আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা কবিতার বাঁকপুরুষ। দোলায়িত ছন্দের বরপুত্র। ত্রিশোত্তর কবিতার ধারায় যে কজন কবি-প্রতিভা বাংলা কবিতায় নতুনত্বের সুর বাজিয়েছেন আল মাহমুদ সেই সারির অন্যতম মৌলিক কবিসত্তা। জীবনান্দ দাশ পরবর্তী দুই বাংলার ঝাঁক-ঝাঁক কবিদের ভিড়ে আল মাহমুদই একমাত্র স্বতন্ত্র যার কপালে দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবির তিলক অঙ্কিত হয়েছে। সোজা কথায় যদি বলি তাহলে বলতে হয়, আল মাহমুদের আগমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অতুলনীয় সংযোজন।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা ছাপার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আল মাহমুদের রোমান্টিক কাব্যযাত্রার অন্তহীন ও বর্ণিল পথচলা। কালের কলস তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তী বই লোক-লোকান্তর প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা তিনি একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র দুইটি বই তাকে এ গৌরবান্বিত স্বীকৃতি এনে দেয়। তবে বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদের চারদিক আলোকিত করা জাগরণ শুরু হয় সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। শুরু হয় কবিপাড়ায় আল মাহমুদের স্তুতি বন্দনা। কবিদের চায়ের পেয়ালায় ঢেউ ওঠে। অকপটে তারা বলতে শুরু করে, আমাদের শোভিত মুকুট ছিনিয়ে নেবার জন্য ধূমকেতুর মতো আগমন করেছে আরেক অসুখী কবিহৃদয়।
পঞ্চাশের দশকে আল মাহমুদের আবির্ভাবের পর আজ যখন নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমরা তার প্রশংসিত স্মৃতিচারণ করছি, তখন বিস্ময়ের ঘোরে আমাদের অবলোকন করতে হয়, শুধু কবিতাই নয় বরং গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ সমালোচনা ও আত্মজৈবনিক মোটকথা সাহিত্যের সকল ঘাটেই ভিড়িয়েছে আল মাহমুদের সোনার তরী। বাংলা সাহিত্যের মসনদে দাঁড়িয়ে অসীম আত্মবিশ্বাসের সাথে আল মাহমুদ এ ঘোষণা আরো বহু আগেই দিয়েছেন, ‘শুধু কবিতা নয়, আমার লেখা গল্প উপন্যাসও বিশ্ব সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ।’ সত্যিই, আল মাহমুদের সামগ্রিক সত্তা চিরায়ত বাংলা সাহিত্যকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে। আর কালপরিক্রমায় তিনি হয়েছেন সাহিত্যের ঋদ্ধ পুরুষ। তার অনুরক্ত কিবা তার প্রতি বিরক্ত সকলেই এ কথাটি অকপটে মেনে নিয়েছেন। একটি কবিতা পড়া যাক। তাহলে সহজেই আল মাহমুদের কবিতা, সাহিত্য, শব্দ-বাক্য আর উপমা-উপপ্রেক্ষার একটি মামুলি ধারণা পাবে পাঠক।
কবিতা এমন
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, রাবেয়া রাবেয়া,
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট।
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিংবা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার করব।
কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।
কবিতা চড়ের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’
[শ্রেষ্ঠ কবিতা: ৭০, কবিতা এমন]
উল্লিখিত মোটাদাগের কথাগুলো এই প্রবন্ধের মূল বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত একজন কবি সম্পর্কে যতৎকিঞ্চিত ধারণা লাভের জন্য এই নাতিদীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা। বক্ষ্যমাণ রচনায় একজন কবির বিশ্বাস এবং বিশ্বাস লাভের মূল উৎসের দরজাটা খুলে দেয়াই উদ্দেশ্য। একটি চিরন্তন বিধানের অনিবার্যতাকে প্রমাণ করা। কেন আল মাহমুদ তার মিথ্যা কলুষিত জরাগ্রস্ত বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে সত্য ও সুন্দরের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে এনে দাঁড় করালেন। আর কেনই-বা সেই সত্য ও সুন্দরের রাজসভায় একে একে ডাকলেন পৃথিবীর কবিকুলকে। তাবৎ মুক্তিপাগল মানুষকে।
