আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে খালদুন(১৩৩২-১৪০৬), ইসলামিক বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠতম মনীষীদের অন্যতম, যিনি তাঁর মহত্তম অবদান ‘মুকাদ্দিমার’ জন্যই সর্বাধিক বিদিত। অন্য যে কোনো মুসলিম চিন্তকের তুলনায় ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বিষয়ে তিনি সমৃদ্ধ সাহিত্য ভান্ডারের অধিকারী।
উত্তর আফ্রিকার তিনি যে অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, সমাজসমূহের সুগভীর পর্যবেক্ষণ তাঁকে চালিত করে সার্বজনীন ইতিহাস এবং বিশ্বসভ্যতার একটি কৌতুহল-উদ্দীপক ধারণা নির্মাণের পথে। উৎকৃষ্ট বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি প্রধান প্রধান জ্ঞানের শাখাসমূহের অদম্য সমঝদার ইবনে খালদুন ছিলেন একইসাথে ধ্যানী ও কর্মী, চিন্তানায়ক ও কর্মবীর। অনেকে যথার্থই তাঁকে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করেন। ইতিহাসবেত্তাগণ পরাশক্তিসমূহের উত্থান পতন ব্যাখ্যায় তাঁর প্রজ্ঞার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সামাজিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন ও রুপায়নে অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের সক্ষমতা বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির জন্য তারিফ করেন মার্ক্সবাদীরাও।
সাম্রাজ্যের সাফল্য এবং ব্যর্থতা পর্যালোচনায় উসমানী রাষ্ট্রজ্ঞ এবং ইতিহাসবেত্তাগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁর ‘আসাবিয়্যাহ’র অন্বেষায় নিয়োজিত ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে সভ্যতা বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে দেখেন। তাঁর কাছে আপনি যেদিক থেকেই যান না কেন, তাঁকে পাবেন অপরিমেয় উপকারী এবং স্থায়ী প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত হিসেবে। আজ যারা ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা এবং বৈশ্বিক অব্যবস্থাপনায় জিন্দেগী গুজরান করছি, আমাদের জন্য ইবনে খালদুনের একটি বিশেষ বার্তা আছে। ইতিহাস যদি সাক্ষী হয়, ইবনে খালদুনের প্রধান বিষয়সমূহের অন্যতম যেটি, আমাদের জানায় যে, একটি সমাজের বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতা ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হল ‘ঐক্য এবং সংহতি।’
প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ ‘রাজনৈতিক সত্তা’, এই অর্থে যে, বংশধারা সংরক্ষণ, মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূর্ণকরণ এবং নিজেদের ‘সভ্য’ হয়ে ওঠার সক্ষমতা উপলব্ধি করতে তারা যুথবদ্ধভাবে বসবাসে বাধ্য। মানব প্রকৃতির সহজাত ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলির ব্যবহার শুরু হয় মূলত জনমানুষের পারষ্পরিক সাহায্য এবং সহাবস্থান শিখে ফেলার পরই। এ জন্য প্রয়োজন একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিমালা, যা’কে ঘিরে তারা ঐক্যবদ্ধ হয় বা হতে হয়। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটা অধিবিদ্যাগত ভিত্তি(metaphysical foundation)। যেটা ছাড়া কোনো সভ্যতাই সম্ভব নয়।
