মাথায় একটি দারুণ বুদ্ধি আসলো। আমি তাঁকে বললাম, “বেশ অনেকদিন ধরে একটা বই অনুলিপি করতে চেয়েও আমি ফেলে রেখেছি। তুমি আমাকে সেটি লিখে দাও।” এবার ইমাম আহমাদ রাজি হয়ে গেলেন। এবং এর পারিশ্রমিক হিসেবে আমরা তাঁকে পোশাক ক্রয় করে দিলাম।’
জ্ঞানপিপাসা নিবারণের উদ্দেশ্যে তিনি কুফা গমন করেন। বাগদাদ থেকে কুফা শহরের দূরত্ব খুব একটা বেশি ছিলো না। তবুও এ যাত্রা তাঁর জন্য ছিলো নিদারুণ কষ্টসাধ্য ও দুরূহ। বালিশের অভাবে ইটে মাথা দিয়ে ঘুমাতে হয়েছিলো। তিনি আফসোস করে বলেন, “যদি আমার কাছে ৭০ দিরহাম থাকতো, আমি জারির ইবনে আবদুল হামিদের কাছে হাদীস শিখতে যেতাম।” এটা স্পষ্ট যে, হাদীসের পাঠ শেখার ক্ষেত্রে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। কেননা যা কিছু অনায়াসে আয়ত্ত করা হয়, তা হয়তো বিস্মৃত হতে পারে শীঘ্রই।
সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন ইমাম আহমাদ। কোথাও কোন ভুল হতে দেখলেই সংশোধন করবার জন্য সোচ্চার হতেন। মনুষ্য ভয়ে ভীত হয়ে কখনো নীরব থাকতেন না। একবার বাগদাদে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায় ‘নাবীস’কে এমনভাবে তৈরি করে বাজারজাত করলো, যা এলকোহলযুক্ত পানীয়ের কাছাকাছি গুণাগুণ সম্পন্ন ছিলো। লোকেরা সাতপাঁচ না ভেবে হালাল মনে করে তা পান করতে লাগলো। ব্যাপারটি আহমাদের নজরে এলে কালবিলম্ব না করে তিনি “কিতাবুল আশরিবাহ” রচনা করলেন। এরপর থেকে সবসময় তিনি তা সাথে নিয়ে বের হতেন। যেখানেই যেতেন, লোকেদের সতর্ক করতেন এ বিষয়ে।
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যুগে যুগে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ইমাম আহমাদের (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনেও এসেছিলো এমন এক পরীক্ষা, যা আল্লাহর কাছে, দুনিয়ার মানুষের কাছে তাঁর সম্মান, মর্যাদা অনেক বেশি বৃদ্ধি করেছিলো। সময়টা ছিলো আব্বাসী খলিফা আল মামুনের শাসনকাল। উমাইয়্যা খেলাফতকালে উদ্ভূত হওয়া এক ভ্রান্ত মতবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। মু’তাজিলা নামক একটি দল, যারা আল্লাহর গুণাবলিকে অস্বীকার করে- “কুরআন সৃষ্ট” এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলো।
খলীফা হারুন অর রশীদের সময় মু’তাজিলারা তাদের ভ্রান্ত মতবাদের দাওয়াত দানে সক্রিয় হওয়ায় শক্তভাবে তিনি এদের দমন করেন। কিন্তু খলীফা আল মামুনের মু’তাজিলাদের প্রতি ঝোঁক ছিলো। এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন তাঁর শিক্ষক, আবু হুদাইল আল আল্লাফ। তিনি মু’তাজিলাদের একজন নেতা ছিলেন! তাই তিনি খলীফা মামুনের মাথায় বিভ্রান্তিকর আকীদা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
আল মামুন ক্ষমতায় আসবার পর মু’তাজিলাদের বিতর্কে, যুক্তিতর্কের মারপ্যাঁচ দেখে পুরোপুরি তাদের দ্বারা কনভিন্স হয়ে যান। এমনকি তাদেরকে প্রশাসনিক পদেও নিযুক্ত করেন। মু’তাজিলা অনুসারীরা এবার বুঝতে পারলো তাদের রুখতে পারবে এমন কেউ এখন নেই! এবার তারা খলীফাকে নানা চাপ প্রয়োগ করে ২১৮ হিজরীতে মু’তাজিলা মতবাদকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে ঘোষণা করিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে যেই তা অস্বীকার করতে চাইতো, তার উপর নেমে আসতো নির্যাতনের পাহাড়। প্রথমে সরকারী কর্মকর্তাদের উপর এ নিয়ম বলপূর্বক প্রয়োগ করা হলেও পরবর্তীতে জনগণের উপর এ আদেশ বলবৎ হয়।
