মুহাম্মদ কুতুব। মিশরের একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ। ইসলামি চিন্তাধারা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা-পত্র রয়েছে তাঁর। ভাই সাইয়েদ কুতুবের সাথেই একটা অভিজ্ঞতাপূর্ণ সময় পার করেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় শত বাধা-প্রতিবন্ধকতা সত্বেও তাদের শক্ত যুক্তি এবং স্পষ্ট দর্শন ও পর্যবেক্ষণ সর্বদাই অনড় ও অবিচল ছিল।
জন্মকাল:
মিশরের আসয়ুতের মুশা নামক গ্রামে ২৬ এপ্রিল ১৯১৯ সালে মুহাম্মদ কুতুব জন্মগ্রহণ করেন। যে বছরের গণজাগরণ ইংরেজ দখলদারকে মিশরের মাটি ছাড়তে বাধ্য করেছে। শুধু মিশর না, এই গণজাগরণের ফলে আরব জাহান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে হয়েছিল তারা। তাই বলা যায়, মুহাম্মদ কুতুবের দুনিয়ায় আগমন এবং তাঁর শৈশব-কৈশোর পার হয়েছে আরব গণজাগরণের কালে। আরবভূখণ্ডে ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষ যুগ ছিল এটা।
ভাইয়ের ছায়ায়:
পিতার মৃত্যুর পর মা সিদ্ধান্ত নেন পড়াশোনার জন্য সন্তানদের কায়রো পাঠাবেন। বড় ভাই সাইয়েদ কুতুব এবং বোন আমিনা ও হামিদার সাথে মুহাম্মদ কুতুবও রাজধানী কায়রো পাড়ি জমান। নিম্নমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কায়রো ভার্সিটিতে ভর্তি হন। এখানেই ইংলিশ ভাষা-সাহিত্যের উপর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে এডুকেশন ইনিস্টিটিউট থেকে শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের উপর ডিপ্লোমা করেন। এরপর চারবছর শিক্ষকতা করেন। এক সময় শিক্ষকতা ছেড়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ট্রান্সলেশন অফিসে কাজ শুরু করেন। পরে দুই বছরের জন্য শিক্ষকতায় ফিরলেও আবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ‘আলফ কিতাব’ নামক প্রজেক্টে অংশ নেন।
তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে অবদান রয়েছে তিন মহাপুরুষের। সাইয়েদ কুতুব, সাহিত্যিক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ এবং তাঁর মামা আহমাদ হুসাইন আল মুশী। আহমাদ হুসাইন ছিলেন সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। যার সাহিত্যিক প্রতিভা এবং কাব্যচর্চা বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। তবে সবার থেকে আলাদা করে ভাইয়ের প্রশংসা করেছেন তিনি। স্বীকার করেছেন যে, তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ও ব্যক্তিসত্তা উন্নায়নে সাইয়েদ কুতুবের দিক-নির্দেশনা মূল ভূমিকা পালন করেছে।
সাইয়েদ কুতুবের সাথে তাঁর সম্পর্ক বয়ান দিতে গিয়ে তিনি বলেন- ‘শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আমার সাথে সাইয়েদের সম্পর্ক ছিল কখনো নমনীয়, আবার কখনো কঠিন। এতোটা নরম হতেন না, যাতে আমি বিগড়ে যাই। আবার এতটা কঠোর হতেন না, যাতে আমি তাঁর কাছে না ভিড়ি। তিনি নিজে তো বইপোকা ছিলেনই, অন্যদিকে সবসময় আমাকেও বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর এই উদ্বুদ্ধকরণ শৈশব থেকেই পাঠের প্রতি আমার ভিন্ন ভালোবাসা যুগিয়েছে।’
নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ব্যাপারে মুহাম্মদ কুতুব বলেন, ‘বুঝমান হওয়ার পর থেকে সাইয়েদ কুতুবের সকল দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাভাবনার সেই বিশাল রাজ্যে অন্তরঙ্গভাবে বাস করেছি। আর যখন উচ্চমাধ্যমিক পার করি, তখন তিনি নিজ থেকেই তাঁর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমার সাথে শেয়ার করতেন। সেসব বিষয়ে আমাকেও আলোচনা করার সুযোগ করে দিতেন’।
জেলজীবন:
১৯৪৮ সালের ৮ই ডিসেম্বরে মিশরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী ‘সশস্ত্র গোপণ সংস্থা’ ও আরও বিভিন্ন হামলার তোহমতে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞ্য জারি করেন। সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে আটকের হুকুম দেন।
