সকাল থেকে ভীষণরকম মেজাজ চড়ে আছে শফিক সাহেবের। কি এক অফিস। একটা এমপ্লয়িও ঠিকমত কাজ করে না। উত্তরে যেতে বললে ঠিক তার উল্টো হাটা দেয় মানুষগুলো। কানে সমস্যা না কি অন্যকিছু আল্লাহ ভালো জানে। কিছুক্ষণ আগেই দিপুকে যাচ্ছেতাই বলে শাসিয়েছেন তিনি। দিপু বেশ রগচটা ছেলে। বয়স কম। রক্ত গরম। অফিরের ফ্লোর কাপিয়ে রিজাইন করে চলে গিয়েছে।
যাবার আগে অফিসের করিডোরে দাঁড়িয়ে বিশাল এক বিদ্রোহী ভাষণও দিয়ে গিয়েছে। টাকার গোলামি করে না দিপু। পেট চালাতে দরকার পড়লে ঠেলা ঠেলবে। তবু এই চাকরি করবে না। এমন আরো অনেক উঁচু দরের কথাবার্তা। অফিসটা তাই বেশ শোরগরম সকাল থেকেই। হাবভাব এমন যে এখন পান থেকে চুন খসলেই আরো ৫/৭জন রিজাইন করবে। শফিক সাহেবের যত জ্বালা। CEO বলে কথা। বন্ধু মহলে খুব কথা চলে, ‘আরে ব্যাটা, তুই তো CEO তোর আর কাজ কি। অথবা ‘তোর তো আর কারো গোলামি করা লাগে না। আমরা দিনরাত বসে গোলামি করে চলি। কামলা খাটি, মাটি কাটি।’
সবই কথার কথা। CEO মানে এখানে শুধু বসের গোলামি নেই। ঠিক। কিন্তু ইমপ্লয়ির মন মানিয়ে চলতে হবে। চলতে হবে ক্লায়েন্টের আবদার মেনে। সামলাতে হবে অফিস, মার্কেট। বাড়াতে হবে পাবলিসিটি। এমপ্লয়িইদের ৯টা-৫টা অফিস। আর CEO দের সারাদিন। হতে হবে মিষ্টিভাষি। জানতে হবে সব কাজের খুঁটিনাটি। ইন্ট্রোভার্ট CEO! ব্যাবসা লাটে। ধীরেধীরে ব্যাবসাটা বড় হলে সিস্টেম আপডেট হলে হয়তো সব আস্তে আস্তে ঠিক হবে। কিন্তু এখন…
anger management এর কিছু বই মোটামুটি গিলে খেয়েছেন শফিক সাহেব। পুঁথিগত বিদ্যা! কাজের কাজ শূন্য। সাবরিন যে কিভাবে সব পারে কে জানে! ও হ্যাঁ সাবরিনের পরিচয় দেয়া হয়নি। শফিক সাহেবের বিজনেস পার্টনার ও লাইফ পার্টনার। খুব ঠান্ডা মাথার মহিলা। সাবরিনের অনুপ্রেরণাতেই এই মাঝ বয়সে এসে চাকরি ছেড়ে এতো দিনের লালন করা স্বপ্নের ব্যাবসায় নামার সাহস পেয়েছেন শফিক সাহেব। সকালের ঘটনায় শফিক সাহেবের জায়গায় সাবরিন থাকলে হয়তো আজ অফিসটা এমন শাহবাগ মোড় হতো না। দিপুও হয়তো মঞ্চ কাঁপানো ভাষণ দিতো না। আর অফিসেও এমন ‘কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে দে কররে লোপাট।’ টাইপ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
শফিক সাহেব সাবরিনকে একটা কল দিলো। একটু পরামর্শ করা দরকার। দেখা যাক কোনো হাল পাওয়া যায় কিনা।
-আসসালামু আলাইকুম
-ওয়ালাইকুম আসসালাম, কি ব্যাপার? মুড অফ?
-তোমার সিসি ক্যামেরাতে কি মুড ডিটেক্টরও লাগানো আছে?
-হাহাহা… ক্যামেরাতে নেই। তোমার কন্ঠে আছে। বলো কি হয়েছে?
-দিপু রিজাইন করেছে।
-নিশ্চই তুমি ওকে ঝাড়ি দিয়েছো।
-আরে…..
-না, একদম কথা পাল্টাবে না।
-হ্যাঁ। কিন্তু ও ঝাড়ি দেয়ার মতই কাজ করেছিলো।
-কি?’
ক্লায়েন্ট একরকম ডিজাইন চেয়েছে। ওকে আমি সবটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। ও সারারাত জেগে কাজ করেছে। কিন্তু যা ক্লায়েন্ট চেয়েছে ঠিক তার উল্টো একটা ডিজাইন রেডি করেছে। বুঝতে পারছো তুমি, কি পরিমাণ ঝামেলা পাকিয়েছে ও। আর এখন রিজাইন করে চলে গিয়েছে। অথচ আজই ক্লায়েন্টকে ডিজাইন দেখাতে হবে।
-আচ্ছা, বাদ দাও তো। এতো টেনশন নিও না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি? আজই পড়লাম।
-এই ঝামেলাতে তোমার ঘটনা মনে পড়ছে। উফফ।
-শুনবে নাকি ফোন রেখে দিবো! আমার হাতে কিন্তু অনেক কাজ আছে।
-হ্যাঁ বলো বলো।
-মক্কা বিজয়ের ঘটনা।
-জানি তো আমি।
-মাশাআল্লাহ! তুমি তো অনেক কিছু জানো!
