ঈদের দিন প্রতিবেশী হলের ইয়ারমেট একটা পোস্ট দিয়েছে। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটাতে সে বিরক্ত। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। নজরুলের ওপর যারপরনাই বিরাগভাজন। হুমায়ূন আজাদের চোখে সে নজরুলকে দেখে। এ কারণে তার নজরুল সংক্রান্ত আলাপগুলো নির্মোহ হয়ে উঠে না। ঈদের সময় বাংলাভাষীদের মধ্যে নজরুলের এই গানটা মুখে মুখে থাকে। প্রচারমাধ্যমগুলোতে ঘটা করে পরিবেশিত হয় বিধায় জনপরিসরে খুব সমাদৃত। ইয়ারমেট কবিতাবন্ধু এই গানের একটা জায়গা নিয়ে আপত্তি করেছে।
লেখাটির সারমর্ম এই, ‘ঈদের গানের মধ্যে গাজি-শহীদ এইসব প্রসঙ্গ কেন আসবে? আনন্দ-উৎসবের মধ্যে হাঙ্গামার উপাদান ঢুকানো নজরুলের মূর্খতা প্রমাণ করে’। ওর তুলে আনা আলাপটা অনেকগুলো চিন্তার বাঁক তৈরি করেছে। গানের মাত্র দুই কলি আমার মুখস্ত আছে। লেখাটা পড়ে পুরো কবিতা আবার পড়েছি। উদ্দীষ্ট জায়গা সম্ভবত এখানে-
“আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজি মুসলিম হয়েছে শহিদ।”
আমার ভাই যেটাকে ‘হাঙ্গামার উপাদান’ বলছে, তার ও আমার পূর্বসূরীদের কাছে সেটা ছিল গৌরবের অনুষঙ্গ। শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে সেই গৌরবের চূড়ায় পৌঁছতে হয়। কিছু মানুষের রক্ত ও ঘামের ফোঁটা একসঙ্গে মিলে যে বৃষ্টি ঝরায়, সেই বৃষ্টিতেই পৃথিবীর খরপোড়া জমিন সবুজ থাকে। যাদের আত্মত্যাগ ও লাল রক্তের দাম দিয়ে উৎসবের নীল শামিয়ানা কিনি, আনন্দের দিনে তাদের কথা স্মরণ করা তো একেবারেই প্রাসঙ্গিক। উদযাপনের বাতাবরণে তাদের উত্তরসূরীরা যেন আত্মপরিচয় বিস্মৃত না হয়, সে কথা মনে করিয়ে দেয় যে কবি, তাঁর প্রজ্ঞা তো অনেক উঁচু দরের।
রুবাইয়ি বিনত মুআওয়িজ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) একজন সাহাবীর নাম। মুয়াজ ও মুআওয়িজ (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) নামে দুইজন সাহসী কিশোর সাহাবীর কথা অনেকবার শুনেছেন। রুবাইয়ি হলেন তাদেরই একজনের আদুরে কন্যা। তিনিও বাবার মতো দৃপ্ত ও দীপ্ত ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করতেন। দেখতে দেখতে রুবাইয়ির বিয়ের দিনক্ষণও কাছে চলে এলো। সৌভাগ্যবতী মেয়ে তিনি; তাঁর বিয়ের আসরে প্রিয় নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাশরিফ রেখেছিলেন। বিয়ের আয়োজনে ছোটো ছোটো মেয়েরা দফ বাজিয়ে গীত গেয়ে যাচ্ছে। গানের কথা কী ছিল?
বুখারীর বিশুদ্ধ বর্ণনায় রুবাইয়ির কাছে শুনুন-
“তারা দফ বাজাচ্ছে, আর বদরের যুদ্ধে শহীদ হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য শোকগাঁথা গাইছে।” [সহীহ বুখারী: ৪৮৫২] আহা! বিয়ের আসরে বসেও শহীদদের কথা তারা ভুলতেন না। কেউ তাদের বলেনি, এমন আনন্দঘন দিনে কেন ‘হাঙ্গামার উপাদান’ নিয়ে পরিবেশটা ভারী করছে?
উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নতুন জামা পরেছেন। তাঁকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনিতেই হাসিখুশি থাকতেন, হাসি বিলাতেন। কাউকে আনন্দিত হতে দেখলে তাঁর মন ভরে যাবে- এটা তো সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া উমার (রা:) নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসার মানুষ, আপনজন। নবিজীও খুশি হলেন। তাঁর সেই খুশি ও আনন্দের প্রকাশ করলেন সর্বোত্তম উপায়ে। প্রাণ খুলে দুআ করে দিলেন উমারকে (রা:)। ইস! কী সৌভাগ্য তাঁর! কী সৌভাগ্য তাঁদের!
সেই দুআটা কী ছিল, দেখব না?
“ইলবাস জাদিদা, ওয়া ‘ইশ হামিদা, ওয়া মুথ শাহিদা।”
‘নতুন কাপড় পরো,
সমাদৃত হয়ে বেঁচে থাকো,
শহিদ হয়ে মৃত্যুবরণ করো।’ [মুসনাদ আহমাদ: ৫৫৮৮। আহমাদ শাকিরের মতে হাদীসটি সহীহ।]
এ কেমন কথা! পরছেন সামান্য একটা জামা, সেখানেও শহিদ হওয়ার দু’আ। নতুন কাপড় পরার আনন্দের মধ্যেও শাহাদাতের কথা! হ্যাঁ, শহিদরা তাঁদের কাছে এমনই দামি ছিলেন। শহিদ হতে পারা তাঁদের কাছে এমনই গৌরবের বিষয় ছিল। খুশির দিনে, আনন্দের মুহূর্তে, উৎসবের সময়ে, উদযাপনের মহফেলে- সর্বত্রই শহিদরা প্রাসঙ্গিক; সর্বক্ষণই শাহাদাতের শিরিন শরাব পান করার আকুলতা তাঁরা লালন করতেন।
এঁদের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি, অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা ভুলে যাইনি, তারা ইনফেরিয়রিটির কমপ্লেক্সের জালে আঁটকে যাচ্ছি অথবা আটকা পড়ছি, অথচ এরাই হলেন আমাদের পূর্বসূরী। আমরা তাঁদের গৌরবদীপ্ত পথ ধরে হেঁটে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজি। নজরুল সেই পথটা চিনতেন। তিনি মূর্খ বা অজ্ঞ নন। আমরা যারা শেকড় ভুলেছি, আলেয়ার আলোয় দিগভ্রান্ত হয়েছি, নিজের পরিচয়টাও গিয়েছি ভুলে; অজ্ঞতার তির বরং আমাদের দিকে নিবদ্ধ হলেই মানায়।