সকল মুফতি, ফক্বীহকে ডেকে আনা হয় রাজদরবারে। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ‘মু’তাজিলা’ মতবাদ গ্রহণ করবার কথা স্বীকার করাতে জোর করা হয়। কেবল চারজন ব্যতীত সকল আলেম চাপের মুখে তা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করবার জন্য টিকে রইলেন শুধু ইমাম আহমাদ! এ ছিলো এক মহান সংগ্রাম! ইসলামী আক্বীদার সংকটাপন্ন অবস্থায় তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্থির, অবিচল ছিলেন আহলুস সুন্নাহ’র নীতিতে। একটুও টলে যাননি; শাসকগোষ্ঠীর শত নির্যাতন সহ্য করে গিয়েছেন দৃঢ়তার সাথে।
পর পর তিনজন শাসকের পালাবদল ঘটে, যারা ছিলেন মু’তাজিলা সমর্থক। খলীফা মামুনের মৃত্যুর পর ভাই, মু’তাসিমকে নির্দেশ দিয়ে যান এ মতবাদ আঁকড়ে ধরতে। তিনি ইমাম আহমাদকে (রাহিমাহুল্লাহ) ডেকে পুনরায় হুমকি দিয়ে স্বীকার করাতে চান। কিন্তু কোন হুমকিতে কাজ না হওয়ায়, লড়াকু মনোভাবের খলীফা মু’তাসিম তাঁকে জেলে প্রেরণ করেন এবং নির্যাতনের স্টিমরোলার চালান তাঁর উপর। জ্ঞান হারানোর পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে প্রহার করা হতো। শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন দিন দিন। এভাবেই তাকে আটাশ মাস কারাগারে নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে মু’তাসিম তাঁর ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েন ও মুক্তি দিয়ে দেন। আঘাতে জর্জরিত, দিনের পর দিন অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা ইমাম আহমাদ ফিরে আসেন গৃহে।
জীবনে প্রথমবারের মতো চাবুক পেটা করা হবে, জানবার পর কিছুটা অস্বস্তি বোধ, চিন্তিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ইমাম আহমাদ ও কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এমন সময় কারাগারে থাকা একজন চোর, মদ্যপ ব্যক্তি তাঁকে এমন একটি কথা বললেন, যা তাঁকে ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান করে সত্যের পথে অটল অবিচল থাকবার শক্তি বৃদ্ধি করলো। কি ছিলো সেই কথা? লোকটি বলেছিলোঃ “দেখুন, শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আমি মদ খাই, চুরি করি। অথচ এতো নির্যাতন সয়ে ও এসব ছাড়িনি। আর আপনি তো আল্লাহর দ্বীনের পথে লড়াইয়ের জন্য এ শাস্তি পাচ্ছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে বিজয়ী করবেন।”
আল মু’তাসিমের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) যথারীতি তাঁর পাঠদান, মসজিদে হাদীসের মজলিস পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু আল-ওয়াসিক ক্ষমতায় আসবার পরেই নির্যাতন শুরু হলো নতুন রূপে। সকল ধরণের পাঠদানের প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়া হলো। গৃহবন্দী করা হলো ইমাম আহমাদকে(রহিমাহুল্লাহ)। খলীফা যেই শহরে থাকবেন, সেখানে তাঁর বসবাস নিষিদ্ধ করা হলো। তবে কিছু সময় পর, তাঁর মৃত্যু ঘটে। মুসলিম উম্মাহ রক্ষা পায় মু’তাজিলা নামক ভ্রান্ত মতবাদ থেকে! ইমাম আহমাদের (রাহিমাহুল্লাহ) অবিচল মনোভাব, দৃঢ়প্রত্যয়ী অবস্থান, নির্যাতন সইবার অপরিসীম ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ফিতনা থেকে পরিত্রাণ দেন।
