মানুষ অভ্যাসের দাস, তবে সেই অভ্যাস যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়, সেদিকে আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় দৈনন্দিন নানান সমস্যায় পড়তে হয়, অনেক সময় লজ্জা অপমানও হজম করতে হয়। তেমনি কিছু অভ্যাস ও সেগুলোর হাত থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আমাদের আজকের মূল উপস্থাপনা।
১. কথা চালাচালি করা:- বিশ্বস্ততা জীবনে খুব জরুরী। কেউ হয়তো আপনাকে বিশ্বাস করে কোনো কথা বলেছে। আপনি যদি সেই কথা অন্যকে বলে দেন, তাহলে এটা আপনার বাজে অভ্যাস।
সমাধান:- যখন আপনাকে বিশ্বাস করে বলেছে, মনে রাখবেন তা রক্ষা করার দায়িত্বও আপনার। যদি মনে করেন আপনি বলে দিতে পারেন, তাহলে এ ধরনের কথা শোনা থেকে বিরত থাকুন।
হাদিস কী বলে:- হজরত ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ওহে! আমি কি তোমাদের জানাবো চোগলখুরি কী? চোগলখুরি হচ্ছে- ‘মানুষের মাঝে কথা চালাচালি।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন, ‘চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
২. বেশি কথা বলা:- বাচালতা নিজের ব্যক্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত কথা আপনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে।
সমাধান:- কথা দীর্ঘ করলে আসল কথাই হারিয়ে যতে পারে। যদি মনে করেন আপনি বেশী কথা বলছেন, তাহলে বলার সময় সচেতন থাকুন। আপনজনদেরকে বলে রাখুন, কথা বলার সময় খেয়াল করতে আপনি বেশি বলছেন কিনা। তাহলে থামিয়ে দিতে কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করতে। অনর্থক কথা না বলে সার কথাটুকু বলুন। দেখবেন যা বলছেন সবাই তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। চেষ্টা করুন যা ঘটেছে বা যা সত্য তাই বলতে।
কুরআন কী বলে:- ‘মানুষ যে কথাই বলুক না কেন, তার কাছে একজন তৎপর প্রহরী প্রস্তুত থাকেন।’ (সুরা কাফ, আয়াত: ১৮)
‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের সালাতে। যারা অসার ক্রিয়াকলাপ বা নিরর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।’ (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-৩)
৩. আঘাত দিয়ে কথা বলা:- আপনি স্পষ্টবাদী, এর অর্থ এই নয় যে অন্যকে আঘাত দিয়ে কথা বলবেন। কেউ আপনার মত নাও হতে পারে।
সমাধান:- মনে রাখবেন অন্যকে আঘাত দেওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। অনেক কঠিন কথাও অনেক সুন্দর করে বলা সম্ভব। এ অভ্যাস রপ্ত করুন। কথা বলার সময় সচেতন থাকুন যেন আপনার কথায় কেউ কষ্ট না পায়।
হাদিস কী বলে:- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে রেওয়াত করেন যে, কোনো মুমিন তিরস্কারকারী, লানতকারী, গালিগালাজকারী, খারাপ-মন্দ উচ্চারণকারী হতে পারে না।
আরবী প্রবাদ:- তীরের ক্ষত শুকিয়ে যায় তবে মুখের কথার আঘাত শুকায় না।
৪. অন্যকে বলতে না দেয়া:- অনেকেই এক তরফা কথা বলতে থাকেন। অথচ আলোচনা বা আড্ডার সময় অন্যের কথাও শুনতে হয়, বলার সুযোগ দিতে হয় এ খেয়াল থাকে না।
সমাধান:- আলোচনা বা আড্ডায় ভালো শ্রোতার কদর অনেক। আগে অন্যের কথা শুনে তারপর বলুন। খেয়াল রাখুন, অন্যরা বলার সুযোগ পাচ্ছে কিনা। নিজে কম কথা বলে অন্যকে বলতে দিন।
কুরআন কী বলে:- ‘তুমি পদক্ষেপ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে, কেননা স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৯)
৫. কথা না রাখা:- অনেকেই আছেন কথা দেওয়ার সময় হয়তো না বুঝেই কথা দিয়ে ফেলেন। পরবর্তিতে রক্ষা করতে পারেন না। তেমনি সবসময় দেরি করে পৌঁছানোও বাজে অভ্যাস। দেরি করে আসার কারণে অনেকেই হয়তো বিরক্ত হন এবং বিড়ম্বনায় পড়েন।
সমাধান:- খেয়ালের বশে কখনো কাউকে কথা দিবেন না। কথা দেওয়ার সময় সচেতন থাকুন, আপনি রক্ষা করতে পারবেন তো? কথা দেওয়ার পর যদি বুঝতে পারেন আপনি রাখতে পারবে না তবে আগেভাগেই জানিয়ে দিন। যাতে আপনার জন্য কারোর অসুবিধা না হয়। সময়ানুবর্তিতা জীবনের জন্য জরুরী। সব সময় হাতে সময় নিয়ে বের হবেন। যাতে নির্দিষ্ট সময় পৌছাতে পারেন।
কুরআন কী বলে:-‘হে ইমানদাররা! তোমরা কেন এমন কথা বল যা কাজে পরিণত কর না, এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণিত কাজ যে তোমরা বল এমন কথা যা করবে না।’ সুরা সাফ, আয়াত ২-৩।
হাদিস কী বলে:- হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল এরপর তা রক্ষা করল না।’ মুজামুল আওসাত, তারিখে দিমাশক।
৬. হিংসা করা:- হিংসা জীবনকে পিছিয়ে দেয়। অপরের ভালো বা সুখ দেখে হিংসা না করে বরং নিজে সেই গুণগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন।
সমাধান:- নিজের যা কিছু আছে তা নিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্ট করা উচিত। বরং হিংসা না করে অন্যের ভালো কিছু অনুসরণ করে সে রকম হওয়ার চেষ্টা করুন। নিজে নিজে অনুধাবন করার চেষ্ট করুন, আপনি হিংসা করছেন, এত আপনার কোনো লাভ হচ্ছে কি?
হাদিস কী বলে:- নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন কাঠের টুকরাকে খেয়ে ফেলে। (জ্বালিয়ে দেয়)। (আবু দাউদ, মিশকাত)।
৭. সন্দেহ করা:- সন্দেহ নিঃসন্দেহে খারাপ অভ্যাস। সম্পর্কে ফাটল ধরায়। সন্দেহপ্রবণ মানুষ নিজেকে নিয়ে নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত থাকে। তার এ অভ্যাসে অন্যরাও বিরক্ত হয়।
সমাধান:- কাউকে সন্দেহ না করে বরং ওই ব্যক্তিকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করুন। আসল সত্যটা জানার চেষ্টা করুন। সন্দেহ থেকে দুরে থাকার সবচেয়ে ভালো পন্থা নিজের বিষয়ে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া। আপনি এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন না- এমন আত্মবিশ্বাস ধরে রাখুন। আপনাকে কেউ সন্দেহ করলে চুপ থাকুন। আসল সত্য এমনিতেই বেরিয়ে আসবে।
কুরআন কী বলে:-‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ (অহেতুক) অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ (অহেতুক) অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)
৮. পরনিন্দা করা:- কারণে-অকারণে অপরের দোষ-ত্রুটি সবাইকে বলে বেড়ানো বাজে অভ্যাস। অনেক সময় অপরে যা করেনি তাও বানিয়ে বানিয়ে বলতে দেখা যায় কাউকে।
সমাধান:- অপরের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখুন। প্রচার করবেন না। মনে রাখবেন, আপনারও ভুল হতে পারে। পরনিন্দা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কে ফাটল ধরায়। এরকম বাজে অভ্যাস হলে নিজে নিজে সচেতন হয়ে কাটিয়ে উঠুন।
কুরআন কী বলে:-‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের পেছনে নিন্দা করো না। তোমাদের কেউ কী স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা একেবারেই ঘৃণাই করো। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)
৯. অন্যের দোষ খোঁজা:- অযথা কারো দোষ ধরবেন না। কেউ কোনো ভুল করলে অন্যায় করলে নিজেই সংশোধন করে দিন। কারো কথা বার্তা, চালচলন পছন্দ না হলে চুপ থাকুন, তবে সেটা যদি আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
