এই সেশনে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ছেলেটি। নাম আবির। নাম নিয়ে আবিরের খানিকটা আক্ষেপ আছে। তার বাবা চাইলেই কোনো প্রখ্যাত সাহাবী বা নবীর নামে তার নাম রাখতে পারতো। তবু আবির নিজেকে সান্ত্বনা দেয় তার নামের অর্থ দেখে- ‘লাল রঙ’। লাল রঙটা তার খুবই ভালো লাগে। নামটা ভাল লাগার আরেকটি কারণ হলো, সে নিজের নাম কবি ‘জসীমউদ্দীন’ এর ‘কবর’ কবিতায় দেখতে পায়,
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান!
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ।
যাহোক, ওর নামের গল্প আর নয়, শুনবো ওর চিন্তার পরিবর্তনের গল্প। ওর ভাবনার সাগরে ঢেউ উঠার গল্প –
নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতার মেধাবী ছেলে আবির। এইচএসসি চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। সাবজেক্টও পেয়েছে ভাল- ‘আইন’। সে জানত, তার ঢাকায় থেকে পড়ালেখা চালানোর পুরো খরচ বাবা দিতে পারবে না। বাবার আয় খুবই সীমিত। তার একটা টিউশন দরকার। খুব জরুরী। এজন্য সে সিনিয়র ভাইদের যাকেই পায়, যার সাথেই একটু পরিচিতি আছে, তাকেই বলে- “ভাই! একটা টিউশন ম্যানেজ করে দিন!” সবাই তাকে আশ্বাস দেয়- “পেলে তোমাকে জানাবো।”
এভাবে এক মাস, দুই মাস……ছয়টি মাস চলে গেল। অনেক খোজার পরও সোনার হরিণ টিউশন আর পাওয়া হলো নাহ। তো একদিন এক ক্লোজ বড় ভাইয়ের সাথে তার দেখা। আলাপের এক পর্যায়ে বলে,
-ভাই, একটা টিউশনের খুবই প্রয়োজন। যদি ম্যানেজ করে দিতেন!
-আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আগে বল এস এস সি, এইচ এস সিতে তোর রেজাল্ট কতো?
-আলহামদুলিল্লাহ ভাই। দুটোতেই গোল্ডেন জি পি এ ৫ পেয়েছিলাম।
-তাহলে তো ভালই। আজকেই ফটোকপির দোকান থেকে ‘ক ব্যাংক’ এর স্কলারশিপ ফরম নিয়ে পূরণ করে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছে দিবি। স্কলারশিপ হয়ে গেলে এভাবে টিউশন খোজা লাগবে না!
আবির খুশি মনে ২০ টাকা দিয়ে স্কলারশিপ ফরম কিনে নিল। হলের গণরুমে ট্রাংকের উপর রেখে ফরম পূরণ করবে সে। গণরুমে খাট, চেয়ার টেবিল রাখার জায়গা তো নেই ই, ঘুমানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। ফরম পূরণ করতে গিয়ে ওর কিছু বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়- নাম ঠিকানা দিতে হবে। পিতার ইনকাম কত, পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত, কতজন ইনকাম করে, জমির পরিমাণ কত?… আয় ব্যয় সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য তারা চেয়েছে।
সাথে আরেকটি বিষয়! ফরমের একটু খালি জায়গা আছে। তাতে বলা আছে, “আপনাকে কেন আমরা স্কলারশিপের জন্য বিবেচনা করব, নিজের ভাষায় লিখুন”। আবির ভাবে, এখানে সাধারণ তথ্য উপাত্ত সরাসরি উল্লেখ করলেই চলবে না। তার দুর্দশার কথা উল্লেখ করতে হবে এমনভাবে, যাতে তারা স্কলারশিপ দিতে তাকে এগিয়ে রাখে। এ বিষয়টি আবিরের মনে খুব লাগল। ব্যাংকের স্কলারশিপের জন্য আমাকে এত এত তথ্য দিতে হচ্ছে। আমার নিজের,বাবার, পরিবারের… আবার নিজের ভাষায়ও লিখে দিতে হচ্ছে, কেন আমার স্কলারশিপটি প্রয়োজন। এখানে আমার সকল দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে সামান্য পরিমাণ টাকার জন্য আবেদন করছি দুনিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। কিন্তু আমি কি আমার মনিব মহান আল্লাহর দরবারে কখনো এভাবে জানিয়েছি? তাকে জানিয়েছি, হে করুণাময় মহান মালিক আল্লাহ! তুমি তো আমার সকল দুর্দশার খবর রাখো! আমার সামনে যে প্রতিকুলতা, তা থেকে আমাকে উদ্ধার করো! তুমি যদি উদ্ধার না করো, আমাকে উদ্ধার করার আর কেউ নেই।