সময়টি খ্রিষ্টাব্দ ১৯৩৬ এর ১১ জুলাই। এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় তিতাস নদীর তীরবর্তী এক সহজ ও সুজলা গ্রামে আল মাহমুদের জন্ম। নদীর কাদাজলে মিলেমিশে কাটে তার আশৈশব-কৈশর। যৌবনের ফুল সুবাস ছড়াবার আগেই স্কুলের প্রচলিত সিলেবাসের বাইরে নতুন এক দুনিয়ার সাথে পরিচয় ঘটে। যা সম্পুর্ণই আলাদা, স্বতন্ত্র ও একই সাথে সৃজনশীল। বই পড়া। এ বই পড়ার নেশাই তাকে নিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে। বই পড়ে মানুষ আলোকিত হয়। কিন্তু আল মাহমুদ পেলেন তীব্র অন্ধকার। সেসময় তার পরিচয় হয় একটি পাঠাগারের সাথে। লালমোহন পাঠাগার। পাঠাগারটি ছিল কম্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী যে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সাধিত হয়েছিল তার বিরাট প্রভাব পড়েছিল মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশেও। এর প্রভাব এতোই অধিক ও ক্রমবর্ধমান ছিল যে, সীমান্ত ঘেঁষা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অজপাড়া গাঁয়েও গড়ে উঠে ওদের পাঠাগার।
লালমোহন পাঠাগার হয়ে উঠে আল মাহমুদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আসা-যাওয়ার সুবাধে ক্রমান্বয়ে পরিচয় গড়ে উঠে লাল কমরেড আর বিপ্লবীদের সাথে। সে পরিচয় ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। কম্যুনিস্ট চিন্তা চেতনায় লিখিত সেসব বই পড়ে এবং কমরেডদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও চলন-বলনের ফলে মোল্লাবাড়ির আল মাহমুদের বিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করে। শাশ্বত ধর্ম, চিরায়ত সংস্কৃতি ও বিশ্বচরাচরের অনেককিছুই ধীরে ধীরে অস্বীকার করতে শুরু করেন, যুক্তির চশমায় দেখা যায় না বলে। পরিবেশ ও সংস্পর্শের বিষক্রিয়ায় আল মাহমুদ কম্যুনিস্টদের খাতায় নাম লেখান। হয়ে যান বিপ্লবী। পেছনে পড়ে থাকে আল মাহমুদের সুদীর্ঘ বংশপরম্পরার কীর্তি উজ্জ্বল ইতিহাস। বহু বছর আগে ইরান থেকে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা ধর্ম প্রচারের বাসনা নিয়ে বঙ্গদেশে আগমন করেন। সেই পবিত্র ও সম্মানিত বংশের ঔরসে জন্ম হয়েছিল তার। পরিবেশের কদর্যতায় তলিয়ে যান অভিশপ্ততার বালুচরে।
ইতোমধ্যেই আল মাহমুদ কবিতা লিখতে শুরু করেন। দিনরাত কবিতার ভেতর বুঁদ হয়ে থাকে একপল্লী তরুণ। আঞ্চলিকভাবে কিছুটা কবিখ্যাতিও পেয়ে যান তখন। ৫২এর ভাষা আন্দোলনের সময় কোন এক লিফলেটে কবিতা লেখার অপরাধে হুলিয়া জারি হয় তার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি জান্তার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে একরাতে ঘরছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন। সে জেরে পালিয়ে বেড়াতে হয় অনেকদিন। তারপর ১৯৫৪-এর এক স্বপ্নামোদিত দিনে কবিতার নেশায় ছুটে আসেন সাহিত্য ও কবিতার নগরে, ঢাকায়। সম্বল বলতে হাতে ছিল প্রাচীনকালের একটি টিনের স্যুটকেস। যার ভেতরে ছিল নারী, প্রকৃতি, তিতাস, কাম, বিদ্রোহ ও এদেশেরই গ্রামীণ আলপথে উড়ে বেড়ানো অসংখ্য নতুন অব্যবহৃত শব্দ।
