আবু বকর আর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) নানান বিষয়ে দ্বিমত করতেন, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হতো, এমনকি চরম পর্যায়ের রাগারাগিও। ব্যক্তিগত মতামতের বেলায় তারা দুজন খুব কম সময়ই একমত হতেন। তাঁদের কাছে কোনো পরামর্শ চাওয়া হলে একজন বলতেন, এই দিকে যান, তো আরেকজন বলতেন, না ঐদিকে যান।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে সাহাবীদের কাছে জানতে চান। আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মত দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা তো আপনারই লোক, আপনারই পরিবার। তাদেরকে জীবিত রাখুন এবং সুযোগ দিন। হয়তোবা আল্লাহ তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার তাওফিক দেবেন।”
উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মত দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরাই তো আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, এরাই তো আপনাকে অবিশ্বাস করছে। (এখন তাদেরকে কিসের ক্ষমা) সুতরাং, আপনি তাদের শিরচ্ছেদ করুন”। দুজন সিনিয়র সাহাবী দুই ধরণের মত দিচ্ছেন। একজন বলছেন ক্ষমা করার কথা, তো আরেকজন বলছেন শাস্তি দেবার কথা।
কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আল্লাহ কারো হৃদয়কে এতোটা কোমল বানিয়েছেন যা দুধের মতো, আবার কারো হৃদয়কে এতোটাই কঠিন বানিয়েছেন যা পাথরের মতো। আবু বকর! তুমি হলে ইব্রাহিমের (আঃ) মতো, যিনি বলেছিলেন- ‘যে আমার অনুসরণ করেছে নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হয়েছে তবে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।[সূরা ইব্রাহিম ১৪:৩৬]।
আবার তুমি হলে ঈসার (আঃ) মতো৷ যিনি বলেছিলেন, ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারা আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। [সূরা মায়িদাহ ৫:১১৮]।
আর উমর! তুমি তো হলে নূহের (আ:) মতো। যিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের উপর কোন কাফিরকে অবশিষ্ট রাখবেন না’ [সূরা নূহ ৭১:২৬]।
আবার তুমি হলে মূসার (আঃ) মতো। যিনি বলেছিলেন, ‘হে আমাদের রব, তাদের ধন-সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দিন, তাদের অন্তরসমূহকে কঠোর করে দিন। ফলে তারা ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেখে’ [সূরা ইউনুস ১০:৮৮]।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুজন বিশিষ্ট সাহাবীর দ্বিমতকে দুজন-দুজন চারজন নবীর সাথে তুলনা করে দেখান, এসব বিষয়ে নবীরাও ভিন্নমত পোষণ করতেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদেরকে ছেড়ে দেন। [মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৩২]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেকটা আবু বকরের (রা:) মত গ্রহণ করেন। কিন্তু, আল্লাহর রায় ছিলো ভিন্ন। সেটা উমরের (রা:) সাথে মিলে যায়। আল্লাহ বলেন: “কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার নিকট যুদ্ধবন্দি থাকবে (এবং পণের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে মুক্ত করবেন) যতক্ষণ না তিনি যমীনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, অথচ আল্লাহ চাচ্ছেন আখিরাত। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।” [সূরা আনফাল ৮:৬৭]
আল্লাহ উমরের (রা:) মত সমর্থন করেন। এই নিয়ে উমর (রা:) আবু বকরকে (রা:) সমালোচনা করেননি- ‘কী আবু বকর! দেখলে তো আল্লাহ আমার মতের সমর্থন দিয়েছেন’। বরং, তারা একসাথে থেকেছেন, একে অন্যকে সাহায্য করেছেন। আবার কোনো মতামত চাওয়া হলে দ্বিমত করেছেন, আবার মিলেমিশে চলেছেন।
আরেকবার বনু তামিম গোত্রের এক লোক নির্বাচন করার সময় আবু বকর (রা:) একজনের নাম প্রস্তাব করেন, উমর (রা:) বলেন আরেকজনের নাম। আবু বকর (রা:) রেগে গেলেন। উমরকে (রা:) বললেন, “আপনার ইচ্ছেই হলো আমার বিরোধিতা করা”। উমর (রা:) নিজেকে ডিফেন্ড করলেন- “না, আপনার বিরোধিতা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”
এই নিয়ে দুজন তর্কাতর্কি শুরু করেন। তর্কাতর্কি একসময় চরম পর্যায়ে চলে যায়। তারা দুজন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে উচু গলায় কথা বলেন।
এই নিয়ে আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে একটি আয়াত নাজিল করেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না”। [সূরা আল হুজুরাত ৪৯:২]
কুরআনের এই নির্দেশ আসার পর উমর (রা:) আস্তে আস্তে কথা বলা শুরু করেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এমন আস্তে বলতেন যে, দ্বিতীয়বার বলতে হতো। [সহীহ বুখারী: ৪৮৪৫]
আরেক দিনের ঘটনা। সাহাবীরা নবীর পাশে বসা ছিলেন। এমন সময় আবু বকর (রা:) পরনের কাপড়ের একপাশ এমনভাবে ধরে আসলেন যে তার দু’ হাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমাদের এ সাথী এই মাত্র কারো সঙ্গে ঝগড়া করে আসছেন। তিনি সালাম করলেন এবং বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এবং ‘উমর ইব্নু খাত্তাবের মাঝে একটি বিষয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। আমিই প্রথমে কটু কথা বলেছি। অতঃপর আমি লজ্জিত হয়ে তার কাছে মাফ চেয়েছি। কিন্তু তিনি মাফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার নিকট হাজির হয়েছি।”
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আল্লাহ্ তোমাকে মাফ করবেন, হে আবূ বকর (রা:)!” এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। এরপর উমর (রা:) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবু বকর (রা:)-এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল, ‘না’।
তখন ‘উমর (রা:) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট চলে আসলেন। (তাকে দেখে) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আবূ বকর (রা:) ভীত হয়ে নতজানু হয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্র রসূল! আমিই প্রথমে অন্যায় করেছি।” এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন।
তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আল্লাহ যখন আমাকে তোমাদের নিকট রসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, তুমি মিথ্যা বলছ আর আবু বকর বলেছে, আপনি সত্য বলছেন। তাঁর জান মাল সবকিছু দিয়ে আমার সহানুভূতি দেখিয়েছে। তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দিবে না?” এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন। অতঃপর আবূ বকর (রা:)-কে আর কখনও কষ্ট দেয়া হয়নি। [সহীহ বুখারী: ৩৬৬১]
আবু বকর আর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) ছিলেন রাসূলের শ্রেষ্ঠ দুজন সাহাবী। তারা এই কারণে শ্রেষ্ঠ না যে, তারা মতানৈক্য করেননি। তারাও মতানৈক্য করেছেন, একজনের আরেকজনের সাথে রাগারাগি করেছেন, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলেছেন।
তবুও তারা শ্রেষ্ঠ কেন? কারণ, তারা মনোমালিন্যের পর দুজন অন্যকে কাছে টেনে নেন। মতবিরোধকে আঁকড়ে ধরে পরষ্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হননি। শেষের ঘটনায় দেখতে পাই, আবু বকর (রা:) রাগারাগির পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে উমরের (রা:) কাছে ক্ষমা চান। রাগের মাথায় উমর (রা:) আবু বকরকে ক্ষমা করলেন না। উমরের রাগের বরফ গলতে শুরু করলে বুঝতে পারলেন, আবু বকরকে (রা:) ক্ষমা না করে ভুল করেছেন। তিনি ছুটে গেলেন আবু বকরের (রা:) বাড়ি।
অন্যদিকে উমর (রা:) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসলে আবু বকর (রা:) বুঝতে পারলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরের (রা:) সাথে রাগ করবেন।
যার সাথে একটু আগে আবু বকর (রা:) রাগ করেছেন এবার তাঁকে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগ থেকে বাঁচানোর জন্য আবু বকর (রা:) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ভুল তো আমি করেছি”। দুজন রাগারাগি করছেন৷ কিন্তু, কেউই চাচ্ছে না আরেকজনের শাস্তি হোক। মতপার্থক্যের উর্ধ্বে গিয়ে পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধের জন্য তারা আমাদের কাছে স্পেশাল হয়ে আছেন।
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর মুসলিমদের মধ্যে চরম সংকট দেখা দেয়। কে হবেন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলিফা? এই নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয়।
সাকিফার মিটিং -এ উমর (রা:) তাঁর হাত আবু বকরের (রা:) দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সর্বপ্রথম বায়াত নেন। এরপর সবাই আবু বকরকে (রা:) খলিফা হিশেবে মেনে নেয়। খলিফা আবু বকরের (রা:) ইন্তেকালের আগে তিনি উমরকে (রা:) পরবর্তী খলিফা বানিয়ে যান। সারাজীবন তারা নানান বিষয়ে মতবিরোধ করেছেন৷ কিন্তু, এই মতবিরোধ তাঁদের হৃদয়কে সংকীর্ণ করেনি। প্রশস্ত হৃদয়ে একজন আরেকজনকে গ্রহণ করেন।
পুনশ্চ: খলিফা হবার পর উমর (রা:) আবু বকরের অনেক পলিসিতে পরিবর্তন আনেন।
আবু বকর (রা:) সাহাবীদেরকে একই স্কেলে বেতন দিতেন, কোনো পার্থক্য করতেন না। কিন্তু, উমর (রা:) সাহাবীদের মধ্যে বেতনের স্কেল করেন। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস স্কেলে সাহাবীদেরকে বেতন দেন।
আবু বকরের (রা:) সময়ে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। উমর (রা:) খালিদকে (রা:) সরিয়ে আবু উবাইদাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেনাপতি বানান।
একজনের মৃত্যুর পরও অন্যজন তাঁর পলিসির সাথে দ্বিমত করেন। তাই বলে অন্যজনের সমালোচনা করেননি। খলিফা হবার পর উমর (রা:) প্রায়ই আবু বকরের কথা স্মরণ করে বলতেন, “আবু বকর কতোই না উত্তম ছিলেন, আমি যদি তাঁর মতো হতে পারতাম।”