মক্কার মুশরিকদের হাতে ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলিমদের অবস্থা খড়কুটোর মতো। তাঁদের হাতে না আছে ক্ষমতা, না আছে অর্থ। তবুও কাফিররা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আসলো। সমঝোতা হয় তো সাধারণত সমানে-সমানে। অসমের মধ্যে সমঝোতা প্রস্তাব কেনো?
কারণ, মুশরিকরা দেখলো কোনোভাবেই ইসলামকে ঠেকনো যাচ্ছে না। বনের মধ্যে শুকনো পাতায় আগুন ধরলে যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তারা দেখলো ইসলামও তেমনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যতোই তারা চেষ্টা করছে ইসলামকে দমিয়ে রাখতে, ইসলাম ততো স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকটা নিরুপায় হয়ে তারা এবার কম্প্রোমাইজ করতে রাজী। কী কম্প্রোমাইজ? তারা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাব দিলো- “আপনি একবছর মূর্তিপূজা করুন, আমরাও এক বছর আল্লাহর ইবাদাত করবো।” অর্থাৎ, Give & Take. একটা উদারনীতিক প্রস্তাব।
ইসলাম এসেছে সকল উপাস্যকে অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহর উপাস্য করার জন্য, আল্লাহ ব্যতীত সকল প্রভুকে অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহকে প্রভু বলে স্বীকার করার জন্য। সেই ধর্মের নবী কিভাবে একবছর মূর্তিপূজা করবেন, পরের বছর আল্লাহর ইবাদাত করবেন? সেই ধর্মের নবী কিভাবে কুফরের সাথে উদারতা দেখাবেন?
আল্লাহ ‘সূরা কাফিরূন’ নাযিল করে কাফিরদের এমন উদারনীতিক, হাস্যকর প্রস্তাবকে চিরকালের জন্য শিকড় থেকে কেটে দিলেন। সাইকেলের দুই চাকা আর কারের দুই চাকা দিয়ে যেমন চার চাকার কার চালানো যায় না, তেমনি ঈমান আর কুফর জোড়াতালি দিয়ে কখনো চলতে পারে না। ঈমান আর কুফরের মধ্যে কখনো উদারনীতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। ঈমানের রাস্তা আলাদা, কুফরের রাস্তা আলাদা।
আল্লাহ এই সূরায় প্রথমেই ‘কূল’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। যার অর্থ- (হে নবী! আপনি) বলে দিন! অর্থাৎ, যা বলা হচ্ছে তা নবীর মনগড়া কথা না, এটা আল্লাহর কথা। মক্কার মুশরিকরা এসেছে কম্প্রোমাইজ করতে। তারা একবছরের জন্য আল্লাহকে মেনে নিতে রাজী। একবছরের জন্য ‘মুমিন-বিশ্বাসী’ হয়ে যেতে তাদের কোনো আপত্তি নাই। তবুও, আল্লাহ তাদেরকে সম্বোধন করতে গিয়ে ‘মুশরিক- শিরককারী’ বা ‘সমঝোতাকারী’ না বলে ‘কাফির- অস্বীকারকারী’ বলছেন। জোড়াতালিমার্কা বিশ্বাসকে আল্লাহ স্বীকৃতি না দিয়ে সেটাকেও অবিশ্বাস, অস্বীকার বলছেন।
আল্লাহকে অস্বীকার করা, অবিশ্বাস করা একটা ক্রাইম। যারা অস্বীকার করে তারা ক্রিমিনাল। যারা সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো তাদেরকে প্রস্তাবকারী, নেতৃবৃন্দ এমন শব্দে সম্বোধন না করে আল্লাহ সরাসরি তাদের পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সম্বোধনেই।
‘কাফিরূন’ শব্দটি Noun অর্থাৎ, তারা পূর্বেও কুফরী করছে, এখনো করছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে। যতোক্ষণ না তারা ইসলামের বাউন্ডারিতে ঢুকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা কাফির। হোক সে ভালো মানুষ কিংবা খারাপ মানুষ। ‘কাফিরূন’ শব্দটি ভালো মানুষ বা খারাপ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এটা ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত।
পরের আয়াতে আল্লাহ নবীকে বলতে বললেন- “আমি তার ইবাদাত করি না, যার ইবাদাত তোমরা করো”। এই আয়াতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখের উপর কাফিরদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন কাফিরদেরকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আমার প্রভু আর তোমাদের প্রভু এক না।
আমি আল্লাহর ইবাদত করি, আর তোমরা করো মূর্তিপূজা। মক্কার কাফিররা আল্লাহকে জানতো, কিন্তু আল্লাহকে যেভাবে মানা দরকার সেভাবে মানতো না। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্লিয়ার করে নিচ্ছেন- আমি তার ইবাদাত করি না, যার ইবাদাত তোমরা করো। পরের আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে দিচ্ছেন- “এবং তোমরাও তার ইবাদাতকারী নও, যার ইবাদাত আমি করি”. ‘আল্লাহর ইবাদাত’ বলতে কী বুঝায়? ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর ইবাদাত বলতে পাঁচটি শর্তের কথা বলেন।
শর্তগুলো হলো:
১। আল্লাহর আনুগত্য করা। আল্লাহ যা করতে বলছেন তা করা, আল্লাহ যা বারণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা।
২। আল্লাহকে সবকিছুর চেয়ে ভালোবাসা। আর আল্লাহকে ভালোবাসার অর্থ রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য করা।
৩। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা। অর্থাৎ, ভয়, আশা সবকিছুর হকদার আল্লাহ।
৪। আল্লাহর ইবাদাতে একনিষ্ঠ (Sincere) হওয়া।
৫। আল্লাহর ইবাদাত করা মানে আল্লাহর দাস হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, যখন মন চাইলো একটা বিধান মানলাম, যখন মন চাইলো মানলাম না, এমন হতে পারে না।
