পৃথিবীতে বহু শক্তির উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। এই পরাশক্তিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকেছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। আরবের দুই প্রতিবেশী তথা রোমান ও পারস্য। তৎকালীন পৃথিবীর দুই পরাশক্তি। যাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সাপেনেউলে মারামারি লেগে থাকতো।
কন্সটেন্টিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তার রাজ্য, তথা রোমান রাজ্যের সবাইকে খ্রিষ্টান হওয়ার জন্য আদেশ দেন। এতে দেখা গেলো সবাই তাদের ধর্ম বদলে ফেললো। বাইজেন্টাইন রাজ্য আস্তে আস্তে হয়ে উঠলো খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে খ্রিস্টধর্ম খুবই প্রসার পেল।
এদিকে আরেক পরাশক্তি তথা পারস্য শতশত বছর ধরে বিশাল একটা অঞ্চল শাসন করে আসছিল। পৃথিবীর অর্ধেক অঞ্চল তাদের কন্ট্রোলে ছিল। কিছু কিছু অঞ্চলে একটু সমস্যা দেখা দিলেও সময়ের সাথে সাথে সেখানেও তাদের শাসনক্ষমতা আরও জোরদার করে তুলে। পারস্যের মানুষদের মাজূসী বলা হয়। মাজূস মানে অগ্নিপূজক। তারা অগ্লিপূজা করতো। মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীর সবাই আল্টিমেটলি এক খোদায় বিশ্বাস করলেও তারা দুই খোদায় বিশ্বাস করে।
এই দুই পরাশক্তির মধ্যখানে বাস করতো পৃথিবীর সনাতন ধর্মের অনুসারী, যারা হলো ‘ইহুদী।’ মূসা আলাইহিসসালামের মৃত্যুর পর তারা আরেক নবীকে নিয়ে যুদ্ধ করে আল্লাহর সাহায্যে বিজয় অর্জন করে। তাদের বাসস্থান ছিল জেরুজালেম ও তার আশপাশ।
জোর যার মুল্লুক তার। প্রাচীন কাল থেকে রোমান আর পারস্যরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সময় পার করতে থাকে। যুদ্ধ করা তাদের জন্য ছিল প্রায় উৎসবের মতন। কিছু দিন রেস্ট নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় জায়গা দখলের মারামারি। একবার রোমান জিতে তো আরেকবার পারস্য। এই দুই দলের মারামারির মধ্যে যে বিজয় অর্জন করতো জেরুজালেম তার কন্ট্রোলে চলে যেত।
এদিকে জেরুজালেমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো ইহুদীরা। দুই পরাশক্তির যে-ই জিততো সে-ই চালাতো তাদের উপর নির্মম অত্যাচার। এসব অমানবিক অত্যাচারের কারণে তারা তাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথম দিকের নির্যাতনের কারণে কিছু কিছু গোত্র চলে গেলেও থেকে যায় অনেকে। কিন্তু জেরুজালেম বিজয় করে দুই দলই তাদের উপর চালাতো অমানবিক অত্যাচার। একটা পর্যায়ে রোমানরা বাইতুল মুকাদ্দিস ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। ইহুদীদের কিছুই করার ছিল না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া।
এদিকে পারস্যরা একবার তাদের উপর চালালো গণহত্যা, যা ছিল ন্যাক্কারজনক একটি অধ্যায়। ইহুদীরা তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে অনেককে প্রাণ হারাতে হয় পরিবারসহ। শেষ অব্দি দেখা গেলো যে, এখানে থাকা বড় দায়। এই কারণে ইহুদীদের বেশিরভাগ গোত্র সেখান থেকে চলে আসে ইয়েমেনের দিকে। কিছু সংখ্যক ইহুদী সেখানেই থেকে যায়।
ইয়েমেনে ইহুদীরা গড়ে তুলে তাদের নতুন বসতি। তারা সেখানে তাদের জীবন অতিবাহিত করতে থাকে নতুনভাবে। এভাবে কেটে যায় বহু বছর। ইয়েমেন হয়ে উঠে ইহুদিদের অন্যতম শক্তিশালী ঘাটি।
এদিকে নাজরান অঞ্চল হলো আরবের বর্ডার। রোমানদের কাছে থাকায় সেখানে রোমানরা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করতে থাকে। নাজরানবাসী দলে দলে তাদের ধর্মে যোগদান করতে থাকে। নাজরানে ভালোভাবে ঘাটি গড়ে তুলে খ্রিষ্টানরা। নাজরান হয়ে উঠে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা।
