(১)
আঁধারে ডুবে ছিল পুরো পৃথিবী। আরব্য উপদ্বীপ জুড়ে ছিলো হত্যা, সন্ত্রাস, আর অশ্লীলতা-বেহায়াপনার মিছিল। অজ্ঞতা-মূর্খতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলো পুরো সমাজকে। যত দিন যাচ্ছিলো হিংস্র হয়ে উঠছিলো চারপাশের মানুষগুলো! মানবতা ডুকরে কেঁদে উঠছিলো সত্যের পথপ্রদর্শনকারী একজন মহামানবের অপেক্ষায়! মানবমনে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো সত্যেকে আঁকড়ে ধরার নেশা!
মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত হলো। অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটলো। পৃথিবীর বুকে আগমন করলেন মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মক্কার অলিতে গলিতে জ্বলে উঠলো ঈমানের আভা! বরকতময় হেরা গুহা থেকে পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ইসলামের আলো। শুদ্ধতার চাদরে নিজেদের জড়িয়ে নিতে লাগলেন সাহাবায়ে কেরাম। ইলমের অন্বেষণে তারা ভিড় জমাতে লাগলেন রাসুলের চারপাশে। পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতায় রাঙাতে লাগলেন নিজেদের জীবন।
মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। নবুয়ত প্রাপ্তির পরই তিনি শুরু করলেন উম্মতের মাঝে ইলমে ওহীর বিতরণ। নিজের ঘর থেকেই শুরু হলো শিক্ষাদানের কার্যক্রম। পরিবারের লোকেরাই সর্বপ্রথম লাভ করলো খোদাপ্রদত্ত ইলমে ওহীর ” জ্ঞানধারা “। বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে চললো নিজেদের জীবন উন্নয়নের এই অভিনব পন্থা-পদ্ধতি! পুরো পৃথিবী দেখলো, বিশ্ববিজয়ী একজন মহামানবের হাত ধরে জান্নাত পানে এগিয়ে চলছে একটি কাফেলা। অস্তিত্ব লাভ করেছে একটি শিক্ষাধারা। সূচনা হচ্ছে মাদ্রাসার! বিপ্লবময় একটি উপাখ্যানের…….!
(২)
গতানুগতিক জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগে এখনকার মত মসজিদ থেকে আলাদা স্বতন্ত্র কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো না। ইতিহাস অধ্যায়ন করলে আমরা দেখতে পারি, ইসলামের আদি শিক্ষাগার ছিলো মাসজিদ। হযরত আদম (আ:) পৃথিবীতে এসে বায়তুল্লাহ শরীফ নির্মাণ করেন। এটাই ছিলো মানবজাতির প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত লাভের পর কাবাকেই প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সুযোগমতো সাহাবায়ে কেরামকে ঘরে ও অন্যান্য জায়গায় দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিক্ষা দিতেন। পরবর্তিতে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার-ষড়যন্ত্র থেকে নিরাপত্তা লাভ ও সাহাবায়ে কেরামকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়ার জন্য মক্কা নগরীর সাফা পাহাড়ের পাদদেশে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আরকাম বিন আবুল আরকাম (রা:) এর বাড়িতে ‘দারুল আরকাম’ নামে দ্বীনি ইলম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। সে হিসেবে দারুল আরকামই হলো ইসলামের প্রথম আনুষ্ঠানিক ” শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা “।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এখানে শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। আল্লামা যাহাবী রহিমাহুল্লাহ আমাদের দেখিয়েছেন, কিভাবে হজরত আবু বকর সিদ্দিক, হজরত উমর ইবনে খাত্তাব, হজরত উসমান ইবনে আফফান, হজরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা:) সহ চল্লিশোর্ধ সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনি ইলম শিখার জন্য ব্যাকুল হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে বসে আছেন। কত আদবের সাথে তার থেকে ইলমে দ্বীন শিখছেন। নিজেদের বড়ত্ব ও আমিত্বকে বিলিন করে রবের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গের প্রস্তুতি নিচ্ছেন!