ইমাম আশ শাফে’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ), আহমাদকে (রাহিমাহুল্লাহ) মিশর থেকে একটি চিঠি লিখে, রাবী’আ ইবনু সুলাইমানকে দিয়ে প্রেরণ করেন। চিঠিতে তিনি লিখেনঃ “রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আমার স্বপ্নে এসেছিলেন। তিনি তোমার প্রতি সালাম জানিয়েছেন এবং বললেন, আল্লাহ আহমাদকে পরীক্ষা করবেন। সে যদি আল্লাহর পথে অবিচল থাকে, বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়- আল্লাহ তাঁকে আখিরাতে মর্যাদার আসনে আসীন করবেন।”
এ চিঠি পড়ে আহমাদ কেঁদে ফেলেন এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে শুরু করেন। তাঁর নিষ্কম্প, নির্ভীক মনোভাব ছিলো আল্লাহর সাহায্য। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে পরীক্ষা করেন, এবং তিনি এর মাধ্যমে তাঁর সম্মান বৃদ্ধি করেন।
আলী ইবনে আল মাদানী এ ব্যাপারে উল্লেখ করেন- “আল্লাহ দু’জন মানুষের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করেছেন। রিদ্দার সময় আবু বকরকে (রাঃ) দিয়ে, আর মেহনার সময় আহমাদ ইবনে হাম্বলকে দিয়ে।” ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)স্বয়ং, তাঁর মাজহাবের প্রবক্তা ছিলেন না। পরবর্তীতে তাঁর ছাত্রেরা তাঁর মতামত গুলো নথিভুক্ত করেন এবং অনুসরণ করতে শুরু করেন।
তাঁর দেয়া ফতোয়া কেউ লিখে রাখবে- তা তিনি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতেন। তদুপরি, ইবনে হাম্বলের (রহিমাহুল্লাহ) ফতোয়াসমূহ একত্রীভূত করা হয়েছিলো। এ মহান কাজে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আবু বকর আল খাল্লাল(রহিমাহুল্লাহ)। অক্লান্ত পরিশ্রম করে, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আহমাদ ইবনে হাম্বলের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, ছাত্রদের নিকট হতে তিনি তাঁর ফতোয়া গুলো একত্রিত করেন। এই নিরলস শ্রমলব্ধ অবদানের কারণে তাঁকে হাম্বলী মাজহাবের প্রধান সংকলক ও প্রচারকারী বলা হয়ে থাকে। তাঁর এ সংগ্রহ ২০ ভলিউমের এক বিশাল গ্রন্থের আকার ধারণ করে, যেখানে তিনি আহমাদ ইবনে হাম্বলের বিভিন্ন বিষয়ে পোষণ করা অভিমত সমন্বিত করেছিলেন।
আশ শাফে’ঈ রহিমাহুল্লাহ’র জ্ঞানের প্রতি ছিলেন পরম শ্রদ্ধাশীল। তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে শাফে’ঈর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে এতো আলোচনা করতেন যে তাঁকে না দেখলেও আদ্যোপান্ত জানা ছিলো পরিবারের সকলের। একবার ইমাম শাফে’ঈ বাগদাদে এসে আহমাদের বাড়িতে রাত কাটাতে মনস্থির করলেন। তো, ইমাম আহমাদের কন্যা ভাবলেন, আমার বাবা যে তাঁর পান্ডিত্য নিয়ে এতো প্রশংসা করেন, দেখি তো তাঁর মাঝে কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে! মেয়েটি ইমাম শাফে’ঈর সব কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। খাবার দেয়া হলো.. শাফে’ঈ কম খাবার সুন্নাত পালন না করে তৃপ্তি সহকারে সব খাবার খেয়ে নিলেন। ওযুর জন্য নির্ধারিত পানি ব্যবহার তো করলেনই না, রাতে তাহাজ্জুদ ও আদায় করলেন না! ফজরের সময় আযান দিলে ওযু করা ছাড়াই নামাজ পড়ে নিলেন।
মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গেলো! ইনিই কি ইমাম শাফে’ঈ?! যার প্রশংসা তাঁর পিতা সবসময় করে থাকেন! দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বাবাকে গিয়ে সব কথা বললো। চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনিও। মেয়ের কৌতূহল মেটাতে ইমাম শাফে’ঈর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন যে তিনি কেনো এরূপ করেছেন! শাফে’ঈ রহিমাহুল্লাহ বললেন, “আসলে, আমি জানি পুরো বাগদাদে তোমার বাড়িতেই সবচেয়ে হালাল খানা পাওয়া যাবে। তাই আমি পেট ভরে খানা খেয়েছি। আর কাল রাতে একটি হাদীস থেকে উসুল বের করতে গিয়ে এত মনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন যে সারারাত নিদ্রা আমাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। এজন্য নামাজ পড়ার সময় আমাকে ওযু করতে হয়নি।”