এই দুই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমঝোতার শুধু বর্তমান প্রস্তাবকেই প্রত্যাখ্যান করছেন না, বরং ভবিষ্যতের এমন প্রস্তাবের সম্ভাবনাও নাকচ করে দিচ্ছেন। কাফিরদের সাথে রাজনৈতিক চুক্তি হতে পারে, যেমনটা পরবর্তীতে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হয়েছে, কিন্তু কুফরের সাথে কোনো সন্ধি হতে পারে না।
পরের আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন- “এবং আমি তার ইবাদাতকারী নই, যার ইবাদাত তোমরা করে আসছো। এবং তোমরাও তার ইবাদাতকারী নও, যার ইবাদাত আমি করি।”
প্রথম দুই আয়াতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, পরের দুই আয়াতে অতীতের কথা উল্লেখ করে কাফিরদের দুটো প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করা হলো। এটার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন- ইবাদাতের ক্ষেত্রে আমরা আগেও কখনো ‘এক’ ছিলাম না, ভবিষ্যতেও এক হতে পারবো না। আমরা যখন কাউকে ঘৃণা করার কথা বলি তখন সাধারণ দুইবার বলি- I Hate You, I Hate You! এখানেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে দুইবার বলে দিচ্ছেন- সমঝোতা সম্ভব না এবং কোনোভাবেই সম্ভব না।
শেষের আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন- “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন।” অর্থাৎ, কুফর আর ঈমানকে জোড়াতালি লাগানোর যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছো, সেই প্রস্তাব কখনো বাস্তবায়ন হতে পারে না। তোমাদের কুফরের সাথে আমাদের ঈমানের সেতুবন্ধন হতে পারবে না। আজও না, কখনোও না।
কিন্তু, এই আয়াতকে অনেক মুসলিম, সেক্যুলার মনে করে ইসলামের উদারনীতির বার্তা। এটা উদারনীতি নয়, এটা হলো দায়মুক্তি। আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র কাফিরদের আমল থেকে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দায়মুক্তির ঘোষণা দিয়ে বলেন- “আর তারা যদি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে তুমি বলো, আমার কর্ম আমার, আর তোমাদের কর্ম তোমাদের। আমি যা আমল করি তোমরা তা থেকে মুক্ত এবং তোমরা যা আমল করো আমি তা থেকে মুক্ত।” [সূরা ইউনুসঃ ১০:৪১]
একই কথা আল্লাহ আরো বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। যেমন- “তারপরও যদি তোমরা অবাধ্য হও, তাহলে বলো, তোমরা যা করো, নিশ্চয়ই আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।” [সূরা আশ-শুয়ারাঃ ২৬:২১৬
তারমানে ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন’ কথাটি বলার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একথা বুঝাচ্ছেন না যে, তোমরা যা ইচ্ছা করো, আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। যদি এমন হতো তাহলে তো তিনি আর ইসলামের দাওয়াত দিতেন না, বদর-ওহুদ যুদ্ধে কাফিরদের পদানত করতেন না, মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘর থেকে ৩৬০ টি মূর্তি অপসারণ করতেন না।
এই আয়াত দ্বারা ধর্মীয় সহাবস্থান বুঝায় না, এই আয়াত দ্বারা সেকুলারিজমও বুঝায় না। এই আয়াত দ্বারা এটাও বুঝায় না আরেকটা ধর্মের কুফরের সাথে ছাড় দিয়ে থাকার কথা (অন্য ধর্মের লোকদের সাথে ব্যক্তিগত জীবনে ছাড় দেবার কথা ভিন্ন, কিন্তু ধর্মীয় ছাড় দেবার বেলায় কোনো সুযোগ নাই)।
মনে করুন, একজন হিন্দুর দোকানে কিছু কিনতে গেলেন। ‘সে হিন্দু’ এই কারণে আপনি তাকে ঠকাতে পারবেন না। পণ্যের যা ন্যায্য দাম, তাই দিতে হবে। কিন্তু, তার সাথে ধর্মীয় ছাড় দিতে গিয়ে তার পুজো অনুষ্ঠানে গিয়ে পুজো করতে পারবেন না।
ইসলাম অন্য ধর্মের সাথে ছাড় দিয়ে থাকতে আসেনি। ইসলাম গা বাঁচিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আসেনি। ইসলাম এসেছে বিজয়ী হতে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন সকল দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য; যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” [সূরা আত-তাওবাঃ ৯:৩৩, সূরা আস-সফঃ ৬১:৯]
মুশরিকরা পছন্দ করুক আর নাই করুক, আল্লাহ এই দ্বীনকে প্রেরণ করেছেন সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী হতে। সকল দ্বীনের সাথে সমঝোতা করে চলতে নয়। ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়াদীন’ –এ দ্বীনের ব্যাপারে সকল সমঝোতা প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে।
এই আয়াত নাযিলের পরও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফিরদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছেন, সাহাবীরা করেছেন। কিন্তু, দ্বীনের ব্যাপারে সমঝোতা করা হয়নি। কাফিরদের উৎসবের দিন মুসলিমরা তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে যাবে, আর মুসলিমদের উৎসবের দিন মুসলিমদের শুভেচ্ছা জানাতে কাফিররা আসবে? এমন উদারতার প্রস্তাব সেই চৌদ্দশো বছর আগেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এই আয়াতে কাফিরদের কুফরের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উদারনীতি নয় বরং দায়মুক্তির ঘোষণা দেন।