সময় চলছিলো আপন গতিতে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছিলো ইসলামের সুনাম-সুখ্যাতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হিজরতের আগে আকাবার শপথের মাধ্যমে যারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রশিক্ষিত করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত মুসআব ইবনে উমাইর (রা) কে মদিনায় পাঠান। রাসুলুল্লাহর মদীনায় হিজরতের পর দারুল আরকামে শিক্ষাদানের জন্য হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম ও মুসআব ইবনে উমাইরের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মদীনায় হিজরতের পর মক্কার অবশিষ্ট মুসলমানদের মধ্যে দারুল আরকামের মাধ্যমেই দাওয়াত ও দ্বীনি ইলম চর্চার ধারাবাহিকতা চালু থাকে!
নবুয়তের প্রথমদিকে বিশেষত মক্কী জীবনে ইসলামের বুনিয়াদি জ্ঞান ও ইবাদতের নিয়মকানুনের শিক্ষাগ্রহণই পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পবিত্র কুরআনুল কারিমকেই সিলেবাসের প্রধান পাঠ্যবই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। মোটকথা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাহাবায়ে কেরামের দ্বীনি ইলম শিক্ষার পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো পবিত্র কুরআনুল কারীম, হাদীসে নববী এবং আহলে কিতাবদের ঘটনা ও অবস্থার বিবরণ!
(৩)
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন। বিশ্বজয়ী বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। তারা যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন দ্বীনি ইলমের শিক্ষাঙ্গন।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী রহিমাহুল্লাহ মদিনার বাইরে যারা ইলমের প্রচার-প্রসারে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছেন তাদের সংখ্যা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, মক্কায় ইলম শিক্ষাদানের জন্য নিজেদের উৎসর্গকারী মানুষের সংখ্যা ছিলেন ২৫ জন। সিরিয়াতে ৩৪ জন। মিশরে ১৬ জন। জাজিরাতে ৬ জন!
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন শুধু আরবের আশেপাশেই দ্বীনি ইলমের প্রচার-প্রসার করে ক্ষান্ত হননি বরং ইতিহাস অধ্যায়ন করলে আমরা দেখি, দ্বীনি জযবার কারনে আমাদের উপমহাদেশেও আগমন ঘটেছে অসংখ্য সাহাবীর। আমাদের দেশের চট্টগ্রাম, লালমনিরহাটসহ আরো অসংখ্য জায়গায় এখনো সাহাবায়ে কেরামের যুগের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। আলহামদুলিল্লাহ! এগুলো আমাদের জন্য গর্বের ও আনন্দের! ইলমের প্রচার-প্রসার, ইসলামকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ভারতেও অনেক সাহাবী এসেছেন। তাদের মধ্যে সাতজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
- আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ উতবান। (রা:)
- আশইয়াম বিন আমর আত তামিমী। (রা:)
- সোহার বিন আল আবদি। (রা:)
- হাকাম বিন আবুল আস আস সাকাফি। (রা:)
- উবায়দুল্লাহ ইবনে মামার আত তামিমি। (রা:)
- আব্দুর রহমান ইবনে সামুরা। (রা:)
- সুহাইল ইবনে আদি। (রা:)
(৩)
তাবেঈদের যুগ পর্যন্ত ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়গুলো শিক্ষাদানের ব্যবস্থা মসজিদভিত্তিকই ছিলো। উমাইয়াদের শাসনামলে (৪১–১৩০ হি) হাদিস সংকলনের কাজ শুরু হয়। হাদিস বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করার জন্য রিজাল শাস্ত্র ও আরবি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা দারুণভাবে অনুভূত হয়। ফলাফলে রিজাল শাস্ত্র এবং নাহু-সরফের ইলম স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব লাভ করে। তাবে তাবেঈনের যুগে জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার সমাধানের জন্য সবার মাঝেই ইলমে ফিকহের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
খলীফা মামুনুর রশীদের শাসনামলে (৮৩০ খৃষ্টাব্দে) বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শন ও সাহিত্য আরবি ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। বায়তুল হিকমাহ নামে তখন স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। দ্বীনের বুনিয়াদি বিষয়ের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন বিষয়েও শিক্ষাদান করা হতো। জ্ঞানভিত্তিক এই উৎকর্ষতার কারণে মূর্তিপূজারী ও কাফের-মুশরিকদের নানাধরনের অযৌক্তিক প্রশ্ন মুসলামনদের সামনে আসতে থাকে। ইসলামের উপর উত্থাপিত হতে থাকে বিভিন্ন সংশয়। ফলাফলে ইলমুল কালাম বা যুক্তি-তর্ক শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। অন্যদিকে অনারবীরা কুরআন-সুন্নাহে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য বালাগাত বা অলংকার শাস্ত্রের চর্চা শুরু করে। খলীফা মামুনের যুগেই ভূগোল, জ্যামিতি, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়!