ইহুদীরা খ্রিষ্টানদের অচ্যাচারের কথা বহুকাল ধরে মনে করে আসছে। ইয়েমেনে তারা তাদের অঞ্চল বানিয়ে ফেললো। ইয়েমেনের কিছুটা অঞ্চল হাবাশীদের কন্ট্রোলে ছিল কিন্তু এক সময় ইয়েমেন পুরোটাই পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ইহুদীদের দাওয়াতের কারণে সেখানের বেশিরভাগ মানুষজন ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে ইহুদি হয়ে যায়। এক সময় তাদের একজন সম্রাট হয়, যার নাম “যূ নূয়াস।”
কিছুটা শক্তি অর্জন করার পর ইহুদী সম্রাট “যূ নূয়াস” তার বাহিনী নিয়ে হামলা করেন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি রোমানদের কন্ট্রোলে থাকা নাজরানে। আচমকা হামলা করায় নাজরানের খৃষ্টানরা তেমন কিছুই করতে পারেনি। “যূ নূয়াস” তাদেরকে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করার জন্য জোর করতে থাকলেন। কিন্তু খ্রিষ্টানরা সাফ না করে দিলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি আগ্নিকুণ্ড বানিয়ে সেখানে ছুড়ে ফেলে দিলেন বহু খ্রিষ্টানকে।
খবর পৌঁছালো রোমান সম্রাটের কাছে। তিনি হাবাশার নাজ্জাশীকে চিঠি দিয়ে বলে দিলেন তাড়াতাড়ি যেন ইয়েমেনে ফোর্স পাঠানো হয়। যে-ই কথা সে-ই কাজ। নাজ্জাশী তার বাহিনী অস্ত্রসজ্জিত করে পাঠালেন ইয়েমেনে। সেই ফোর্সের নেতৃত্বে ছিলেন ‘আরিয়াত/য্বারিয়াত।’ তারা, মানে হাবাশীরা, ইয়েমেনে আবারও পা রাখে এবং সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। মজার ব্যাপার হলো সেই দলের অন্যতম মিলিটারি কমান্ডার ‘আবরাহা’ আরিয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এতে হাবাশীগণ দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে যুদ্ধ হলে আবরাহা তাদেরকে হারিয়ে দেন এবং সবকিছু নিজের করে ইয়েমেনের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবরাহা ছিলো খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। সে ইয়েমেনের সানা নগরীতে বিখ্যাত চাকচিক্যময় একটি গির্জা নির্মাণ করলো।
অনেক বছর পরে ইয়েমেনবাসী আররাহার বাহিনীক তথা হাবাশীদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য পারস্যের সাহায্য নেয় এবং তাদেরকে ইয়েমেন থেকে উৎখাত করে। পরে ইয়েমেন চলে আসে পারস্যদের কন্ট্রোলে।
এদিকে হিরাহর অঞ্চল তথা ইরাক ও তার আশেপাশের অঞ্চল প্রথম থেকেই পারস্যদের কন্ট্রোলে ছিল। কিন্তু মধ্যখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে শামের কিছুটা অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে বসে কিন্তু পরবর্তীতে পারস্য সম্রাট তার বুদ্ধি খাটিয়ে সম্পূর্ণ রাজ্য ভালোভাবে পরিচালনা করে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হোন। এসব অঞ্চলে বাস করতেন ইয়েমেন থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া গোত্রগুলো। কারণ ইয়েমেনে আল্লাহ তার আযাব দিয়েছিলেন যার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো অনেক কিছু। এই গোত্রগুলোকে বলা হয় ক্বাহতানী।
অন্যদিকে শাম অঞ্চল পুরোটাই ছিল রোমানদের কোন্ট্রোলে। এই অঞ্চল তাদের কখনো হাতছাড়া হয়নি। বহুকাল থেকেই তারা শাসন করে আসছিল। তাদের অন্যতম শক্তি ছিল শাম অঞ্চল। পৃথিবীর দুই পরাশক্তি যখন নিজেদের শক্তি প্রকাশে ব্যস্ত তখন তাদের চোখে অবহেলিত অঞ্চলে এমন এক সুপারপাওয়ারের আগমন আসছে যা তারা কল্পনাও করেনি কোনদিন। সেই শক্তি আসার পথে, আসছে খুবই শীঘ্রই।