আল মাহমুদ ঢাকায় কবিতার সারথী হিসেবে সঙ্গে পান শামসুর রহমান, শহীদ কাদরী ও ফজল শাহাবুদ্দীনসহ আরো অনেককে। যারা সবদিক থেকেই এক নতুন বিশ্বাসের অভিযাত্রী; বিশ্বব্যাপী কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আশায় বুক বেঁধে আছেন। আল মাহমুদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস সর্বত্রই তখন মার্কসীয় চিন্তা সূর্যের রশ্মির মতো প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল। এক নতুন সংগ্রাম, এক নতুন বিপ্লবে মোহগ্রস্ত আল মাহমুদ। এভাবেই কবিতা আর সমাজবিপ্লবের নেশায় কাটতে থাকে কবির জীবন যৌবন।
এরই মধ্যে শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। ১৯৭১ তথা বাঙ্গালী ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আল মাহমুদ কলকাতায় পাড়ি জমান। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করে নিজের বিকৃত বিশ্বাসটাকে আরেকটু বাজিয়ে নেন। দেশ স্বাধীন হয়। আল মাহমুদ ফিরে আসেন বাংলাদেশে, এই ঢাকায়। ধীরে ধীরে দেশ স্বাভাবিক হতে থাকে। পেছনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে আল মাহমুদ গণকণ্ঠ পত্রিকায় চাকরি শুরু করেন। পরে রাজনৈতিক ঝুট ঝামেলা ও মার্কসীয় ধ্যান ধারনায় এদেশের স্বাধীনতা-প্রজাতন্ত্রীর বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে কারাগারে পাঠান । শুরু হয় আল মাহমুদের আরেকটি অন্ধকার জীবন ।
জেলখানার সেই অন্ধকার আবরণের ভেতর থেকেই আল মাহমুদ পেয়ে যান অনিঃশ্বেষ আলোকিত জীবনের সন্ধান। কল্যাণের অফুরন্ত সম্ভারের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হয় তার জন্য। এবং তাও খুব অলৌকিক ভাবেই। সেই চিত্তবিচলিত গল্প আল মাহমুদ নিজেই লিখেছেন তার কবির আত্মবিশ্বাস প্রবন্ধে, ‘একবার জেলখানায় খুব ভোরে সেলের তালা খুলে দেওয়া মাত্রই বাইরে এসে দেখি আমার বারাব্দার সামনে সিঁড়ির দুপাশে দুটি বেশ বড়ো ডালিয়া ফুল ফুটে আছে। একটি ঘাঢ় লাল, অন্যটি প্রগাঢ় হলুদ। আমার কেন জানি মনে হল নির্বোধ প্রকৃতির সাধ্যের সীমানা অনেক দূরের কোনো অসামান্য ইঙ্গিত ছাড়া এমন অন্তর্ভেদী প্রস্ফুটন এক অসম্ভব ব্যাপার। আমি আমার এই ছেলে মানুষি চিন্তার কথা আমার সহবন্দি খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতা জনাব মশিহুর রহমানকে বলি। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটু গম্ভীর হয়ে বলেন সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক তত্ত্বালোচনা ছেড়ে তুমি ধর্মগ্রন্থগুলো একবার পড়ে দেখতে পার। আমি তার মুখে ধর্মের কথা শুনে একেবারে বোকা বনে গেলাম। এভাবেই আমার বুকের ভেতর ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠে। পরের দিনই আমি আমার স্ত্রী সৈয়দা নাদিরাকে সবগুলো ধর্মগ্রন্থ আমাকে জেলখানায় পৌঁছে দিতে বলি। এবং পৃথিবীর সবগুলো ধর্মগ্রন্থের এক তুলনামূলক পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করি।’
পুরো একটি বছর আল মাহমুদকে জেলে, অন্ধকর কুঠুরিতে কাটাতে হয়। এই এক বছরে তিনি কুরআনের ওপর তুলনামূলক গবেষণা চালান। কুরআনের সাথে আরো পাঠ করেন মিশরের সংগ্রামী পুরুষ, বিশ শতকে বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সাইয়েদ কুতুব শহীদ এর বিখ্যাত গ্রন্থ তাফসীর ফি-যিলালিল কুরআন। আর এই তাফসীরটিই তার মার্কসীয় চিন্তা ধারার ওপর সীমাহীন আঘাত হানে। কারণ এটির রচয়িতা হলেন পৃথিবীর অন্যতম মহান সংগ্রামী পুরুষ। আল মাহমুদ নিজেও ছিলেন একজন সংগ্রামী। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, তাদের চিন্তাধারা ছিল ভিন্নতর। তবে তাদের রক্ত-মাংস-চৈতন্যে ছিল বিপ্লবের প্রগাঢ় আলোড়ন।
এসবকিছু অধ্যয়ন ও গবেষণা করার পর তিনি যে সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হন তা সত্যিই বিস্ময়কর। আল মাহমুদ বলেন,