আব্বাসীয়দের খেলাফতের শেষদিকে দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা একটি নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়। তখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে। সিরিয়া ও মিশর হাদিস, তাফসির ও রিজাল শাস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। স্পেন প্রসিদ্ধ ছিলো সাহিত্য ও ইতিহাসের জন্য। ইরান-ইরাকের বিস্তৃতি লাভ করেছিলো দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্র। মাওরাউন নাহার ও তার আশেপাশের এলাকা ফিকহ, উসুলে ফিকহ ও তাসাউফের জন্য বিখ্যাত হয়।
(৪)
৪০০ হিজরী পর্যন্ত সবখানে মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাই প্রচলিত ছিলো। সর্বপ্রথম মিশরের শাসক হাকেম বি আমরিল্লাহ (৩৫৫- ৪১১ হি) মাদ্রাসার জন্য মসজিদ থেকে আলাদা একটি ঘর নির্মাণ করেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। পরবর্তিতে আফগান শাসক সুলতান মাহমুদ (৪১০ হিজরীতে) মসজিদের পাশে দ্বীনি ইলম শিক্ষাদানের জন্য একটি ঘর বানান। অনেক ঐতিহাসিক এটাকেই ইসলামের ” সর্বপ্রথম মাদ্রাসা ” বলে মনে করেন। অনেকে নেজামুল মুলক তুসি রহিমাহুল্লাহ (৪৮৫হি) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসাকে সর্বপ্রথম মাদ্রাসা বলেছেন। এর পর থেকে সবখানেই ব্যাপকহারে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।
ইতিহাস অধ্যায়ন করলে জানা যায়, চতুর্থ হিজরীতে নিজামুল মুলক তুসীর তত্ত্বাবধানে অনেক মাদরাসা তৈরি হয়েছে। এর আগেও আরো কিছু মাদরাসা তৈরি হয়েছে তবে সেগুলো ছিলো বড় বড় ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে। যেমন, ইমাম বাইহাকী, ইমাম ইসফারায়েনী, ইবনে ফাউরাক রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ। নিজামুল মুলক তুসী অনেকটা ব্যক্তিত্ব ও মাযহাবভিত্তিক মাদরাসা তৈরি করেছেন কিন্তু তিনি মাদরাসার গঠনের মধ্যে বিস্তৃতি এনেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন রাষ্ট্রকে। নিজামুল মুলকের পরবর্তী পর্যায়ে মাদরাসা নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানের খুবই গুরুত্ব দেয়া হতো। নির্বাচন করা হতো উৎকৃষ্ট ও নিরাপদ স্থান। তেমনিভাবে জ্ঞান, নৈতিকতা ও উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আলেমদেরকে নিয়োগ দেয়া হতো মাদরাসাগুলোতে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, যখন নিয়মতান্ত্রিক মাদরাসাগুলোর সূচনা হচ্ছে ঠিক তখনই চলছিলো প্রতাপশালী বিভিন্ন সুলতানদের শাসন, যারা ইসলামী ও আরবী সভ্যতা-সংস্কৃতিকে নতুন যুগের প্রেক্ষাপটে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নিজামুল মুলক, সেলজুক মন্ত্রী মালিকশাহ। সুলতান নুরুদ্দীন মাহমুদও তার সাম্রাজ্যের অধীনে সিরিয়ার সকল মাদরাসাকে পুনর্গঠন করছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আলেম ও ফকীহদের এনে নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা!
