|| এক ||
কুরআন কারিমে মোটামুটিভাবে চার ধরনের ভ্রাতৃত্বের কথা পাই আমরা—
- এক. বংশীয় ভ্রাতৃত্ব।
- দুই. কল্যাণের ভ্রাতৃত্ব। এটাকে ঈমানেরও বলা যায়।
- তিন. অকল্যাণের ভ্রাতৃত্ব।
- চার. স্বাভাবিক পরিচিতির ভ্রাতৃত্ব।
প্রথম প্রকারের ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, “ইউসুফের ‘ভ্রাতা’রা এসে তার কাছে আশ্রয় নিল। সে তাদেরকে চিনলো কিন্তু তারা তাকে চিনল না”। [১] এখানে ইউসুফ আলাহিস সালাম-এর বংশীয় ভাইয়েরা তার কাছে এসেছিলেন। কেননা তারা সবাই ছিলেন একই পিতা অর্থাৎ ইয়াকুব আ.’র ছেলে।
দ্বিতীয় প্রকার ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কুরআন বলছে, “আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ করো- যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ‘ভাই-ভাই’ হয়েছ।”[২] এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ঈমানের ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে শত্রুতা পেছনে ফেলে সকলে এক কাতারে আসার কথা বলছেন।
তৃতীয় প্রকার সম্পর্কে কুরআন বলছে, “নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ‘ভাই’। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।”[৩] এ ভ্রাতৃত্ব অকল্যাণের। পাপের। যেনো অপচয় করে একজন মানুষ অভিশপ্ত শয়তানের ভ্রাতৃত্ব গ্রহণ করল।
আর চতুর্থ প্রকার সম্পর্কে এসেছে, “আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ‘ভাই’ হুদকে। সে বললো– হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর।”[৪] এভাবে আরও কজন নবী সম্পর্কে কুরআনে বর্ণনা এসেছে। তারা ওই সম্প্রদায়ের পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন বলে ভাই হিসেবে সম্বন্ধ করা হয়েছে। (এখানে অন্য ব্যাখ্যাও থাকতে পারে৷ আল্লাহ আ’লাম।) আচ্ছা এ ভ্রাতৃত্বগুলোর মাঝে কোন ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি মজবুত? সবচেয়ে টেকসই?।
|| দুই ||
মুস’আব ইবনু উমাইর তখন ইসলাম গ্রহণ করে মুহাজির বেশে মদিনায়। তার পরিবারপরিজন, ভাইবেরাদর তখনও অমুসলিম, ছিলেন মক্কায়। দ্বিতীয় হিজরির রামাযান মাস, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের উদ্দেশ্যে বের হলে মুস’আবও কাফেলায় শরিক হলেন। অন্যদিকে তার ভাই যুরারাহ ইবনু উমাইর* মক্কা থেকে কাফেরবাহিনীর পক্ষে বদরে আসলেন।
যুদ্ধ শুরু হল। গুমসান যুদ্ধ। একপর্যায়ে সাহাবি আবুল ইয়াসার রাযি. যুরারাহ-কে পাকড়াও করে ফেললেন। বন্দী করে ফেলছেন—এই অবস্থা। দূর থেকে মুস’আব যখন এই দৃশ্য দেখলেন, চিৎকার করে বললেন– “হে আবুল ইয়াসার! তোমার বন্দীকে শক্ত করে বাঁধো। এর মা অত্যন্ত ধনী। প্রচুর পরিমাণ মুক্তিপণের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করবে”। একথা শুনে মুস’আব ইবনু উমাইর-এর দিকে তাকিয়ে যুরারাহ বললেন– হে মুস’আব! ভাইয়ের সাথে তোমার এই আচরণ? প্রতি উত্তরে মুস’আব ইবনু উমাইর বললেন– “তুমি আমার ভাই নও। (আবুল ইয়াসার রাযি. -কে দেখিয়ে বললেন) সে হলো আমার ভাই।”[৫] [৬] আল্লাহু আকবার।
আসলে ঈমান এমন এক মন্ত্র- যেখানে বাকি দুনিয়ার সবকিছু নস্যি। ঈমানের সম্পর্কের সামনে পৃথিবীর তাবৎ সম্পর্ক পরাজিত। এগুলো দেখে আমি আশ্চর্য হই না। কারণ কুরআন তো ঘোষণা দিয়েছে, “মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই।”[৭] এ কারণে বংশীয় ভ্রাতৃত্বকে পদদলিত করে ঈমানের সম্পর্ককে প্রায়োরিটি দেওয়ার আরও কঠিন গল্পের সন্ধান পাই ইতিহাসে।
|| তিন ||