ইমাম বাক্বী ইবন মাখলাদ (রহিমাহুল্লাহ) স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, “আমি দরজায় কড়া নাড়লাম। তিনি বাইরে এসে আমাকে দেখে পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম: “হে আবু আবদুল্লাহ! আমি একজন মানুষ যে নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এই শহরে প্রথম এসেছে। হাদীসের শিক্ষার্থী আমি। বিশেষভাবে উপকৃত হওয়ার জন্য অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে আপনার কাছে পৌঁছেছি।”
তিনি আমাকে বললেন: “ এমনভাবে আসুন যাতে কেউ আপনাকে না দেখে”। জিজ্ঞাসা করলেন: “আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” আমি জবাব দিলাম: “দূর পশ্চিম থেকে”। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: “আফ্রিকা থেকে?” আমি জবাবে বললাম: “এর থেকেও বেশি। আফ্রিকা যেতে আমার সমুদ্র পার হতে হয়, আমি স্পেনের আন্দালুস থেকে এসেছি।” তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন: “আপনার দেশ তো অনেক দূরে। আপনার মতো ব্যক্তিকে হাদীস শিখিয়ে সহায়তা করবার চাইতে আর কিছুই আমার কাছে প্রিয় নয়। তবে আপনি নিশ্চয়ই আমার নিষেধাজ্ঞাগুলির কথা শুনেছেন।”
বললাম:“বাগদাদে এসেই আমি এ ব্যাপারে শুনেছি, কিন্তু হে আবু আবদুল্লাহ! এই প্রথম আমি এখানে এসেছি। কেউই আমাকে চেনে না তাই যদি আপনি অনুমতি দেন আমি প্রতিদিন ভিক্ষুকের পোশাক পরে আসবো এবং দরজায় হাঁক দেবো যেমন তারা সাধারণত ডাক দেয়। যদি আপনি এই প্যাসেজে এসে আমার কাছে দিনে কেবল একটি হাদীস বর্ণনা করেন তবে তা ই আমার পক্ষে যথেষ্ট হবে। ” এই পরিকল্পনা তাঁর বেশ পছন্দ হলো। তিনি জবাব দিলেন: “আচ্ছা। তবে এই শর্তে যে আপনি আসহাবুল হাদীসের অন্য কোন সমাবেশ বা হালাকাহ (সমাবেশে) যেতে পারবেন না”। আমি বললাম: “যেমন আপনি চান”।
এরপর থেকে আমি আমার হাতে একটি লাঠি নিয়ে, মাথায় কাপড় জড়িয়ে, কাগজ এবং কালি আমার হাতাতে রেখে তার দরজার কাছে এসে ভিক্ষুকদের মতো ডাকাডাকি করতাম। অতঃপর তিনি এসে আমার কাছে দু-তিনটি হাদীস বর্ণনা করতেন এবং মাঝে মাঝে আরও বেশি ও বর্ণনা করতেন। এই পদ্ধতিতে আমি প্রায় 300 হাদীস সংগ্রহ করেছিলাম। নিষেধাজ্ঞার শেষ অবধি এবং ইমাম আহমদ (রহিমাহুল্লাহ) জনগণের মাঝে তাঁর মর্যাদা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমি এই উপায়ে হাদীস শিখেছি। পরে যখনই আমি তাঁর সমাবেশে যোগ দিতাম, তিনি আমাকে তাঁর পাশেই রাখতেন এবং আস-হাবুল হাদীসকে বলতেন: “এই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে হাদীসের ছাত্র হবার উপযুক্ত”।
কেউ তাঁর প্রশংসা করবে- এ কাজ ছিলো তাঁর সবচাইতে অপছন্দনীয়। লোকেদের মাঝে খ্যাতিমান হয়ে যাবার ভয়ে তিনি চাইতেন মক্কার কোন গিরিখাতে গিয়ে বসবাস করতে, যেখানে কেউ তাকে চিনবেও না। কারো প্রশংসা তাঁকে উদ্বেলিত করতো না, বরং তিনি ভীত হতেন আল্লাহর ভয়ে। কেননা তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা তো আল্লাহর জন্যই।
ইমাম আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন প্রথম হাদীস অন্বেষণকারী, যিনি কুফা, সিরিয়া, বসরা, হিজায- ইসলামী বিশ্বের জ্ঞানের প্রধান খনি হিসেবে পরিচিত এই চার অঞ্চল থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। তাঁর রচিত মুসনাদের লিপিবদ্ধকরণ কার্যক্রম তিনি গোটা জীবন জুড়েই চালিয়ে যান। আহমাদ সাধারণত লিখে রাখা পছন্দ করতেন না, কিন্তু ‘মুসনাদে আহমাদ’ রচনার কাজ তিনি শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই করে আসছিলেন। ইলমের জগতে এ গ্রন্থ ছিলো এক বৃহৎ সংযোজন। হাদীসের এনসাইক্লোপিডিয়া রূপে পরিচিত হাদীস শাস্ত্রের এই গ্রন্থ জ্ঞানপিপাসুদের কাছে পরম আরাধ্য।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাতের প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল ভালোবাসা। যেকোন ক্ষুদ্র কাজ ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণ করে করতে পছন্দ করতেন। একবার তিনি হিজামা করে হিজামাকারীকে এক দিনার মূল্য পরিশোধ করলেন। এক দিনার দান করাটা ছিলো বেশি। তবুও তিনি তা করেছিলেন রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে। “রাসূলুল্লাহ(সাঃ) একবার আবু তায়বাকে(রাঃ) দিয়ে হিজামা করান। বিনিময়ে তাঁকে এক দিনার পরিমাণ সমপরিমাণ খেজুর দেন।” [সহীহ বুখারীঃ ২১০২]
ইবরাহীম ইবনে ইসহাক আল হারবী (রহিমাহুল্লাহ) রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ সংরক্ষণে অবদান রাখা মহান ব্যক্তিদের নামোল্লেখ করতে গিয়ে বলেনঃ “সা’আদ ইবনে মুসাইয়্যেব, সুফিয়ান আস সাওরি এবং আহমাদ ইবনে হাম্বল (প্রত্যেকে যার যার নিজস্ব সময়ে)।” একজন মুফতি (যিনি ফতোয়া প্রদান করেন) হবার জন্য কী কী বৈশিষ্ট্যাবলী থাকা জরুরি, তা ইমাম আহমাদ বর্ণনা করে গিয়েছেন। তিনি বলেনঃ “একজন ব্যক্তি নিজেকে ফতোয়া দেবার জন্য যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না, যতোক্ষণ না তার মাঝে পাঁচটি গুনাবলীর সম্মিলন ঘটে। তাঁর স্পষ্ট, নেক অভিলাষ থাকতে হবে। যদি তা না হয়, সে আলোর দেখা পাবে না। তাঁকে জ্ঞান, ধৈর্য, ভাবগাম্ভীর্য, প্রশান্ত ভাবের অধিকারী হতে হবে। জ্ঞানার্জন এর পথে অটল থেকে পোক্ত রূপে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কারো প্রতি নির্ভরশীল হওয়া চলবে না, বরং স্বাধীনচেতা মনোভাব পোষণ করতে হবে। এবং অবশ্যই তাঁকে সবার মাঝে পরিচিত হতে হবে।” তিনি স্বয়ং উপরোল্লিখিত সব গুণাবলীর সমাবেশ প্রশংসনীয় রূপে প্রতিফলিত করেছিলেন নিজের জীবনে।
ইমাম আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) ন্যায় ইমাম আহমাদও (রহিমাহুল্লাহ) জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত খলীফার নিকট হতে কিছু গ্রহণ না করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অসীয়্যত করে যান, কাফনের কাপড় ক্রয়ে যেনো খলীফার কিঞ্চিৎ আর্থিক সহায়তায় ও না থাকে। বলে যান, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া যেনো পারিবারিকে অর্থায়নে সম্পন্ন করা হয়। ইলম জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ। রাসূল(সাঃ) এর সুন্নাহ’র পাবন্দ ছিলেন আজীবন। পবিত্র জুম’আবারে, ১২ই রবিউল আউয়াল, ২৪১ হিজরীতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন তিনি। তৎকালীন সময়ের ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লোকের অংশগ্রহণে জানাজা হয়েছিলো যুগশ্রেষ্ঠ আহ্লুস সুন্নাহ’র ইমাম, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রহিমাহুল্লাহ)।