যারা তাদের সামাজিক সংযোগজনিত ঐক্য(social cohesion) এবং জাতিগোষ্ঠীগত সংহতি (group solidarity) হারিয়ে ফেলে তারা অন্যদের নিকট পদানত হয়। এই অন্যরা কারা? -যাদের সেই ঐক্য, পরাক্রম ও সহনশক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। তো, একটি মানবগোষ্ঠীকে ঠিক কিসে ঐক্যবদ্ধ রাখে, এটিই ছিল ইবনে খালদুনের সর্বাধিক মৌলিক অনুসন্ধান। এটিই সমস্ত সংস্কৃতি, সভ্যতা, রাজনৈতিক আধিপত্যের (রাষ্ট্রশক্তি) গোড়া। এই মৌলিক উপাদানটি বাদ দিয়ে কোনো মানবগোষ্ঠী, গোত্র, উপজাতি, জাতি বা বড় কোনো সম্প্রদায় রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। পারে না কোনো নগর বা নাগরিক জীবন নির্মাণ এবং সেটি সংরক্ষণ ও পরিচালনা করতে। ঠিক এখানটাতেই আমাদের সাক্ষাৎ হয় ইবনে খালদুনের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় ‘আসাবিয়্যাহ’ তথা গোষ্ঠীয় সংহতি এবং সামাজিক ঐক্যের সাথে। (এই খালদুনীয় প্রত্যয়টি অনুবাদ করার অসুবিধা এবং বিভিন্ন ভাষায় এটিকে বোঝানোর বিবিধ প্রয়াসই এর গুরুত্বের মৌলিকতা প্রমাণ করে)।
আসাবিয়্যাহ হলো সেই আঠা যা একটি দলকে যুথবদ্ধ করে। এটি তাদের বাইরের আগ্রাসী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার শক্তি এবং সক্ষমতা দেয়। তাদের নিজেদের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম করে তোলে। সেইসাথে প্রস্তুত করে তোলে ‘উমরান’ তথা সভ্যতা গড়ে তুলতে। কিন্তু এখানে আমরা একটি বড় ধরনের খালদুনীয় দ্বিধার মুখোমুখি হই। যখন একটা জনগোষ্ঠী আসাবিয়্যাহ দ্বারা সংগঠিত এবং ক্ষমতায়িত হয়ে নাগরিক জীবনে পৌঁছে এবং সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে, তখন তারা তাদের সামাজিক সংযুক্তি এবং সংহতির অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। শহুরে ব্যবস্থাপনায় সভ্য জীবনের সুবিধা এবং স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে শুরু করা মানুষ ক্রমাগত হয়ে উঠে নৈতিকশক্তিহীন, গোঁফখেজুরে এবং ‘এতোই কৌতুক-কোমল’ যে “বেদুইন গুণসম্পন্ন” এবং যোদ্ধা বৈশিষ্ট্যাবলীর কোনো গোষ্ঠীর আক্রমণের মোকাবিলায় নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ থাকে না। তখন তাদের নিয়তি হয়ে ওঠে অন্যকোনো শক্তির পদানত হওয়া। এটা সংঘটিত হওয়া তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তাহলে, খালদুনীয় তত্ত্ব বা নকশায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, সভ্যতার জন্য যেকোনো মানবগোষ্ঠীকে বলী দিতে হয় তার সামাজিক সংযুক্তি, গোষ্ঠীগত সংহতি এমনকি সেইসব উন্নততর বৈশিষ্ট্যাবলীও, যেগুলো নিয়ে তারা উন্নীত হয়েছে সভ্যতার পর্যায়ে। আবার, যারা তাদের ‘আসাবিয়্যাহ’ খুইয়ে বসে তারা হারিয়ে ফেলে তাদের ‘আসালা’ তথা স্বতন্ত্র মর্যাদাও। এটাই হয়ে উঠে একটি পুনরাবৃত্ত বিষয়, একটি চিরন্তন সামাজিক চক্র, যে কার্যকারণে গোত্র, জাতি, রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য উত্থিত এবং পতিত হয়েছে।
ইবনে খালদুনের মতে, এইরকম একটি চক্রের জীবনকাল মোটামুটি চার প্রজন্ম নাগাদ, যা এক শতাব্দী থেকে কিছু বেশি হয়। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক সংযোগ ও ঐক্যের মূলভিত্তি হলো, আত্মীয়তা। জাতিত্ব। এছাড়া এমন কোনো বলিষ্ঠতর এবং টেকসই বন্ধন নেই, যা মানুষকে সংঘবদ্ধ রাখতে পারে।
যাদের মধ্যে শক্তিশালী জ্ঞাতিত্বের বন্ধন বিদ্যমান কেউ তাদের আক্রমণের স্পর্ধা দেখাতে চাইবে না। কিন্তু যখনই তারা নগরের অধিবাসী, নগরায়িত সভ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় তখন তাদের জ্ঞাতিত্বের টানে ভাটা পড়ে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আপনি আপনার ‘আসাবিয়্যাহ’র মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে নাগরিক জীবন এবং সভ্যতাকে উপনীত হবেন; কিন্তু যখনই একটি স্থায়ী, সুস্থির এবং সভ্য জীবনের সুফল ভোগ করা শুরু করবেন, আপনি আপনার সংযোগ-সংহতি হারিয়ে ফেলবেন। ইবনে খালদুন এই গোলকধাঁধা থেকে বেরুবার কোনো পথ দেখতে পাননি।
স্পষ্টতই, এই খালদুনীয় তত্ত্বটি উপজাতির মতো ছোট গোষ্ঠীসমূহে বোধগম্য হয়, কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক এককসমূহ এবং কিভাবে তারা দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তা ব্যাখ্যায় যথেষ্ট নয়। আবার আমাদের আধুনিক দুনিয়ার জটিলতা তার তত্ত্বকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। আমরা তাহলে কি করতে পারি এখন? তার তত্ত্বকে অতি ক্ষুদ্র গোত্র ভিত্তিক, উপজাতীয় এবং সেকেলে বলে ফেলে দেবো?
উত্তর হলো- না।
জাতিত্ব এবং উপজাতীয় বন্ধনের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্য এবং গোষ্ঠীয় সংহতির ধারনায় যখনই আমরা সমস্যাযুক্ত কিছু পাচ্ছি;- বৃহত্তর নাগরিক এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় সামাজিক ঐক্য, নগরায়ন এবং সভ্যতার মৌলিক জিজ্ঞাসাসমূহ ধরার জন্য আমাদের উচিত তার বিশ্লেষণকে পরিমার্জিত এবং বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা।
এটি জরুরী একটি কাজ, বিশেষত সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের জন্য যারা সামাজিক সংহতি এবং সভ্যতাগত ঐক্য দুটোরই অভাবজনিত অসুস্থতায় আর্তনাদ করছে। ব্যর্থ এবং দুর্বল রাষ্ট্র, অ-রাষ্ট্রীয় চক্রসমূহের দৌরাত্ম, গোত্রবাদীতা, দলাদলি, নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ এবং আরো অগণিত সমস্যায় মুসলিম সমাজ আজ জর্জরিত। তাই আগ্রাসী শক্তিসমূহের মোকাবিলায় নিজেদেরকে রক্ষা করা এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্মাণে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বস্তুগত সম্পদসমূহের সম্ভাবনা উপলব্ধি করার মতো যেকোনো ”আঠা” থেকে বঞ্চিত।
ইবনে খালদুনের সামাজিক ঐক্য এবং সামষ্টিক সংহতির ধারণাটি আল-কুরআনের সূরা আনফালের ৪৬তম আয়াতের সাথে সম্পর্কিত: “এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, এবং পারষ্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হয়ো না, তাহলে তোমাদের সাহস নড়েবড়ে হয়ে উঠবে এবং তোমাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হবে; তোমরা বরং অবিচল থাকো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।”
একই গোষ্ঠী বা জাতির সদস্যরা যখন ধ্বংসাত্মক কায়দায় পারষ্পরিক কলহে লিপ্ত হয়, তখন তারা তাদের ‘দম’, তথা শক্তি হারায় এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সমসাময়িক মুসলিম সমাজসমূহের জন্য ইবনে খালদুন পড়ার এটাই উৎকৃষ্ট সময়। পড়তে হবে তাদের চলমান দুর্দশার আলোকে। সামাজিক সংহতি এবং নগর সভ্যতা দুটোকে যুগপৎ বজায় রাখা একটি কঠিন কর্ম বৈকি। কিন্তু এটি একটি চ্যালেঞ্জ, আমাদের জীবনের অলিগলিতে ঝেঁকে বসা বিস্তর আধুনিক ব্যায়রাম অতিক্রমে, যার মোকাবিলা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।