সুলতান নুরুদ্দিন যখন দামেশকে প্রবেশ করেন, তখন তিনি সেখানে প্রায় এগারটির মত ধর্মীয় দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখতে পান। সবগুলোই ছিলো ওয়াকফকৃত জমির উপর নির্মিত। এগুলো কোন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির অধীনে ছিলো না। তার শাসনক্ষমতা শেষ হওয়ার সময় দেখা গেলো দামেশকে বাইশটির মতো মাদরাসা তৈরি হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। অন্যদিকে তখন শিয়া অধ্যুষিত ও শাসনকৃত হালব অঞ্চলে মাদরাসা ছিলো মাত্র আটটি।
(৫)
ইলমে দ্বীনের প্রচার প্রসার ও মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরো বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সফর করেছেন তাদের সংখ্যা অগনিত। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ ধরনের অজস্র মহামানবের উপাখ্যান। এই মহান ব্যক্তিত্বদের জীবনী নিয়ে কাজ করেছেন শতাধিক মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক। আমি উপমাস্বরূপ এই আত্মত্যাগীদের জীবনী নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের সংক্ষিপ্ত একটি খসড়া আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। অন্যথায় এধরনের ইতিহাসগ্রন্থ আরো শতাধিক রয়েছে!
- ১/ তারিখে মাদিনাতে দিমাশকে আছে ১০২২৬ জনের জীবনী।
- ২/ তারিখুল ইসলামে আছে ১৫৮৬৭ জনের জীবনী।
- ৩/ তারিখে বাগদাদে আছে ৯০৮৯ জনের জীবনী।
- ৪/ তারিখে কাবির লি ইবনে খইছামাতে আছে ৯৪২৮ জনের জীবনী।
- ৫/ আল ওয়াফি বিল ওফায়াতে আছে ৪৬২১ জনের জীবনী।
- ৬/ মিযানুল ইতেদালে আছে ১১০৫৩ জনের জীবনী।
- ৭/ উসদুল গাবাতে আছে ৭৭১১ জনের জীবনী।
- ৮/ কিতাবুছ ছিকাত লি ইবনি হিব্বানে আছে ৪৪৮৮ জনের জীবনী।
- ৯/ আল ইসাবাতে আছে ১২২৯৮ জনের জীবনী।
- ১০/ লিসানুল মিযানে আছে ১১০৫৩ জনের জীবনী।
(৬)
(১০৭৬ ঈ. থেকে নিয়ে ১১৫৪ ঈ.) পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, কতটা দ্রুততার সাথে ঘটেছে মাদরাসার বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি। সুলতান নুর উদ্দিন মাহমুদ দামেশকে প্রবেশ করেছিলেন ৫৪৯ হিজরিতে। এই শহরের পতন ঘটে মঙ্গোলিয়ান সৈন্যদের হাতে ৬৫৭ হিজরিতে। এই এক শতকের মাঝে তখন ১১০ টির মত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারণত প্রতি বছর একটি করে মাদরাসা নির্মাণ করা হতো। এর মাধ্যমেই সংস্কৃতি ও সভ্যতাগত দিক থেকে মুসলমানরা অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। তখনকার এক একটি মাদ্রাসা বর্তমানের সময়ের মাদ্রাসাগুলোর চেয়ে পড়ালেখা, পাঠদান ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে অনেক উন্নত ও অগ্রসর ছিলো। এসব মাদরাসায় শিক্ষা প্রদান করা হতো বিনামূল্যে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ছাত্ররা বিভিন্ন দূর-দূরান্তে সফর করে মক্কা, বাগদাদ, দিমাশক, কায়রো যেতো।
ইসলামিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তৃতির অন্যতম কারণ হলো আরবি ভাষা। হিজাজের আশেপাশের অনেক অঞ্চলে আরবি ভাষাই প্রচলিত ছিলো। আলেম-উলামা, মুহাদ্দিস ও ফকীহরা সাধারণত আরবি ভাষাতেই শিক্ষাদান করতেন। এজন্য ভাষাগত দিক থেকে ছাত্রদের কখনোই পরিচয় সংকটে পড়তে হয়নি।