‘পবিত্র কুরানের কাছে আমি যা পেয়েছি তা মানুষের পার্থিব জীবনের পরবর্তী অন্য এক উত্থানের নিশ্চিত ধারণা। নাস্তিকতার ওপর মানবতন্ত্র দাঁড়াতে পারে না। পারবে না।’
কিন্তু মজার বিষয় হল, এই পরিবর্তিত ও পরিশুদ্ধ মুসলমান আল মাহমুদ যখন আবার কলকাতায় যান, যে কলকাতা থেকে কম্যুনিস্ট ও নাস্তিকতার শেকড়ে রস পেয়েছিলেন তিনি তখন কলকাতার বাবুরা ঈমানদার কবি আল মাহমুদকে দেখে রাতে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল যেন। তার মুসলমানি মুখমণ্ডল দেখে বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলেই ফেলল, ‘তোমার কোনো অসুখ হয়নি তো! তা ছাড়া দেখছি আজকাল তুমি মদ্যপানও ছেড়ে দিয়েছো। ডাক্তার নিষেধ করেছে বুঝি।’
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি লিখেন,
‘আমার ধর্মবিশ্বাস আমার জন্য একপ্রকার আত্মবিশ্বাসই বটে। আমি অকপটে এদের জানিয়ে দিয়েছি, আমার মদ্যপান ত্যাগ করার পেছনে কোনো ডাক্টারি বিধিনিষেধ বা শারীরিক অসুবিধে নেই। তবে মদ্যপান বাদ দিয়েছি ধর্মীয় কারণে। যেহেতু পবিত্র কুরআন মদ্যপানকে হারাম ঘোষণা করেছে।’
কবি সাহিত্যিকরা সাধারণত যুক্তিবাদী হয়ে থাকেন। যুক্তির ভেলকি দেখিয়ে তারা নাস্তিকতা বা অন্য কিছুর ওপর সভ্যতা ও মানবতন্ত্রের ভিত্তি দাঁড় করাতে চান। আল মাহমুদ জীবনের শুরু থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত সেই নাস্তিকতার ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ ও মানবতার বিজয় কামনা করেছেন। কিন্তু কুরআনের মহারশ্মিতে যখন তার আত্মার ওপর থেকে অন্ধকারের আবরণ সরে গেল তখন সমস্ত মোহ আর জড়তাকে পিঠ দেখিয়ে নিজেকে বানালেন কুরআনের মহান ধারক। ঠিক তখন থেকেই তার কলম গেয়ে উঠল মহাসত্যের সঙ্গীত। তার কবিতা ছড়াতে লাগল বিশ্বাসের সুগন্ধি। কলম হল সত্যের বাণী প্রচারের প্রদীপ্ত মিনার। আল মাহমুদ লিখেন, ‘পবিত্র কুরআন মানব জাতির জন্য আচ্ছাদন স্বরূপ। শুধু এই মহাগ্রন্থই পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে পরম শান্তিতে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে পারে।’
কবিরা হয়ে থাকেন আবেগী মন আর প্রেমিক স্বভাবের। যখন যা করেন মন উজার করে ভালোবেসেই করেন। হৃদয়াত্মার সংমিশ্রণ থাকে তাতে। তেমনি ইসলামও আল মাহমুদের হৃদয়ে মিশে গিয়েছিল গভীরতরভাবে। তিনি লিখেন, ‘আমি কেউই নই। আমি একজন ঈমানদার পদ্য লেখক, আমি হাজী শরীয়তুল্লাহ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ এদেরই উত্তরসূরী সন্তান।’
মহান আল্লাহ তার এই প্রিয় বান্দাকে কুবল করে নেন। ডেকে নেন তার পবিত্র গৃহের যিয়ারতে। হজপালনের স্মৃতিচারণ করে আল মাহমুদ লিখেন, ‘আমি পবিত্র কাবার চারদিকে বারবার তাওয়াফ করেছি, সাফা থেকে মারওয়া পর্বতের দিকে দৌড়ে গেছি, সিজদায় উবুড় হয়ে পড়েছি আল্লাহর কাছে। বলেছি, প্রভু আমি একজন কবি, কবিকে করুণা করো। পবিত্র নগরী মদিনার গলিপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, জান্নাতুল বাকীর কবরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি কবি হাসসান ইবনে সাবিতের কথা কত ভেবেছি। এই নগরীতেই তো দেড় হাজার বছর আগে বাস করতেন হাসসান। মসজিদুন নবীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি যখন তার সদ্য লেখা কবিতায় আল্লাহ ও রসুলের প্রশংসা করে সাম্য ও মৈত্রীর আহ্বান আবৃত্তি শুরু করতেন তখন জগতের সেরা মানব হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত কবিার প্রতি প্রীত হয়ে উঠতেন।…আমি কতজনকে হাসসানের কবরটা কোথায় দেখিয়ে দেওয়ার জন্য মিনতি করেছি। কিন্তু কেউ পারেনি। পরে ভেবেছি না থাক, কবির কবরের চিহ্ন, সীমাবদ্ধ এপিটাফে উৎকীর্ণ কবির প্রশংসা কী দরকার? তার কবিতাই তো রয়েছে তরঙ্গের ফেনোচ্ছ্বাস নিয়ে। আর তা কাল থেকে কালান্তরে লাফিয়ে পড়েছে, যা গুঞ্জরিত হবে অনাদিকালের মানব-মানবীর হৃদয় কন্দরে।’ [শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ: ১১]
