পীর-মুরিদি নিয়ে আজকে লিখব, ইনশাআল্লাহ। তাঁর আগে ছোট্ট একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে নেই। লেখা বড় হলে অনেকেই পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাই বেশী কথা বলব না। আমি মরহুম আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারকে ইন্টারভিউ করার সময় পীর-মুরিদি বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম যদিও তা আমার গবেষণা প্রশ্নের বিষয় ছিল না। তদুপরি তিনিই প্রসঙ্গক্রমে এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছিলেন। এর বাইরে এই নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু কথাও বলেছিলেন যা আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে এড়িয়ে যাব। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমিও তাঁর সহকর্মী হওয়ায় বোধ হয় মনে খুলে তিনি কথাগুলি বলেছিলেন। তাঁর যতটুকুন বক্তব্য বিষয়টি ব্যাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেবল ততটুকুন উল্লেখ করব।
আমার পর্যবেক্ষণ হল, পীর-মুরিদি নিয়ে আমাদের সমাজে দুই ধরণের চরমপন্থা আছে। একদল আছেন যারা মনে করেন পীর ছাড়া স্যাল্ভেশন বা মুক্তির কোন উপায় নেই। কেউ কেউ এমনও বলেন, যাঁদের পীর নেই, তাঁদের পীর শয়তান। মোদ্দা কথা হল, এই শ্রেণীর ধারণায়, পীরের অনুসরণ করা ছাড়া ইসলামী জীবন-যাপন করা অসম্ভব। আরেক শ্রেণী আছেন এমন যে, পীর বা এই জাতীয় শব্দ শুনলেই তাঁরা নাক ছিটকান। পীরের প্রসঙ্গ আসলেই তাঁরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। এমনকি পীর শব্দটি তাঁদের কাছে বেশ যন্ত্রণাদায়ক। পীর বলতেই তাঁরা বুঝেন ভন্ডামী, ব্যবসা, ধোঁকাবাজি। এই দুই শ্রেণীই আমি মনে করি প্রবলেমেটিক। দু’টিই এক্সট্রিমিস্ট এবং মার্জিনাল কনসেপচুয়ালাইজেশন। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, এই উভয় গ্রুপই ভুলের মধ্যে আছে।
মরহুম আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার বলেন, “পীর মানে কি, আগে এটা বুঝতে হবে। পীর ফার্সি শব্দ। পীর মানে ওস্তাদ, পীর মানে শিক্ষক। আর মুরিদ মানে ছাত্র। কোন পীর যখন এই ওস্তাদ বা শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন এবং মুরিদ তাঁর ছাত্রের ভূমিকায় থাকে, তখন এই পীর-মুরিদিতে কোন সমস্যা নেই।” স্যারের এই বক্তব্যের একটু ব্যাখ্যা দরকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন, এই দেশে ইসলাম কিভাবে এসেছে। এ নিয়ে অনেক বইপত্র কিংবা গবেষণা আছে। মোদ্দা কথা হল, এ নিয়ে চারটি মেজর থিওরি আছে, যার তিনটি এখানকার রিলিজিয়াস করভার্সনের ব্যাখ্যা দেয়:
১। সোর্ড বা ফোর্স থিওরি: মূল কথা হল, তলোয়ারের মাধ্যমে বা ফোর্স এপ্লাই করে ধর্মান্তর করা হয়েছে;
২। সোশ্যাল লিবারেশন থিওরি বা সামাজিক মুক্তি তত্ত্ব: মূল কথা হল, তৎকালীন হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজে সামাজিক অসমতা, অবিচার, বৈষম্য প্রভৃতি কারণে বিশেষ করে লোয়ার কাস্ট হিন্দু এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ইসলামের এগালিটেরিয়ানিজমে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়;
৩। প্যাট্রনাইজেশন থিওরি বা পৃষ্ঠপোষকতা তত্ত্ব: মূল কথা হল, মুসলিম শাসকরা গরীব নন-মুসলিম প্রজাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে ইসলামে ধর্মান্তরের জন্য আকৃষ্ট করেছে। এর আরেকটি দিক হল, এই শাসকরা ইসলাম প্রচারকারী আলিম, উলামা, সুফি, দরবেশদেরকেও ইসলাম প্রচারের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করেছে; এবং
৪। ইমিগ্রেশন থিওরি বা অভিবাসন তত্ত্ব: এটি ধর্মান্তরের তত্ত্ব নয়, তবে এর মূল কথা হল, এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন স্থাপিত হলে নানা জায়গা থেকে মুসলিমরা এখানে আসে এবং বসতি স্থাপন করে। এই ইমিগ্রান্ট মুসলিমরা এখানকার মুসলিম সমাজ গঠন ও বিকাশে অবদান রাখে। এগুলি সবই একাডেমিক আলোচনা। ক্রিটিক্যাল আলোচনা যা এখানে আলোকপাত করা সম্ভব নয়।
আমাদের (Md Nazrul Islam & Md Saidul Islam) লিখিত বই “Islam and Democracy in South Asia: The Case of Bangladesh” (Palgrave Macmillan, 2020) এর একটা অধ্যায় এই নিয়ে বিস্তারিত ক্রিটিক্যাল আলোচনা আছে (কেবল ইনফরমেশনের স্বার্থে বলা)। যারা বিস্তারিতভাবে পড়তে আগ্রহী, এই অধ্যায়টি দেখে নিতে পারেন। কথা হল, বাংলাদেশে (এক সময়ের বেঙ্গল বা ইস্ট বেঙ্গল) ইসলাম প্রচারে কারা ভূমিকা রেখেছেন?