সে যুগের নথিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজে যে ইতিহাসে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এসব মাদরাসার পরিচালনায় যেসব আলেম ও শায়েখ থাকতেন তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ছিলো যথেষ্ট মর্যাদা। প্রধান শায়খ নির্ধারণ করা হতো ইলমের দিক থেকে অগ্রগণ্যদের। উদাহরণস্বরূপ, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর লেখক ইমাদ উদ্দিন ইস্পাহানি রহিমাহুল্লাহর অনুমোদন ও স্বাক্ষরের মাধ্যমেই হানাফী মাযহাবের প্রায় বারোটি মাদরাসার পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় আল্লামা আলাউদ্দিন কাসানী হানাফী রহিমাহুল্লাহকে ।
আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদের পতনের শেষ দিকে, মঙ্গোলিয়ান আক্রমণের প্রায় দুই যুগ আগ সর্বশ্রেষ্ঠ ইলমী বিদ্যাপীঠ হিসেবে গণ্য হতো মাদরাসায়ে মুসতানসেরিয়া। এই মাদরাসা তৈরি করেছেন খলীফা মুসতানসির বিন জহির (৬২৩-৬৪০ হি) (১২২৬-১২৪২ ই) । এটা ছিলো ইসলামী ইতিহাসের ব্যাপকতর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। এখানে একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান যেমন ছিলো, তেমনিভাবে চার মাযহাবের ফিকহের উপরও শিক্ষা প্রদান করা হতো। এখানে শিক্ষা দেয়া হতো—কুরআন, হাদিস, চার মাযহাবের ফিকহ, আরবি ভাষাতত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, সম্পত্তি বন্টন, প্রাণীর উপকারিতা, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, দেহবিদ্যা ইত্যাদি। এর আগে কখনোই এতগুলো জ্ঞানের সমাহার একসাথে একটি মাদরাসার সীমানায় পরিলক্ষিত হয়নি।
খলিফা মুসতানসির মাদরাসাটি নির্মাণ করেছেন (৬২৫- ৬৩১ হি.) এর মধ্যবর্তী সময়ে। ফিকহ, চিকিৎসা, কুরআন, হাদিস প্রতিটির জন্য তিনি আলাদাভাবে চারটি ভবন নির্মাণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে সায়ী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এর আগে কোন মাদরাসায় প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য এভাবে আলাদা ভবন নির্মাণের কোন রীতি ছিলো না। সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে হয়তো একই ভবনে দুটির দরস অনুষ্ঠিত হতো অথবা দুটির জন্য আলাদা আলাদা মাদরাসা নির্মাণ করা হতো। কিন্তু একই মাদরাসার অধীনে চিকিৎসা ও ফিকহের সমন্বয় কখনো দেখা যায়নি। দ্বীনের শিক্ষার জন্য ছিলো ধর্মীয় মাদরাসা। আর চিকিৎসা শিক্ষার জন্য ছিলো আদুদী বিমারিস্তান, দামেস্কের চিকিৎসালয়, আবু মুজাফফর বাতেকিন প্রতিষ্ঠিত বসরার চিকিৎসালয় প্রভৃতি।
মুসতানসেরিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই শতক পূর্বে মাদরাসাব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু এই মাদরাসার মাধ্যমে মাদরাসা কাঠামোগত দিক থেকে নতুন একটি মোড় নেয়। এর গঠনমূলক কাঠামো ও শিক্ষা পদ্ধতির অনুসরণ করতে থাকে পরবর্তী মাদরাসাগুলো। পরবর্তী মাদরাসাগুলোতেও চার মাযহাবের ফিকহ, চিকিৎসা, কুরআন ও হাদিসের বিদ্যা একত্রে শিক্ষাদান প্রচলিত হয়। এমনকি এই মাদরাসার বাহ্যিক প্রকৌশল শিল্প ও অবকাঠামো দ্বারাও পরবর্তী মাদরাসাগুলো প্রভাবিত হয়।