কতো বলিষ্ঠ তার ভাষা। কতো তেজোদীপ্ত প্রতিটি হরফ। প্রতিটি উচ্চারণ। যেন চেতনার আগুন ঠিকরে পড়ছে। আত্মবিশ্বাসের লাভায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে অবিশ্বাসের ঘৃণ্য চেতনা। যেন কুঠারাঘাত করছে বিরুদ্ধাবাদীদের হৃদয়ের দেয়ালে। কবির কবিতা হয়ে উঠলো আরো উদ্দীপ্ত, আরো প্রদীপ্ত এবং আরো জাগ্রত। এই বিশ্বাসের প্রতিফলন তার কবিতায়ও আমরা দেখি। দেখি তার কবিতা হয়ে উঠেছে মুমিনের প্রেরণার আলোঘর। দ্যোতনার তাপকেন্দ্র।
আল মাহমুদ লিখেন,
‘মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে উঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে উঠি।’
[শ্রেষ্ঠ কবিতা: ১৫১, বখতিয়ারের ঘোড়া]
আল মাহমুদ আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের শিকড়ে প্রোথিত মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘গভীর আঁধার কেটে ভেসে উঠে আলোর গোলক,
সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ;
তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের দোলক
বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।
হেরার বিনীত মুখে বেহেশতের বিচ্ছুরিত স্বেদ
শান্তির সোহাগ যেন তার সেই ললিত আহ্বান,
তারই করাঘাতে ভাঙে জীবিকার কুটিল প্রভেদ
দুঃখীর সমাজ যেন হয়ে যাবে ফুলের বাগান।
লাত-মানাতের বুকে বিদ্ধ হয় দারুণ শায়ক
যে সব পাষাণ ছিল গঞ্জনার গৌরবে পাথর
একে একে ধসে পড়ে ছলনার নকল নায়ক
পাথর চৌচির করে ভেসে আসে ঈমানের স্বর।
লাঞ্চিতের আসমানে তিনি যেন সোনালি ঈগল
ডানার আওয়াজজে তার কেঁপে ওঠে বন্দীর দুয়ার;
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাহেলের সামান্য শিকল
আদিগন্ত ভেদ করে চলে সেই আলোর জোয়ার।’
[শ্রেষ্ঠ কবিতা: ১৩৬, হজরত মুহাম্মদ]
‘ঢাকো তোমার মুখ। কারণ
মগরের নকিবেরা এখন দাজ্জালের আগমনশিঙায়
ফুঁক দিচ্ছে।
ঢাকো তোমার বুক। কারণ
সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে আমরা
হকের তালিকায় লিপিবদ্ধ।
চলো অপেক্ষা করি সেই ইমামের
যিনি নীল মসজিদের মিনার থেকে নেমে আসবেন
মিশকের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে
পৃথিবীর দুঃসহ বস্তিতে।’
[শ্রেষ্ঠ কবিতা: ১৫২, নীল মসজিদের ইমাম]
সচকিত পাঠকমাত্রই বিশ্বাস করবেন এই শেষের চারটি পংক্তি দ্বারা কবি আল্লাহর মনোনিত সর্বশেষ খলিফা ইমাম মাহদীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। জীবনের অনেকটা সময় কম্যুনিস্ট বিপ্লবে বিভোর থেকে যখন ব্যর্থতা আর অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখেননি তখন নিজেকে এবং পাশাপাশি চারপাশের জগতকে সেই শান্তিময় ব্যবস্থার দিকে আহ্বান করলেন। ডাকলেন সকল মিথ্যা কলুষিত জরাগ্রস্ততার শেকল ছিঁড়ে অবিনশ্বর স্রষ্টার দিকে। যিনি একক। যিনি অবশ্যই আছেন। তিনি আপন দেশ ও বিশ্ববাসীকে আহবান জানালেন, নাস্তিকতার ভুয়া মতবাদ থেকে আস্তিকতার আলোকিত উঠোনের দিকে। যার আদেশে জ্বলজ্বল করছে এই ব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ কোটি সুখতারা। এই পৃথিবীর যা সত্য যা কিছু প্রকৃত সুন্দর তাই ইসলাম। তাই আমাদের বিশ্বাস। যার দিকে ছুটেছেন আল মাহমুদ। ছুটেছি আমরা।