এখানে এই প্রসঙ্গে বলা বাঞ্চনীয় যে, মূলত তিনটি শ্রেণী বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে ও প্রসারে অবদান রেখেছেন:
১। আরব বণিক বা ব্যবসায়ী;
২। সুফি বা সেইন্ট এরাই মূলত পীর; এবং
৩। মুসলিম শাসকরা, যারা উপরিউক্ত দুই শ্রেণীকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছেন, ধর্মীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নির্মান করেছেন।
মোট কথা, বাংলাদেশে ইসলামের আগমন এবং প্রচার-প্রসারে এই সুফি, দরবেশদের অবদান অতুলনীয়। লেখার কলেবর বড় হওয়ার আশংকায় খুব বেশী বলা যাচ্ছে না। কেবল এতটুকুন বলি, এই সুফিদেরকে আপনি সুফি বলুন, বা আলিম, উলামা, দরবেশ কিংবা পীর বলুন তাঁরাই ছিলেন এখানকার ইসলাম প্রচারের নিউক্লিয়াস। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে তাঁদের কবর বলুন বা মাজার বলুন তা রয়েছে। তাঁদের হাত ধরেই ইসলাম এসেছে, এ কথা ঐতিহাসিক সত্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচলন ও প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ফার্সি শব্দসমূহ আত্তীকৃত হয়ে যায়। তাই আজও আমাদের ভাষা, সাহিত্য, অফিস, আদালতে ফার্সি শব্দের এত প্রবল উপস্থিতি। পীর শব্দটিও এই সময়ে এখানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।
আজ থেকে এক হাজার বছর আগের কথা কল্পনা করুন। ৭০০/৮০০ বছর আগের কথা ভাবুন। শিক্ষার অবস্থার কথা ভাবুন। সাধারণ মানুষের পক্ষে ইসলাম বুঝা এবং পালন করা কিভাবে সম্ভব হত এই সকল সুফি ওস্তাদ (যাঁদেরকে বলুন পীর) ছাড়া। ইসলামের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজসভ্যতার কথা বাদ দেন। মৌলিক যে বিষয়গুলি, যেমন কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত, তা মানুষ কিভাবে জানল?
এই পীরদের (শিক্ষক) কাছ থেকেই। তখন তো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এই লোকগুলিই ছিলেন ইসলাম বিশ্বাসী মানুষের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁদের এই ভুমিকাটাই ছিল শিক্ষকের ভূমিকা। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার এটাই বুঝিয়েছেন। হক্কানী পীর যারা তাঁরা এখনও এই ভুমিকায় আছেন। কিন্তু যারা এই পীর-মুরিদিকে স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা না বানিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড় তুলেন, তাঁদের পীর-মুরিদির সাথে ইসলামের আগেরকার পীর-মুরিদির সম্পর্ক নেই। বলে রাখা ভাল, এই প্রথমদিককার সুফি-সেইন্টরা কেউ বলেন নি যে, তাঁদেরকে সেজদা দিতে, তাঁদেরকে টাকা পয়সা দিতে, তাঁদের কাছে কোন কিছু চাইতে।
অষ্টম, নবম, দশম বা একাদশ শতাব্দীর সুফি-পীরদের কথা নাই বললাম, কিন্তু ত্রয়োদশ, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের সুফিদের কথাই ধরি, খান জাহান আলী, শাহজালাল, শাহপরান, শাহমাখদুম, শাহআমানত, শাহআলী প্রমুখ সুফিপীরদের ইতিহাস হেগিওলজিক্যাল লিটারেচারে ভালভাবে আছে। তাঁরা কেউ কাউকে পীরপূজা, মাজার পূজা করার জন্য বলেন নি। তাঁরা কেউ এই নিয়ে ব্যবসা করেন নি। একদিকে ধর্ম প্রচার করেছেন, অন্যদিকে প্রয়োজনে সমাজ থেকে জুলুম উতপাটনের জন্য তরবারী হাতে নিয়েছেন, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সবই তাঁরা করেছেন ইসলামের জন্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য।
কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে পীর-মুরিদি একটা ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক-ছাত্রের জায়গা এখন দখল করেছে বিক্রেতা (ব্যবসায়ী)-ক্লায়েন্ট (কাস্টমার)। বহু পীর এখন ব্যবসা খুলে বসেছেন।
যে কাজ এমনকি মরহুম পীর করেন নি, পীরের নামে তা এখন চলছে। আমি বাস্তব একটা উদাহরণ দেই, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা শাহজালাল (রঃ) এর মাজারের পাশের রাস্তা দিয়ে এখন নাক বন্ধ করে যেতে হয়। গাজার গন্ধে ওখান থেকে যাওয়া যায় না। নারী-পুরুষ একত্র হয়ে গান গাঁয়, আড্ডা দেয়। আর এটাকেই এরা বলে ইসলাম। কথা হল, এই যে কাজগুলি এরা করছে, মরহুম সুফি বা পীর সাহেব কি তা কখনো করেছেন?
