আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’। (সূরা আল-আহজাব:২১) আপনাদের রাগ হতে পারে। ছাত্ররা ভুল করতে পারে। তাদের শাসন করা জরুরি হতে পারে। তবে শাসন করার নমুনা যদি এমন হয় তাহলে আপনার এখনো অনেক কিছুই শেখার বাকি আছে।
আলেম মানে কয়টা কিতাব আর উসুল মুখস্ত করা না। আলেম শব্দটার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আমাদের মনে আমরা আলেম বলতে অনেক পবিত্র একজন মানুষকে বুঝি। যিনি জাগতিক স্বার্থের উর্ধ্বে চিন্তা করেন। আলেমদেরকে কেউ অপমান করলে, গায়ে হাত তুললে আমরাই প্রতিবাদ করি। আমাদের মাদ্রাসা নিয়ে ভুল ম্যাসেজ দিয়ে নাস্তিকেরা ফিল্ম বানালে আমরাই ডিফেন্ড করি। প্রতিবাদের ঝড় তুলি।
কিন্তু এই ঘটনাগুলো কিন্তু ঘটছে প্রতিনিয়ত। আমার পরিচিত নিজের অনেকগুলো মাদ্রাসায় এসব নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। একজন ছাত্রকে কেন পা বেধে পায়ের তালুতে পিটাতে হবে? একজন ছাত্র যে কিনা এখনো শিশু তাকে কেন বেদম মাইর মারতে হবে। শরীরে এতো রাগ কেন? এতো হিংস্রতা কই থেকে আসে? কোনো কারণে রেগে গেলে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) সুন্নাহ অনুসরণ করতে পারেন না?
বস্তুত রাগ মানুষের জীবনকে সহজেই বিষাক্ত করে তুলতে পারে। রাগের মাথায় এমন সব কাজ ঘটে যেতে পারে যা ব্যক্তি, সমাজ তথা গোটা বিশ্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। তাই রাগ হলে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ পড়বেন। ‘যখন তোমাদের কারও রাগ আসে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকলে যেন বসে পড়ে। তাতে যদি রাগ দমে না যায়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।’ (তিরমিজি)
আবু দাউদ শরীফের একটি হাদিসে আছে, নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম)) বলেছেন, ‘রাগ আসে শয়তানের কাছ থেকে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন নেভাতে লাগে পানি। তাই যখন তোমরা রেগে যাবে, তখন অজু করে নেবে।’
মুসলিম শরীফে এসেছে, নবীজি (স) বলেছেন, যে রাগের সময় নিজেকে সামলে নিতে পারে, সেই প্রকৃত বাহাদুর। অন্য হাদিসে এসেছে, রাগ দেখানোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কিয়ামতের দিন পুরস্কৃত করবেন।’
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। চোখ রাঙাতেন না। কর্কশ ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতেন না। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন।
তাদের সাথে মজার মজার কথা বলতেন। ছোটদেরকে দেখলে আনন্দে নবীজীর বুক ভরে যেত। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। নবীজি যখন কোথাও সফরে বের হতেন, রাস্তায় কোন শিশুকে দেখলেই তাকে উটের পিঠে তুলে নিতেন এবং নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতেন। তিনি এতিম শিশুদের ভালোবাসতেন। তাদের মাথায় হাত বুলাতেন। নতুন জামাকাপড় কিনে দিতেন।
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এবং এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। একথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলির মধ্যে সামান্য ফাঁক রাখলেন। (বুখারী: ৪৯৯৮)।
হযরত আনাস (রা.) কে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর মা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেবায় অর্পণ করেন। (বুখারি:১৯৮২) দীর্ঘদিন খেদমত করতে গিয়ে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) কে কেমন পেয়েছেন সে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি ৯ বছর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) -এর খেদমত করেছি। আমার কোনো কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি, ‘এমন কেন করলে? বা এমন করোনি কেন’?” (মুসলিম: ২৩০৯)
শিশুদের শুধু শিক্ষা দীক্ষায় বড় করলেই হয় না। শিক্ষা হতে হবে মানবিক শিক্ষা। যেন তার মেধার বিকাশ ঘটে। যেন সে তার শিক্ষাকে, তার শিক্ষককে ভালোবেসে স্মরণ করে। এভাবে মারলে তো সে মরেই যাবে।
একবার এক ব্যক্তি একটি শিশুর অলংকার ছিনতাই করে তাকে পাথরে পিষে হত্যা করে। ওই শিশুহত্যার মৃত্যুদণ্ড, নিহত শিশুটির মতো প্রস্থরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। (মুসলিম: ৪৪৫৪)
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের প্রতি ছিলেন উদার। তিনি নামাযে থাকলে কিংবা খুতবা অবস্থায় থাকলে শিশুদের কোন সমস্যা দেখলে নামাজ দ্রুত শেষ করেছেন, খুতবা বন্ধ রেখেছেন। মসজিদে কোনো শিশু এলে তাকে তিনি সামনে ডেকে নিতেন। তিনি তাঁর সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে বলতেন ‘শিশুদের প্রতি এমন আচরণ করো, যাতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ সৃষ্টি হয়।’
অথচ আপনারা কি করছেন? একটা আত্মসম্মানহীন মানুষে তাদের পরিনত করছেন। একটা শিশুকে আপনি যা শিখাবেন বা যা দেখাবেন সে তাই শিখবে। শাসন করা দরকার হলে করবেন, কিন্তু এটা শাসন না। “যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ-ক্রটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন”। (সূরা আল ইমরান: ১৪০) মনে রাখবেন।