তখন ধরপাকড় হলেও খুব একটা জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। একই মাসের ২৮ তারিখ মাহমুদ ফাহমীকে হত্যা করা হয়। যার পুরাপুরি দায়ভার মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর অর্পিত হয়। মাহমুদ ফাহমীর হত্যার পর ধরপাকড় খুব আকারে বেড়ে যায়। দুই মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৯ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্নাকে হত্যা করা হয়। সাইয়েদ কুতুব এর কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরত আসেন।
১৯৫২ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের পর মিশরের রাজতন্ত্র মিটিয়ে দেয় বিদ্রোহী সেনারা। এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, সেনা কর্মকর্তা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মাঝে বেশ সম্পর্ক ছিল। এর পিছনে কারণও আছে। ১৯৪৮ সালে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে ব্রাদারহুডের যুবকরাও সেই যুদ্ধে শামিল হয়। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জামাল আব্দুন নাসেরও ব্রাদারহুডের উক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু বায়ান্নর পরে সেনাদের অবস্থান একদম পাল্টে যায়। ১৯৫৪ সালে জামাল আব্দুন নাসেরকে হত্যার চেষ্টা করা হলে সেই দোষও গিয়ে চাপে মুসলিম ব্রাদার হুডের উপর।
এ সময় হত্যা চেষ্টার অভিযোগে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর ভাই মুহাম্মদ কুতুবকেও আটক করা হয়। দুই ভাইকে সামরিক ভিন্ন দুই কারাগারে বন্দী করা হয়। এতটা দূরত্ব ছিল তাঁদের মাঝে, কেউ কারও অবস্থান সম্পর্কে জানতেন না। অল্প কিছুদিন পরমুহাম্মদ কুতুবকে মুক্তি দেওয়া হয়। অন্যদিকে সাইয়েদ কুতুবকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করা হয়। আর এই সময়েই সাইয়েদ কুতুব তাঁর প্রসিদ্ধ বই في ظلال القرآن লেখেন। মুহাম্মদ কুতুব তাঁর কারামুক্তি নিয়ে বলেন, ‘আমাকে জেল মুক্তি দেওয়া হয়েছে পরিবারের বোঝা বহনের জন্য। যেই পরিবারের পুরো দায়িত্বভার ছিল ভাইয়ের উপর। যেমনটি আমরা দেখে এসেছি আগে থেকে। সেই পরিবারের বোঝা নিয়ে দশ বছরের বাস্তব জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমি নিবিষ্ট হয়েছি।’
১৯৬৪ সালে মে মাসে সাইয়েদ কুতুবকে শারীরিক অবক্ষয়ের কারণে মুক্তি দেওয়া হয়। মুহাম্মদ কুতুব ভাইয়ের মুক্তির কথা ব্যক্ত করেন, ‘তাঁর মুক্তিকে আমরা অনেকটা উদ্বেগের সাথে গ্রহণ করেছি। গভীরভাবে আনুভব করছিলাম, ওরা তাঁকে এত সহজে ছেড়ে দিবে না। এরচেয়ে বড়ো কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদ আটছে কারাগারে। যা ভেবেছিলাম , তাই হয়েছিল’। সাইয়েদ কুতুব কারাগার থেকে বের হতে না হতেই রাজ্যে আবার উত্তেজনা বেড়ে যায়। জামাল আব্দুন নাসেরও ধরপাকড় শুরু করে। এবারো তাঁদের দুই ভাইকে কারাবন্দী করা হয়। কিন্ত এবার কিছুটা উল্টো হল। মুহাম্মদ কুতুব ছয় বছরের দীর্ঘ কারাজীবন পার করলেন। এই ফাঁকে সাইয়েদ কুতুবসহ আরো ছয়জনকে ফাঁসি দেওয়া হল। তাঁর বড় বোনের ছেলেকে গোপনে হত্যা করা হয়। তিন বোনকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
হিজরত:
সত্তর দশকের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ কুতুব সৌদি হিজরত করেন। মক্কার উম্মুল কুরা ভার্সিটিতে শরীয়াহ ফ্যাকালটির লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে পরে জেদ্দার কিং আব্দুল আজীজে নিযুক্ত হন। মুহাম্মাদ কুতুবের তত্বাবধানে বেশ কিছু থিসিস পেপার প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসিদ্ধ থিসিস পেপারের মধ্যে ছিল ‘العلمانية نشأتها وتطورها وآثارها في الحياة الإسلامية المعاصرة’ গবেষণা পত্রটি লিখেছেন ড. সাফর আল হাওয়ালী। তা ছাড়া সৌদির বিভিন্ন স্তরের সিলেবাস প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। ১৯৮৮ শালে তিনি ইসলামি স্টাডিজের জন্য আন্তর্জাতিক কিং ফয়সাল পুরুষ্কার অর্জন করেছেন।
মৃত্যু: ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল জুমার দিন জেদ্দায় মুহাম্মদ কুতুব মৃত্যুবরণ করেন। রহিমাহুল্লাহ।