উত্তর হল একটা BIG NO. অনেকে চুরি করে, দুর্নীতি করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাধ করে মাজারে গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। আর মনে করে এভাবে তাঁরা পাপ মোচন করছে। এরা জালিম। এদের এই অপকর্মে মরহুম পীর সাহেবের কোন অংশ নেই। কেউ যদি মাজারের এই অপকর্মের কারণে মরহুম হক্কানী এই পীর সাহেবের উপর সামান্যতম অশ্রদ্ধা করেন, সেটাও অবিচার, অন্যায়।
কাজেই হক্কানী পীর, মাশায়েখ যারা আছেন, আমি তাঁদেরকে সম্মান করি। তাঁরা মানুষকে হেদায়েতের কথা বলেন, হেদায়েতের কথা শুনান। টাকা-পয়সা বা সম্পদের প্রতি তাঁদের মোহ থাকে না। আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার এখানে একটা কথা বলেছেন, “হক্কানী পীর চিনবেন কিভাবে? যারা দেখবেন কোন টাকা পয়সা নেয় না, টাকা পয়সা চায় না, বরং তাঁদের জ্ঞান থেকে আপনাকে বিতরণ করে তাঁরাই হক্কানী পীর।” তিনি আরও বলেন, “হক্কানী পীর, আলিম, উলামা বলেন, নেও নেও নেও। আর বাতিলপন্থী পীররা বলে, দেও, দেও, দেও। যারা খালি চাই চাই করে তাঁদের কাছে যাবেন না”।
এর মানে দাড়ায়, ভাল পীর, মন্দ পীর বলে কথা আছে। পীর মানেই সবাই খারাপ, তা যেমন ঠিক না, পীর মানেই সবাই ভাল নাও হতে পারে। জ্ঞানের এখন যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছে। হাদীস গ্রন্থগুলি এখন বাংলায় পাওয়া যায়। কোরআনের তাফসীরগুলি বাংলায় পাওয়া যায়। বাটন টিপলেই অথেন্টিক নলেজ হাতের কাছে। এমন কোন পাড়া মহল্লা নেই যেখানে দু’একজন আলিম উলামা পাওয়া যাবে না। কে কি বলল তা একটু চেক করে নিলেই হয়। কোরআনের সাথে এবং হাদীসের সাথে যা মিলে তাই সঠিক, যা মিলে না তা বেঠিক ও বর্জনীয়। কোরআন ও হাদীস হচ্ছে পরশ পাথর (Touch stone)।
এই বাংলাদেশে পীর সাহেবদের অবদান অতুলনীয়। তাঁদেরকে অসম্মান করা কোনমতে কাম্য হতে পারে না। মাজার ব্যবসার নামে যা হচ্ছে তার জন্য তাঁরা দায়ী নন। বরং বলা যায়, এর জন্য আমরাই দায়ী। কিয়ামতের দিন তিনি যদি বলেন, “আমি তো মারা গেছি। আপনারা বেঁচে থাকতে আমার কবরকে কেন্দ্র করে এই ভন্ডরা কিভাবে চলল? আপনারা কেন তাঁদেরকে বাঁধা দেন নি?” তখন আমরা কি জবাব দিব? ঠিক, আবার যারা পীর-মুরিদি নামে ব্যবসা খুলে বসছে, তাঁদেরকেও পরিত্যাগ করা জরুরী। হক্কানী আলিম, উলামা, পীর, মাশায়েখের কাছে যাওয়া উচিৎ, তাঁদের থেকে ইন্টেলেকচুয়াল এবং স্পিরিচুয়াল কন্ট্রিবিউশন নেয়া উচিৎ। ভণ্ড, ধর্মের নামে ব্যবসায়ী যে হোক, তাকে বা তাদের প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ।