১৭ রামাদান ঐতিহাসিক ‘বদর দিবস’। শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এ দিনটি অনন্য স্থান দখল করে রেখেছে। হিজরি দ্বিতীয় সনের সতেরই রমজান মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ব ও তার পাঠানো রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিপক্ষে বিশ্বাসী ছোট একটি দলের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র লড়াই।
তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে প্রায় উপকরণহীন ছোট দলটিকে জয়ী করেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযেজিত হয় নতুন অধ্যায়। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অসামান্য। বদরের যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষার্থে, সত্যের পক্ষে, নিপীড়িতদের পক্ষে, মানবকল্যাণের নিমিত্তে। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে বিজয়ের সূচনা করেছিল। এ যুদ্ধে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। এ জন্য এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী যুদ্ধ বলা হয়। আল-কুরআনে এই দিনকে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বলা হয়েছে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিমদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়ার পর বদর যুদ্ধ ইসলামে প্রথম যুদ্ধের ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা দ্বিতীয় হিজরির ১২ সফর যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে নাজিল করেন,
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ “তোমরা আল্লাহ তায়ালার পথে সেসব লোকের সাথে লড়াই করো যারা তোমাদের সাথে লড়াই করে (কিন্তু কোনো অবস্থায়ই) সীমালঙ্ঘন করো না। কারণ আল্লাহ তায়ালা সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না”। (সূরা আল-বাকারা: ১৯০)।
মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন পবিত্র কুরআনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সূরায় বদর যুদ্ধ বিষয় উপস্থাপন করেছেন। এ যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। উক্ত সূরায় মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও সূরা আলে-ইমরানসহ অন্যান্য সূরায়ও বদরযুদ্ধ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। নিম্মে বদর যুদ্ধ বিষয়ে বিভিন্ন সূরায় উল্লেখিত আয়াতসমূহ উপস্থাপন করা হলো:
বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ:
আল্লাহ তা’য়লা ইরশাদ করেন,
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার”। (সূরা আলে ইমরান: ১২৩)
যুদ্ধ দিনটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ ঘোষণা:
দিনটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ হিসেবে ঘোষণা করে মহান আল্লাহ বলেন, إِن كُنتُمْ آمَنتُمْ بِاللّهِ وَمَا أَنزَلْنَا عَلَى عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফয়সালার দিনে, যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় সেনাদল। আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাশীল”।(সূরা আল-আনফাল: ৪১)
শত্রুদের মনে ভীতির সঞ্চার:
এ যুদ্ধে আল্লাহ শত্রুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلآئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُواْ الَّذِينَ آمَنُواْ سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُواْ الرَّعْبَ
“যখন তোমার রব ফিরিশতাদের কাছে ওহি পাঠালেন, আমি তোমাদের সাথেই আছি, অতঃএব তোমরা মুমিনদের সাহস দাও (তাদের কদম অবিচল রাখো); অচিরেই আমি কাফিরদের মনে দারুণ এক ভীতির সঞ্চার করে দেবো”। (সূরা আল-আনফাল: ১২)
মুসলিমদের আল্লাহর সাহায্য দ্বারা শক্তিশালীকরন:
وَاذْكُرُواْ إِذْ أَنتُمْ قَلِيلٌ مُّسْتَضْعَفُونَ فِي الأَرْضِ تَخَافُونَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُم بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আর স্মরণ কর যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল বলে গণ্য হ’তে, তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদের অকস্মাৎ উঠিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয় দেন ও তোমাদেরকে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন এবং তোমাদেরকে উত্তম বস্ত্ত সমূহ জীবিকারূপে দান করেন যাতে তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও”। (সূরা আল-আনফাল: ২৬)
যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করার অঙ্গীকার:
যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের মোকাবেলায় ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করার অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ أَلَنْ يَكْفِيَكُمْ أَنْ يُمِدَّكُمْ رَبُّكُمْ بِثَلَاثَةِ آَلَافٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُنْزَلِينَ
“হে নবী! স্মরণ করুন যখন আপনি বিশ্বাসীগণকে বলেছিলেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন?” (সূরা আলে ইমরান: ১২৪)
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِينَ
যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে ফরিয়াদ পেশ করেছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের ফরিয়াদ কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি তোমাদের (এ যুদ্ধের ময়দানে) পরপর এক হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করব। (সূরা আল-আনফাল: ৯)
আল্লাহর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা:
বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَـكِنَّ اللّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللّهَ رَمَى وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلاء حَسَناً إِنَّ اللّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“(যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে) তাদের তোমরা কেউই হত্যা করোনি; বরং আল্লাহ তায়ালাই তাদের হত্যা করেছেন। আর তুমি যখন (তাদের প্রতি) তীর নিক্ষেপ করেছিলে, মূলত তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং করেছেন আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং”। (সূরা আল-আনফাল: ১৭)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশান্তি প্রেরণ:
এ যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে চিন্তাযুক্ত মুসলিমদের উপর প্রশান্তি নাযিল করেন,
إِذْ يُغَشِّيكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّن السَّمَاء مَاء لِّيُطَهِّرَكُم بِهِ وَيُذْهِبَ عَنكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ
“সেই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বারি বর্ষণ করেন। এটা তোমাদের পবিত্র করার জন্য এবং তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করার জন্য; তোমাদের মন দৃঢ় করার জন্য এবং তোমাদের পদযুগল প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য করা হয়েছে”। (সূরা আল-আ‘রাফ: ১১)
সত্যেকে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দেয়ার ঘোষণা:
বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ-
“আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’।‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়”। ( সূরা আল-আনফাল: ৭-৮ )।
কাফিরদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার ও আঘাত করার ঘোষণা:
سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُواْ الرَّعْبَ فَاضْرِبُواْ فَوْقَ الأَعْنَاقِ وَاضْرِبُواْ مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
যারা কুফরী করে আমি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেব। হে ফেরেশতাগণ, তোমরা শত্রুদের গর্দানের উপরিভাগে আঘাত করো; আরো আঘাত হানো প্রত্যেক গিরায় গিরায়।” (সূরা আল-আনফাল: ১২)
মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ রহমতের কথা স্মরণ:
وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَنْ يَّتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- (
“আর স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে অল্প, পরাজিত অবস্থায় পড়েছিলে দেশে; ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলে যে, তোমাদের না অন্যেরা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। অতঃপর তিনি তোমাদিগকে আশ্রয়ের ঠিকানা দিয়েছেন, স্বীয় সাহায্যের দ্বারা তোমাদিগকে শক্তি দান করেছেন এবং পরিচ্ছন্ন জীবিকা দিয়েছেন যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর”। ( সুরা আল-আনফাল: ২৬ )
মুসলিমদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ:
খোদায়ী সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হলো খোদাভীরু ও সংযমী হওয়া। তা না হলে যুদ্ধে পরাজয় ও লাঞ্ছনা অনিবার্য। وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার”। (সূরা আলে ইমরান: ১২৩)
সাহায্য প্রাপ্তির জন্য তাক্বওয়া ও ধৈর্য অবলম্বনের আদেশ:
بَلَى إِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا وَيَأْتُوكُمْ مِنْ فَوْرِهِمْ هَذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُمْ بِخَمْسَةِ آَلَافٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ
“হ্যাঁ! নিশ্চয়ই, যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও সংযমী হও এবং যদি তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে, তবে তোমাদের প্রতিপালক পাঁচ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ১২৫)
রাসূলুল্লাহ (স.) এর দু’আ কবুল ও বিজয়ের ঘোষণা:
যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় পড়ে কেঁদে কেঁদে এরূপ দু’আ করেন: “ইয়া আল্লাহ! এ অল্প সংখ্যক মুসলমান যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়, তাহলে দুনিয়াতে তোমার ইবাদত করার জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। এ দৃশ্য দেখে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ (স)! আপনি মাথা উঠান। আল্লাহ্ তা’য়ালা আপনার দু’আ কবুল করেছেন।
তখন মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করে রাসূলুল্লাহ (স.) বিজয়ের সংবাদ জানিয়ে দেন। ﺳَﻴُﻬْﺰَﻡُ ﺍﻟْﺠَﻤْﻊُ ﻭَﻳُﻮَﻟُّﻮﻥَ ﺍﻟﺪُّﺑُﺮ অর্থ: “অচিরেই এদল পরাভূত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাবে।, (সূরা আল-ক্বামার: ৪৫) উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করে যুদ্ধে জয়লাভের সুসংবাদ দেন।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব:
(১) বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের সাথে কাফিরদের সর্বপ্রথম মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষ।
(২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ।
(৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী অথচ একটি অসম যুদ্ধ। কেননা একটি সুসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ অধিক ও প্রশিক্ষিত সেনাদলের সাথে অপ্রস্ত্তত, অসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ কম এবং বাস্ত্তভিটা হারা মুহাজির ও নওমুসলিম আনছারদের এ যুদ্ধে জয় লাভ ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এ কারণেই এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’। (সূরা আল-আনফাল-৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে ।
(৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’। (সূরা আলে ইমরান: ১২৩)
(৫) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি।
(৬) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে।
(৭) বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মক্কা বিজয় ও তৎপরবর্তী বিশ্ববিজয়ের সোপান স্বরূপ। এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।
বদর যুদ্ধের শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
(১) মক্কায় পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নিতে মৌখিক ও লিখিতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার ফলে মুসলমানেরা চালকের আসনে থাকায় রাসূলকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে ছবর করতে হবে। যেমনটি মাক্কী জীবনে করা হয়েছিল।
(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।
(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হল বিজয়ের মূল হাতিয়ার।
(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে হবে জান্নাত লাভ। চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হউক বা সশস্ত্র মুকাবিলা হউক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে জান্নাত লাভ। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাছিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্র শক্তি ব্যয়িত হবে না।
(৫) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতা মন্ডলী পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলের বালু নিক্ষেপের মাধ্যমে (সূরা আল-আনফাল: ১৭) অতঃপর ফেরেশতাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছিল (সূরা আল-আনফাল: ৯)।
(৬) যুদ্ধে গনীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হ’লেও তা কখনোই মুখ্য হবে না। সর্বদা সেনাপতির অনুগত থাকতে হবে।
(৭) মুসলমানের ঈমানী শক্তিকে কাফিররা ভয় পায়, সংখ্যা ও অস্ত্র শক্তিকে নয়।
(৮) কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৪৯)। এ ধারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
(৯) মুজাহিদরা প্রতিরোধের ব্যাপারে সুদৃঢ় হলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য অদৃশ্য সাহায্য পৌঁছে।
(১০) যুদ্ধের ময়দানেও আল্লাহকে ভয় করা জরুরী। মুসলিম যোদ্ধাদেরকে সব সময়ই সংযমী ও খোদাভীরু হতে হবে।
(৬) আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হলো বড় বিষয়।
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে, ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে এবং নেতার আনুগত্যের দ্বারা আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের সাহায্য লাভ করা যায়। যার উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো বদরের ঐতিহাসিক যুদ্ধ।