তাকে কি বলেছি, হে মালিক! আমার বাবার রোজগারে বরকত ঢেলে দিতে? বলি নি তো!.ভাবতে ভাবতে এশার সালাতের আযান হয়ে গেল। মসজিদে গিয়ে এশার চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নাত সালাত আদায় করে ফিরে এলো গণরুমে। নিয়ত করল, বিতর পড়বে শেষরাতে। সে সময় তাহাজ্জুত পড়ে তার মালিক মহান রবের নিকট কায়মনোবাক্যে তার চাহিদার কথা জানাবে। আবেদন করবে। কেননা সে কোনো একসময় হাদীসে পড়েছিল
মহান আল্লাহ প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন-
“কে এমন আছে, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা প্রদান করব। কে আছে এমন, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে? আমি তাকে ক্ষমা করব”। (i) এ হাদীসের প্রভাব আজকে তার হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছে। সে নিয়ত করে ফেলে, এভাবে প্রতি রাতেই সে তাহাজ্জুত সালাত আদায় করবে। মহান আল্লাহর দরবারে দু’আ করবে। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য। আর সে এটা নিয়মিত করবে বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল।
একদিন খবর আসে, তার বাবার নতুন ব্যবসায় লাভ হচ্ছে। বর্ধিত আয়ে ছোট্ট সংসারটা সাবলম্বী হয়ে উঠছে। যেন আসমান থেকে মহান আল্লাহ পরিবারটির উপর বরকত ঢেলে দিচ্ছেন। আর হ্যা! পার্ট টাইম একটা জবেরও ব্যবস্থা হয়ে গেছে আবিরের। এখন সে মোটামোটি সাবলম্বী। সে অপচয় না করে খাওয়া দাওয়া ও পড়াশুনার খরচ চালায়। বাড়িতে যাবার সময় পরিবারের লোকদের জন্য উপহার কিনে নেয়। আর হ্যা! ক্যাম্পাসের দরিদ্র ভিক্ষুকদের সামর্থ্যানুযায়ী সে দান করে।
এইতো এবার আবিরের ছোট্ট বোনটা! জেএসসি তে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। আবির এতে খুব খুশি। সে কুরিয়ার মারফত কয়েকটা বই পাঠিয়ে দিয়েছে। বইগুলির একটি হলো, ‘মোরা বড় হতে চাই’। এ বইটি পড়েই আবির বড় হবার স্বপ্ন দেখেছিল। তার পড়াশুনা গতি বেড়ে গিয়েছিল। আর পাল্টেছিল জীবনযাত্রার গতি। আর সেটা ইতিবাচক দিকে। ওদিকে এতগুলো বই পেয়ে তার বোন অনেক খুশি। সে তো ভাবে নি, কুরিয়ারে বই পাঠিয়ে ভাই তাকে এত বড় একটা সারপ্রাইজ দিবে!
আবিরের ফোনে রিং বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখল বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করা মাত্রই তার বোনের কণ্ঠস্বর- “আসসালামু আলাইকুম! ভাইয়া! আপনাকে অনেক থ্যাংকস।…….” বাকি কথা গুলো ছোটবোন গুছিয়ে বলতে পারে নি। তার গলায় কথা আটকে আসছিল। হয়ত আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে গেছে.. তবে আবির বুঝেছে, তার বোন আজকে অনেক খুশি। হয়ত কুরিয়ারে পাঠানো বই পৌছে গেছে বোনের কাছে। এমন সারপ্রাইজ গিফট পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে তার আদরের বোন। বোনের এ আনন্দ অনুভব করতে পেরে আবিরের দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। আনন্দের এ সময়েও আবিরের ভাবনার সাগরে ঢেউ উঠলো। সে ভাবল, যে আল্লাহকে খুশি রাখতে পারে, আল্লাহও তাকে খুশি করে দেন। আর তা খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই। আর তার মনে পড়ে গেল মহান আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয়ই কষ্টের পরই রয়েছে স্বস্তি।’ (ii) ‘কঠিন দুরবস্থার পর আল্লাহ সহজতা দান করেন।’ (iii)
(সমাপ্ত)
——–
রেফারেন্স:
(i) বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২৩।
(ii) ৯৪:০৬ (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত নং-০৬)
(iii) ৬৫:০৭ (সূরা তালাক, আয়াত নং- ০৭)