এক মহানায়কের গল্প বলি। সিনেমার মহানায়ক না কিন্তু। একেবারে আমাদের মাটির মানুষ, আমাদের নিজেদের মানুষ ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম বরাবরই পরিচিত আল্লাহওয়ালা সেরা সেরা মানুষের জন্মভূমি বলে। তেমনই এক লোক ছিলেন তিনি। ঢাকা আলিয়া থেকে সেরা রেজাল্ট করে পাশ করা একজন আলেম আবার একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর সাদা টুপি এই ছিলো তার পোশাক।
সেবার (১৯৯১ সালে) চট্টগ্রামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো। হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো, লাখো মানুষ বাস্তভিটা হারিয়ে পথে বসলো। উনি হারালেন উনার সবচেয়ে আদরের ছোট বোনকে। ছোট্ট এক ছেলেকে রেখে উনার বোন, বোন জামাই ঘূর্ণিঝড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। চলে গেলেন আল্লাহর কাছে। সেই সময় উনি ও উনার বন্ধুরা মিলে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক অনুদান নিয়ে এসেছেন। উনি নিজে তত্ত্বাবধান করছেন ত্রান বিতরণ কার্যক্রম।
তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে যারা বাস্তুহারা হয়েছেন তাদেরকে সেমি পাকা ঘর বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই সেমি পাকা হয়ে গেলো। শুধু উনার বাড়ি ছাড়া। নিজের ভিটায় বেড়া আর টিন দিয়ে কোনরকমে একটা ঘর তুলেছেন। উনার আব্বা মাওলানা সাহেব বয়োবৃদ্ধ। উনি ছিলেন একমাত্র ছেলে। তিনিও নিজের খেয়ে সমাজের মোষ তাড়াচ্ছেন। যারা যারা ত্রান পেয়েছেন ঘর বানানোর জন্য তখনকার আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তিনিও এই কাতারেই পড়েন। কিন্তু নিজের জন্য সেখান থেকে কিছুই নিলেন না। মা-বাবা কিছুটা রাগ করলেন।
ছোট্ট কথায় বাবা মা কে বললেন, “ঐ ত্রানের টাকা থেকে আমি কিছুই নিতে পারবোনা। আমার যতটুকু সামর্থ ততটুকু দিয়ে আপনাদের ঘর বানিয়ে দিচ্ছি।” ছেলের জন্য পাগল ছিলেন মা। কিন্তু মরার আগ পর্যন্ত একটা আফসোস ছিলো আজীবন। পাকা ঘরের আফসোস। সংস্থার বিভিন্ন অনুদানের লক্ষ লক্ষ টাকা উনার হাত দিয়ে ব্যয় হলেও উনার বাড়িতে পাকা ঘর উঠেনি। বাসার সবচেয়ে অলংকৃত ফার্নিচার ছিলো উনার বুকশেলফ।
আরেকবারের ঘটনা, ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ পড়তে যাবেন। এয়ারপোর্টে যাবার সময় হয়ে এসেছে। সে সময় উনি সংস্থার গাড়ি নিয়ে কোন এক সামাজিক কাজে ব্যস্ত। ছেলেকে গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিলেন। অফিসে ফিরে হিসেব করে উনার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত সময়ে গাড়ির তেলের খরচ বের করলেন। ড্রাইভারের ভাড়া হিসেব করলেন। সেই টাকাগুলো সংস্থার ফান্ডে দিয়ে দিলেন। এটা খলিফা উমর কিংবা উমর ইবনে আব্দুল আজিজের সময়ের ঘটনা না। আমাদের সময়েরই ঘটনা।
এরকম হাজারো কিংবদন্তিনামা আছে উনার। তিনি নীরব, অনাড়ম্বর থাকতে পছন্দ করতেন। আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য পাগলপারা ছিলেন। আল্লাহ তার এই পছন্দের মানুষকে গত শনিবার (১৫ ই রমজান) নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি বীর চট্টলার সবার প্রিয় মানুষ অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ আবু তাহের। চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায় বাড়ি। সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ তিনি। এক প্রশান্ত হৃদয় তিনি। “হে প্রশান্ত মন। তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।” [সূরা ফাজর: ২৭-৩০]