সমাধান:- অন্যের দোষ না খুঁজে, তার ভাল দিক খুঁজে বের করার মধ্যেই আনন্দ। দোষ যদি বলতেই হয় সবার সামনে না বলে আড়ালে শুধরে দিন।
কুরআন কী বলে:-‘তোমরা একজন অপর জনের দোষ-ত্রুটি খোঁজা-খুঁজি করো না এবং এবং কারও অগোচরে গিবত করো না।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)
১০. পক্ষপাতিত্ব করা:- আপনার বন্ধু বা আপনজন অন্যায় করলে, খারাপ ব্যবহার করলে তাকে ছেড়ে দিবেন না। নিরপেক্ষ বিচার করুন। অন্যায় করলে ক্ষমা চাইতে বলুন। পক্ষপাতহীন আচরণ ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় করে।
সমাধান:- পক্ষপাত দুষ্ট মানুষকে কেউ পছন্দ করেন না। পক্ষপাত আচরণে অন্যের ক্ষতি হতে পারে। কোন কিছু করার আগে অন্তত একবার ভেবে দেখুন সবার প্রতি আচরণ ঠিক আছে কিনা। নিজে বুঝতে না পারলে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আলোচনা করে নিতে পারেন।
হাদিস কী বলে:- রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন। ’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
১১. মোবাইলে কথোপকথন:- অনেকেই অহেতুক জোরে জোরে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। অন্যরা এতে বিরক্ত হতে পারে। অনেকে আছেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যেও কথা বলতে থাকেন। অনেকের মোবাইল ফোনের রিংটোনও অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধান:- মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় খেয়াল রাখুন আপনার কথায় অন্যের অসুবিধা হচ্ছে কিনা। জরুরী হলে অন্য জায়গায় গিয়ে কথা বলুন। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় ফোন সাইলেন্ট রাখুন। কাছের মানুষদের জানিয়ে রাখুন এ সময় আপনি ব্যস্ত থাকেন, জরুরী না হলে ফোন না করতে। ফোনের রিংটোন আপনার রুচির প্রকাশ করে। তাই সচেতন থাকুন।
হাদিস কী বলে:- আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) তোমাদের মতো দ্রুত কথা বলতেন না। বরং তিনি কথা বলতেন স্পষ্ট ভাষায়, পৃথক পৃথক বাক্যে। ফলে উপস্থিত যে কেউ তার কথা সহজেই মুখস্থ করে নিতে পারত।’ (শামায়েলে তিরমিজি, পৃষ্ঠা ১৮)
১২. আরও যত বাজে অভ্যাস:-
- আঙ্গুল মটকানো।
- নাক-মুখে রুমাল বা হাত না দিয়ে দাঁত খোঁচানো বা হাঁচি কাশি দেয়া।
- যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলা।
- মেঝেতে পা ঘষে হাঁটা।
- দাঁত দিয়ে নখ কাটা।
- উচ্চস্বরে কাশি দিতে থাকা।
- বেতন ও বয়স কত জিজ্ঞেস করা।
- সন্তান হচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করা।
কিভাবে ত্যাগ করবেন:- অভ্যাস তো আপনিই সৃষ্টি করেছেন। আপনার তো ভালো অভ্যাসও আছে। সুতরাং অভ্যাসের পরিবর্তন করার দায়িত্বটাও একান্তই আপনার। তার জন্য প্রয়োজন শুধু নিজের সচেতনতা আর সদিচ্ছা। বাজে অভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন থাকুন। কাছের জনকেও বলুন শুধরে দিতে। আপনার আশপাশে এমন মানুষ আছে যাদের মধ্যে আপনার বাজে অভ্যাসগুলো নেই। তাদের অনুসরণ করতে পারেন। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১৩. আরো কিছু দোষনীয় বিষয়:-
- জামায় আতর বা পারপিউমের দাগ লেগে থাকা।
- মুখের দুর্গন্ধ।
- কাপড়ে/শরীরে ঘামের গন্ধ।
- জুতা কালি করতে সময় না থাকা।
- খাবারগ্রহণ কালীন শব্দ করা।
- চা পানের সময় শব্দ করা।
- আপেল/কমলা চিবিয়ে/ফ্রিজে রাখা।
- পানি পরিবেশনের সময় গ্লাস ধুয়ে গ্লাসের গায়ের পানি না মুছে পানি দেয়া।
- মোজা/গেঞ্জি গন্ধ হবার পরও তা ব্যবহার করা/স্প্রে ব্যবহার করা।