ইসলাম নিয়ে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে জানতে চান। তারা ইসলামকে জানার জন্য পড়াশোনা করতে চান, বই খুঁজেন। কারো মধ্যে দ্বীনের বুঝ আসার পর পড়াশোনা করতে চান, কেউ দ্বীনে ফিরতে পড়াশোনা করতে চান। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের (নারী-পুরুষ) উপর ফরজ।” [সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৪]
ইসলাম জ্ঞানের ধর্ম। জ্ঞানার্জন ছাড়া আপনি ইসলাম ধর্ম মেনে চলতে পারবেন না। নামাজ পড়তে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে, রোজা রাখতে হলেও জ্ঞানার্জন করতে হবে। যারা জ্ঞানার্জন করে তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য রাস্তায় বের হয়, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” [সহীহ মুসলিম: ৬৭৪৬] আমার ব্যক্তিগত পড়াশোনা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে একেবারে বিগিনারদের জন্য একটি বইয়ের লিস্ট করলাম। কেউ ইসলামি জ্ঞানার্জন করতে চাইলে এই বইগুলো তার পড়া উচিত বলে আমি মনে করি। একেক ক্যাটাগরিতে একেকটি বই নির্বাচন করেছি। বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণও সংযুক্ত করেছি।
১। ইসলামি আকিদা – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
বইটি মূলত হাদীসে জিবরীলের (আলাইহিস সালাম) আলোকে। ঈমানের ৬ টি মূল স্তম্ভ; ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘Articles of faith’ নিয়ে বইটি। বাংলা ভাষায় আকিদা সংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং একাডেমিক বই হিশেবে এটাকে ধরা হয়।
২। এহইয়াউস সুনান – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
সুন্নাত-বিদআত নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো। বাংলা ভাষায় সুন্নাত-বিদআত নিয়ে বেশ গ্রহণযোগ্য এপ্রোচে যারা কথা বলেছেন, লিখেছেন, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর এই বইয়ে তিনি একেবারেই শুরু থেকে আলোচনা করেন। অর্থাৎ, সুন্নাত কী, বিদআত কী, কিভাবে বিদআত হয় এই সংক্রান্ত উসূল আলোচনা করে পরবর্তীতে টপিক ধরে ধরে এগিয়েছেন।
৩। মহানবী – মাজিদা রিফা
বিগিনার কেউ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী পড়তে চাইলে এই বইটি দিয়ে শুরু করতে পারেন। কারণ, বইটি গতানুগতিক সীরাত বইয়ের মতো না; অনেকটা থ্রিলার উপন্যাসের ঢঙ্গে। একটানা পড়তে পারবেন, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
৪। আর রাহীকুল মাখতূম – আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপূরী (রাহিমাহুল্লাহ)
রাবেতায়ে আলামে ইসলামি আয়োজিত বিশ্বব্যাপী সীরাতুন্নবী প্রতিযোগিতায় ১১৮২ টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে এই বইটি প্রথম নির্বাচিত হয়। বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য সীরাতগ্রন্থ হিশেবে বইটি স্বীকৃতি লাভ করে। ‘মহানবী’ পড়ার পর এই বইটি পড়তে পারেন।
৫। হিসনুল মুসলিম/বান্দার ডাকে আল্লাহর সাড়া – সাঈদ ইবনে আলী কাহতানী (রাহিমাহুল্লাহ)
দু’আর গ্রহণযোগ্য বই হিশেবে এই বইটি পুরো মুসলিম বিশ্বে পরিচিত। দৈনন্দিন জীবনে কোন পরিস্থিতি আমরা কী দু’আ করবো সেটা এই বইয়ে পাওয়া যাবে।
৬। রাহে বেলায়াত – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
এই বইটিও দু’আ এবং যিকিরের বই। দু’আ ও যিকিরের বিধান সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা আছে বইটিতে। ‘হিসনুল মুসলিম’ থেকে এটার স্টাইল একটু আলাদা হিশেবে এটাও রাখলাম।
৭। আল-আদাবুল মুফরাদ – ইমাম আল-বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)
বলা হয়ে থাকে যে, জ্ঞানার্জনের আগে আদব (Manner) শিখতে। আপনি কতোটা জ্ঞানী সেটার প্রমাণ পাওয়া যাবে আপনার ব্যবহারের মধ্যে, শিষ্টাচারের মধ্যে। ইমাম বুখারীর এই বইটি শিষ্টাচারের উপর একটি ক্লাসিক্যাল বই।
৮। প্রচলিত ভুল – মাওলানা আব্দুল মালেক (হাফিজাহুল্লাহ)
আমাদের সমাজে অনেক ভুল কথা, ভুল কাজ প্রচলিত আছে। আমরা সচরাচর সেগুলো করি বা শুনে থাকি। সমাজের মধ্যে প্রচলিত কী কী ভুল আছে, সেগুলোর ব্যাপারে ইসলাম কী বলে তা নিয়ে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের এই বইটি একটি গবেষণাধর্মী বই।
৯। ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা – মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী (রাহিমাহুল্লাহ)
এই বইটি ‘হাকীকত সিরিজ’ নামে পরিচিত। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর (কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ) উদ্দেশ্য কী এই নিয়ে বইটি। ইসলামের ৭ টি মৌলিক বিষয় নিয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন যে, এগুলো আমরা কেনো করছি।
১০। আসহাবে রাসূলের জীবনকথা (৭ খণ্ড) – ড. মুহাম্মদ আব্দুল মা’বুদ (হাফিজাহুল্লাহ)
বাংলা ভাষায় সাহাবীদের জীবনী নিয়ে মৌলিক বইয়ের নাম নিলে এটার নাম সবার আগে নিতে হয়। ৭ খণ্ডের এই বইয়ে লেখক প্রায় ২০০ –এর কাছাকাছি সাহাবীদের জীবনী নিয়ে লিখেছেন।
১১। খুশু খুযু – ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)
আমরা কিভাবে মনোযোগের সাথে নামাজ পড়তে পারি এই বিষয়ে একটি ক্লাসিক্যাল বই হলো ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের ‘খুশু খুযু’ বইটি।
১২। কুরআন বুঝার মূলনীতি – ড. আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস (হাফিজাহুল্লাহ)
কুরআন আমরা কিভাবে বুঝবো, কিভাবে নাযিল হলো, কিভাবে সংকলিত হলো, কিভাবে সেটার ব্যাখ্যা করা হয় এসব নিয়েই এই বই।
১৩। হাদীস বুঝার মূলনীতি – ড. আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস
হাদীস কী, হাদীস কতো প্রকার ও কী কী, সহীহ হাদীস কাকে বলে, যঈফ হাদীস কী, হাদীস কিভাবে সংকলিত হয় এসব বুঝার প্রাথমিক বই হিশেবে এটা পড়া যেতে পারে।
১৪। উসূলুল ফিকহ – শাহ আব্দুল হান্নান (রাহিমাহুল্লাহ)
ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি নিয়ে এই বইটি। ইসলামি ফিকহের উৎস কী, কিভাবে একটা বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান ইমামগণ এই নিয়ে মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বই।
১৫। হাদীসের নামে জালিয়াতি – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
ইসলাম শিক্ষা বই থেকে শুরু করে দেয়াললিখন, এমনকি মসজিদের ভেতরেও অনেক কথা পাওয়া যায় যা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামে চালিয়ে দেয়া হয়। অথচ সেসবের অনেকগুলোই হলো জাল, মিথ্যা বা বানোয়াট। হাদীস কী, হাদীস কিভাবে জাল হয়, প্রচলিত জাল হাদীস নিয়ে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ বইটি।
১৬। গুনাহ মাফের উপায় – ড. সায়্যিদ বিন হুসাইন আফফানী
আমরা প্রত্যেকেই গুনাহগার। সবসময় জেনে-বুঝে হোক বা ন জেনে হোক গুনাহ করে যাই। কিন্তু, ইসলামে গুনাহ মাফের অনেকগুলো অপশন আছে। আমরা কিভাবে গুনাহ মাফ করতে পারি, কুরআন ও হাদীসের আলোকে এই নিয়ে বইটি।
১৭। ইসলামি জ্ঞানে উসূলের ধারা – ড. মেহমেদ গরমেজ
জ্ঞানার্জনে উসূলের ইতিহাস এবং এটার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই বইটি। সংকীর্ণতা ও প্রান্তিকতা থেকে দূরে থাকতে এই বইটি বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
১৮। মুমিন ও মুনাফিক – আল্লামা তাকী উসমানী (হাফিজাহুল্লাহ)
মুমিন ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা আলেম আল্লামা তাকী উসমানী এই বইটি লিখেছেন।
১৯। মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বনের উপায় – শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)
যদিও মনে হতে পারে বইটি স্কলারদের জন্য, কিন্তু আমার মনে হয় বইটি সাধারণদেরও অবশ্যই পড়া উচিত। এই বইটি পড়লে অন্তত বিগিনার কেউ বুঝতে পারবে ইসলামে মতবিরোধ বলতে কিছু একটা আছে, এটা নতুন কিছু না এবং এই সংক্রান্ত বিষয়ে কী ধরণের কথা বলা উচিত নাকি চুপ থাকা উচিত। প্রাথমিকভাবে এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকলে জ্ঞানার্জনের পথে নানান প্রশ্নের সহজ সমাধান পাওয়া যাবে।
২০। লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি – ফিরাস আল খতীব
বিগিনারদের জন্য সংক্ষিপ্ত এবং গ্রহণযোগ্য ইসলামের ইতিহাসের বই হিশেবে এই বইটি আমার সাজেশন। এক মলাটে ১৪০০ বছরের ইতিহাস। বইটি পড়ে ইতিহাস পাঠের আগ্রহ আরো বাড়বে বলে আমি আশা করি। যা কিছু ভালো, সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। ভুল-ভ্রান্তির দায়ভার আমার। আল্লাহ আমাদের এই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। ভুল-ভ্রান্তি মাফ করুন।