-মজা নিলা!
-জানলেও আবার শোন।
-উফফ! জ্বি ম্যাডাম। বলুন শুনছি।
-রাসুলাল্লাহ সা. বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন।
-বেশি সময় নেই আমার। শর্টে বল।
-শোনো, শান্ত হয়ে বুঝার চেষ্টা করো। তা না হলে বাকি দিনটায় আরো অনেক ঝমেলা পাকবে।
-চেষ্টা করছি। বলো।
-তো তিনি (সা.) মক্কার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে যেটুকু না করলেই নয় ঠিক সেটুকুই যুদ্ধ করলেন। এমন সময় রাসুলাল্লাহ সা. কে জানানো হলো…
-কি?
-ইয়া রাসুলাল্লাহ সা. আপনি কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু খালেদ বিন ওয়ালিদ তো যাকে পাচ্ছে তাকেই হত্যা করছে।
-হ্যাঁ! সাবরিন। পুরো ঘটনাটাই আমি জানি। তারপর তিনি সা. খালেদ বিন ওয়ালিদকে হত্যা থেকে হাত তুলে নিতে বললেন। যে সাহাবীকে দিয়ে খবর পাঠানো হল তিনি বুঝতে ভুল করলেন। যা বুঝলেন সেই মত বললেন যে খালিদ বিন ওয়ালিদ যেন যাকে পায় তাকেই হত্যা করেন। ফলে উনি প্রায় সত্তুর জনকে হত্যা করলেন। -এক টানে সবটা বলে দিলেন শফিক সাহেব।
-তারপর?’
-তারপর আর কি…… একটু বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে থামলেন শফিক সাহেব। কিছুটা শ্বাস নিয়ে দ্রুত বললেন, ‘অন্য একজন এসে রাসুলাল্লাহ সা. কে বললেন যে খালিদ তো হত্যা করেই চলছে। এটা শুনে রাসুলাল্লাহ সা. খুব অবেক হলেন। তিনি খালিদকে ডেকে পাঠালেন আর জিজ্ঞেস করলেন নিষেধ করার পরও কেন উনি হত্যা করলেন। তারপর খালিদ সবটা বুঝিয়ে বলল’।
-তারপর?’
-তারপর আর কিছু না সাবরিন। কণ্ঠে বিরক্তির লেসটা এখনো যায়নি শফিক সাহেবের।
-তারপর, রাসুলাল্লাহ সা. সেই লোকটাকে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কি হত্যা থেকে হাত তুলে নিতে বলিনি?” এতে লোকটা তার ভুল বুঝতে পারলো।
-হ্যাঁ! এখন আর ভুল বুঝে কি ফায়দা। ততক্ষণে যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। ৭০ জনের মত মানুষ হত্যা হয়ে গিয়েছে। রাশভারী কন্ঠে বললেন। ‘কিন্তু এই সময়ে লোকটা কি বললো জানো?’
-মনে পরছে না এখন। পড়েছিলাম তো। কি বললো?
-বললো, “রাসুলাল্লাহ সা. আপনি একটা চেয়েছেন আর আল্লাহ চেয়েছেন আরেকটা। আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে। যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গিয়েছে।”এই কথা শুনে রাসুলাল্লাহ সা. থেমে গেলেন। তো CEO সাহেব, কিছু কি বুঝলেন?’
-তুমি কি তাহলে ডিজাইনটার ব্যাপারে বলছো?’
-হ্যাঁ! যদিও ওই ঘটনার সাথে এই ঘটনার কোনো তুলনাই চলে না। তবু একটা কথা মাথায় গেঁথে নিলে নিজেরদের রাগ কন্ট্রল করা সহজ হয়।’
-যা হবার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। এই কথাটা?
-জ্বি CEO সাহেব। আপনি একটা চেয়েছেন আর আল্লাহ্ চেয়েছেন আরেকটা। আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যেও কোননা কোন হিক্বমাহ আছে।
-সত্যিই তো। ছেলেটা তো তার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছে। আহারে। সারারাত জেগে ডিজাইন করেছিল। আর আমি না বুঝেই রেগে গিয়ে……। আর রাগ একটা চেইনের মত। একজন থেকে আর একজনের কাছে ছড়ায়। আর সূরা আশ-শুরা এর ৩৭ নং আয়াতটার কথা মনে আছে?
-না।
-আচ্ছা পরে দেখে নিও। আয়াতটায় বলা হয়েছে দুনিয়ার সব কিছুই متاع’
– متاع হ্যাঁ। মানে ভোগ্যবস্ত।’
-আর এরপরই আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর কাছে যা আছে সেটা আরো ভালো ও স্থায়ী।
-দাঁড়াও তো। এখুনি অ্যাপ থেকে আয়াতগুলো দেখে নিচ্ছি।
-দেখো, ৩৭ নং আয়াতে বলছে যারা রাগ হলে ক্ষমা করে দেয়। দেখেছো?
-হ্যাঁ।
-খেয়াল করো সবাই বলে রাগ হলে শান্ত থাকবেন এই করবেন সেই করবেন সেটা অবশ্যই কঠিন। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন রাগ হলে যারা ক্ষমা করে?
-এটা তো আরো কঠিন।
-আর এই কঠিন কাজের জন্য আল্লাহ্ বলেছেন এর প্রতিদান আল্লাহই দিবেন। এর সাথে আমার নিজের একটা প্র্যাক্টিস আছে।
-কি প্র্যাক্টিস?
-কারো উপর রাগ হলে বা আরো কোনো কথায়/ কাজে কষ্ট পেলে সাথে সাথেই আল্লাহ্র কাছে নিজের জন্য ও তার জন্য ক্ষমা চাওয়া।
-যার উপর রাগ হলাম বা যার জন্য কষ্ট পেলাম তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু নিজের জন্য কেন ক্ষমা চাইবো?
দেখ, আমরা সবাই তো মানুষ। তো রাগ বা কষ্ট থেকে আমরা নিজেরাও এমন কিছু করে ফেলতে পারি যাতে ওপর পক্ষ কষ্ট পেয়ে বসে। আর এই কষ্টগুলোর সমাধান এই মাটির উপর হয় না। এসবের মূল্য নিজের আমল থেকে দিতে হবে হাশরের মাঠে। তাই…..।
-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। এখন আর কি করবো বল। ক্ষমা করেও কি হবে দীপু তো চলেই গিয়েছে। -আমার মনে হচ্ছে না। ছেলেটার বয়স কম। আবেগ বেশি। রেগেমেগে গিয়ে হয়তো নীচের চা দোকানেই বসে আছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। যেটুকু সময় আছে এর মধ্যে ওর ডিজাইনটাকে মোডিফাই করে ক্লায়েন্টের রিকোয়েরমেন্ট মত করার চেষ্টা করো। হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
-তুমিই তো আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিলে।
-হুহ। আর আপনি যে আমার কত সময় নষ্ট করলেন, সেই বেলায়?
দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো। ফোন রেখে শফিক সাহেব একটু স্থির হলেন। মন থেকে আগে দীপুকে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর নীচে নেমে দেখলেন ঠিকই চা দোকানে বসে আছে ছেলেটা। সাবরিনের কথাই ঠিক। একটু সুন্দর করে কথা বলাতেই ছেলেটা বেশ খুশি হয়ে গেলো। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করলে সত্যিই সব কিছু সহজ হয়। দীপু কাজ শুরু করাতে অফিসের গোমটভাবটাও কেটে গেলো। খুব অল্প সময়েই ছেলেটা ক্লায়েন্টের রিকোয়েরমেন্ট মত একটা ডিজাইন করে দিলো যা ক্লায়েন্টের বেশ পছন্দ হলো। অথচ রাগ আর জেদ নিয়ে বসে থাকলে আজকে কজটা হারাতেই হতো হয়ত।
মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে শফিক সাহেবের। আজকে অফিস থেকে ফেরার সময় সাবরিনের জন্য ফুল নিয়ে যাবেন মনে মনে ভেবে নিলেন। পরক্ষণেই মনে হলো নাহ এই মাঝ বয়সে এসে এসব মানায় না। তার চেয়ে সাবরিন যে কাজগুলো করতে বলেছিলো সেগুলো ঠিক মত করে দিলেই ও বেশি খুশি হবে। বিকেলের কফির মগটা হাতে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিতেই মনটা ছুট দিল স্মৃতির জগতে। একটু পিছে ফিরে তাকালেন শফিক সাহেব।
এই বদমেজাজি ছেলেটার সাথে বিয়ে হয়েছিল সাবরিন নামের মিষ্টি শান্ত একটা মেয়ের। কত চড়াই উতরাইয়ে দিন কেটেছে। কত পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ। সব ঝড়ঝাপটায় এই মানুষটা শক্ত করে ধরে ছিলো শফিক সাহেবের হাতটা। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্ আওড়াতে লাগলেন তিনি। মনটা এক চিলতে প্রশান্তিতে ছেয়ে গিয়েছে। নাহ, এই মাঝ বয়সে এসব না মানালেও আজ সাবরিনের জন্য কিছু অর্কিড নিবেই শফিক সাহেব। দেখা যাক ফুল পেয়ে এই মহিলাটা কেমন অবাক হয়। চোখ বুজে সাবরিনের অবাক হওয়া চেহারাটা কল্পনা করে নিজ মনে হেসে উঠলেন শফিক সাহেব।