খলিফা মুসতানসির তার মৃত্যুর পরও মাদরাসার নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় এজন্য অনেক জমি ওয়াকফ করে গিয়েছেন। ইমাম যাহাবী রহিমাহুল্লাহ এ সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি মাদরাসার জন্য যে জমি ওয়াকফ করে গিয়েছিলেন, সেটার মূল্য হবে প্রায় এক মিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রার সমান।” এই ওয়াকফকৃত জমি থেকে প্রতি বছর মাদরাসার জন্য সত্তর হাজার স্বর্ণমূদ্রা আয় হতো। এখান থেকেই বোঝা যায়, এই মাদরাসায় শিক্ষা কতটা উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করেছিলো।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, কয়েক শতক পর্যন্ত দ্বীনি ইলম শিক্ষার নেতৃত্ব দিয়েছে এই মাদরাসা। এই মাদরাসায় যোগ্য ফকিহ ও শিক্ষকদেরকেই পাঠদানের কাজে নিযুক্ত করা হতো। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীব্যাপী এই মাদরাসায় ১২০ জনেরও বেশি আলেম-উলামাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পরে। শুধু শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো কখনোই উদ্দেশ্য ছিল না এই মাদরাসার। এখানে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হতো যারা ছিলেন ইলমের অঙ্গনে আপন যুগের অনন্য ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সে যুগে সারাবিশ্বে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে এই মাদরাসার ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য।
(৬)
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে হাউকালের বর্ণনামতে, তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের মসজিদগুলোতে ব্যাপকভাবে আলেম-উলামাদের পদচারণা দেখা যেতো। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে জানা যায়, ৭০০ হিজরীর শুরুর দিকে সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসনামলে (৬০২-৬০৬) হিজরীর শুরুর দিকে মুলতানের শাসক নাসিরুদ্দিন কুবাচা মুলতানে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেন বলে জানা যায়। কাজী মিনহাজুস সিরাজ ছিলেন সেখানকার পরিচালক। এর পর থেকে ব্যাপকভাবে পুরো উপমহাদেশজুড়ে মাদ্রাসার প্রচার-প্রসার হয়।
আল্লামা মাকরেজি রহিমাহুল্লাহর মতে, সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের আমলে (৭২৫-৭৫২হি) শুধু দিল্লিতেই ১০০০০ মাদ্রাসা ছিলো। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বহু মাদ্রাসা সংস্কার করেন। তিনি মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও জানা যায়।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আমি ভারতের হনুর শহরে ১৩ টি মহিলা মাদ্রাসা দেখেছি। উপমহাদেশের বিজাপুর, গুজরাটসহ পূর্বাঞ্চলীয় সম্রাটদের শাসনামলে ব্যাপকভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস আমাদের বলে, মুঘল আমলে উপমহাদেশের এমন কোন শহর-নগর ছিলো না যেখানে কোন মাদ্রাসা ছিলো না। এ সময় শুধু বাংলাদেশেই মাদ্রাসার সংখ্যা ছিলো ৮০০০০ !
(৭)
নবম থেকে একাদশ হিজরীতে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল হাই লাখনবী রহিমাহুল্লাহ ব্যাপকভাবে হাদিসের প্রচলন ঘটান। বাদশাহ আলমগীরের রাজত্বকালে তিনি মোল্লা নিজাম উদ্দিন সিহরভী রহিমাহুল্লাহকে ” ফিরিঙ্গি মহল ” নামে একটি জায়গীর দান করলে তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
তেরশো শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি জায়গাকে ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র মনে করা হতো :
- ১/ দিল্লি।
- ২/ লখনৌ।
- ৩/ খয়রাবাদ।
দিল্লিতে হাদিস তাফসিরের প্রাধান্য ছিলো। লখনৌতে ফিকহ, উসুলে ফিকহের। খয়রাবাদে মানতেক ও ফালসাফার। সরকারি জায়গীরের উপর ভিত্তি করেই এসব মাদ্রাসা চলতো। এই মাদরাসার পড়াশোনা ছিলো বিষয়ভিত্তিক। একজন শিক্ষকই সবাইকে পড়াতেন। কোথাও কোথাও পরীক্ষারও ব্যবস্থা ছিলো না। পড়াশোনা শেষ হলে ছাত্র উস্তাদের দুয়া নিয়ে চলে যেতো। সনদেরও তেমন কোন প্রচলন বা ব্যবস্থা ছিলোনা। বড় ব্যক্তিকেন্দ্রীক কোন পড়াশুনা হলে ছাত্রদেরকেই নিজেদের খরচের সব ব্যবস্থা করতে হতো।
ইংরেজরা উপমহাদেশের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মাদ্রাসা মহলের উপর নেমে আসে অকথ্য জুলুম-নির্যাতন। ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করার কারণে তখন হাজার হাজার আলেম উলামাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়। অসংখ্য আলেমে দ্বীনকে দেশান্তরিত করা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় সব মাদ্রাসার রাষ্ট্রীয় জায়গীর। অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয় এদেশের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মানুষের উপর।
স্রোতের বিপরিতে সূচনা হয় এক বিপ্লবী চেতনার। আযাদী আন্দোলনকে সামনে রেখে, উপমহাদেশে দ্বীনের জযবাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে মে মুতাবেক ১৫ ই মুহাররম ১২৮৩ হিজরীতে ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ বসতির সাত্তা মসজিদ প্রাঙ্গণে ৬ জন মহান ব্যক্তির আত্মত্যাগ-দৃঢ়প্রত্যয় ও মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দের। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমাদের উপমহাদেশসহ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দারুল উলুম দেওবন্দের মানহাজে অসংখ্য অগণিত মাদ্রাসা।
যে ৬ জন মহান ব্যক্তিত্বের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে এক নতুন আঙ্গিকে ইলমের যাত্রা শুরু, যাদের রুহানিয়াত, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা পেয়েছি এক অনন্য ইলমী নেয়ামত! তারা হলেন :
- মাওলানা জুলফিকার আলী (১৯০৪)
- মাওলানা ফজলুর রহমান (১৯০৭)
- মাওলানা কাসেম নানুতুবী (১৮৮০)
- মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী (১৮৮৪)
- মাওলানা আবেদ হোসেন (১৯১২)
- মাওলানা রফিউদ্দিন (১৮৯০)
রহিমাহুল্লাহুমুল্লাহু রহমাতান ওয়াসিয়া !!
তথ্যসূত্র :
————
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ৩/ ২৪২-২৪৩
তারিখে ইবনে খালদুন। ১/৬২৯
রিহলা ইবনে বতুতা। ১/ ২৩৫–২৫৬
আত তারিখুল ইসলামি। ১/ ৩০–১৩৩
তারিখে বাগদাদ। ১/৫–১৪
তারিখে দিমাশক। ১/৬–১৩
আস সাকাফাতুল ইসলামিয়াহ ফীল হিন্দ।
নুযহাতুল খাওয়াতির।
মাকালাতে শিবলী।
তাযকিরায়ে উলামায়ে ফিরিঙ্গী মহল।
হিন্দুস্তান কি কদিম ইসলামি দরসগাহে।