বদর যুদ্ধে বন্দী হওয়া কাফিরদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পরামর্শ ডাকেন নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। সবাই যার যার মতামত ব্যক্ত করেন। উমার রাযি.-এর পালা আসলে তিনি বলেন– “আমার মত হচ্ছে, আপনি আমাকে অমুক (তার নিকটাত্মীয়)-এর ব্যাপারে সুযোগ দেবেন, তরবারি দিয়ে আমি তার ফায়সালা করে নেব। আলি-কে আকিল (তার আপন ভাই) -এর ব্যাপারে সুযোগ দেবেন, সে তার গর্দান দ্বিখণ্ডিত করবে। হামযা-কে তার ভাইয়ের ব্যাপারে সুযোগ দেবেন, তিনি তার জীবনের শেষ দেখে নেবেন। যাতে আল্লাহপাকের কাছে প্রমাণ হয়, কাফিরদের ব্যাপারটা ন্যূনতম করুণাও আমাদের অন্তরে নেই।”[৮]
চিন্তা করুন কী ইস্পাত কঠিন ঈমান! আত্মীয়তার বন্ধনকে রক্তস্নাত করে দেওয়ার পরওয়া নেই যার সামনে। কোমল হৃদয়ের জন্য আবু বাকর রাযি. কে সবাই একবাক্যে চিনি। বদর যুদ্ধের সময় তার ছেলে আবদুর রাহমান কাফির বাহিনীতে ছিলেন। পরবর্তীতে আবদুর রাহমান মুসলমান হলে আবু বাকর রাযি.-এর সঙ্গে তার কথোপকথনের একটা চিত্র দেখা যাক।
আবদুর রাহমান রাযি. পিতাকে লক্ষ্য করে বলছেন– “বদরের দিন আপনি আমার ভাগে এসেছিলেন। আমি আপনাকে দেখে কেটে পড়ি, হত্যা করিনি।” জবাবে আবু বাকর রাযি. পুত্রকে বললেন– “বৎস! কিন্তু তুমি যদি কোনো সুযোগে আমার সামনে আসতে, তাহলে কোনো ধরনের ছাড় দিতাম না!” [৯] ঈমান, এই হলো ঈমান। যার জন্য ঔরসের পুত্রকেও সিকিপরিমাণ ছাড় নেই।
|| চার ||
দুনিয়াজুড়ে আজ মুসলিম অধঃপতনের কতো কারণ খুঁজি আমরা। দীন থেকে সরে যাওয়া এবং দীনের সম্পর্ককে ভুলে যাওয়াই সমূহ কারণের মূল। বদর যুদ্ধের দিকে লক্ষ্য করুন, প্রতিপক্ষের চেয়ে দুইগুণ কম সৈন্য এবং কয়েকগুণ কম যুদ্ধসরঞ্জাম নিয়েও বিজয় ছিনিয়ে আনা—কীসের বলে সম্ভব হয়েছিল? –প্রাণদীপ্ত ঈমান ছাড়া এ অর্জন আদৌ অসম্ভব।
মুসলমান কোনো জীবনেই ‘কেবল’ বাহ্যিক সাজসরঞ্জাম দিয়ে বিজয়ী হয়নি। অস্ত্রশস্ত্র, শিল্পকলা এসব অবলম্বনের পরও মুসলমান যে শক্তি দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো—তার নাম ঈমান। তা’আল্লুক মা’আল্লাহ। আজও মুমিন সাহাবির ঈমান ফিরে পাক, ভ্রাতৃত্বের সাম্প্রদায়িক বলয় ভেঙে ঈমানের সংজ্ঞায় ফিরে যাক—বিজয় তার পদচুম্বন করবেই। ইনশাআল্লাহ!
বিজ্ঞান, আবিষ্কার, শিল্পকলায় পিছিয়ে থাকাকেই যারা আজ মুসলমানের অধঃপতনের একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি, তাদের জন্য ভ্রাতৃত্বের এ গল্পগুলো একেকটা উপমা। আমি কিংবা আপনি সাহাবিদের এ অবস্থানে থাকলে এই অ্যাকশন নিতে পারতাম? উত্তর শতভাগ পজিটিভ হলে আমাদের বস্তুবাদী অর্জন কাজ দেবে। নতুবা সায়েন্স, ইকোনমি, নিত্যনতুন আবিষ্কারের পসরা থাকার পরও যেভাবে স্পেন, অস্ট্রিয়া, জর্জিয়া, তাতারিস্তান, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা হারিয়ে গেছে—হারিয়ে যাওয়ার সময়টা দীর্ঘ হতে আছে, আরও দীর্ঘ হবে। চিন্তায় মাথার চুল পড়লেও হিসাব মিলবে না। আল ই’য়াযু বিল্লাহ!
দেখবেন, আমি আবার বলছি না আমাদের আবিষ্কার কিংবা বিজ্ঞান সত্তাকে বন্ধ্যা করে দিতে। বিজ্ঞানের চর্চা অবশ্যই দরকার। তবে তারচেয়ে বেশি দরকার— দীনদারি। দীনের জন্য ভালোবাসা। ইসলামের জন্য নিবেদন। মুসলমানের জন্য আবেদন। এই জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে গেলে উম্মাহর পতন ঠেকানো কিম্বা বিজয় অসম্ভব। উম্মাহ তার সোনালি যুগে ফিরে পাক!
রেফারেন্স:
১. সূরা ইউসুফ: ৫৮
২. সূরা আলে ইমরান: ১০৩
৩. সূরা বানি ইসরাঈল: ২৭
৪. সূরা আল আ’রাফ: ৬৫
৫. আর্ রাহিকুল মাখতুম, শফিউররাহমান মুবারকপুরি: ২০৩
৬. খাওয়াতিরি, মুতাওয়াল্লি আশ্ শা’রাওয়ি: ২/৭৪৮
৭. সূরা আল হুজুরাত: ১০
৮. আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইমাদুদ্দিন ইবনু কাসির: ৫/১৬২
৯. তারিখুল খুলাফা, জালালুদ্দিন সুয়ুতি: ৩৩
* তার উপনাম আবু আযিয। তিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করে নবীজির সাহচর্য লাভ করেছেন। রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু!