ফররুখ আহমদের শখ ছিলো একটা আলিশান বাড়ি বানাবেন। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সেই বাড়িতে থাকবেন, নিরালায় লেখালেখি করবেন। শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য তো মানুষ কতো কিছু করে, প্রয়োজনে সাত-পাঁচ করে। ফররুখও তো চাইলে পারতেন। তাঁর যে প্রতিভা ছিলো, কোনো এক শিল্পপতিকে নিয়ে দু-চারটি কবিতা লিখলে সেই শিল্পপতি তাঁকে একটা ‘নুহাশ পল্লী’ গিফট দিতে পারতেন। এমনকি ব্যাংক থেকে লোন নিয়েও চাইলে একটা বাড়ি বানাতে পারতেন। কিন্তু, কবি শখ পূরণের জন্য কিছুই করেননি।
কেনো করেননি? সেই প্রশ্নের জবাব কবির স্ত্রী তৈয়বা খাতুন দেন। “তাঁর ধর্মপ্রাণ মানস এতে সায় দেয়নি। ইসলামি মূল্যবোধ তিনি পরিহার করতে পারেননি। ব্যাংকের ঋণ নিলে সুদ দিতে হবে। সুদ তো ইসলামে হারাম। তিনি এ পথে (শখ পূরণে) পা বাড়াননি, এজন্য তাঁর আফসোসও ছিলো না।”
এই কবি যে আর দশটা কবির মতো ছিলেন না, স্ত্রীর ছোট্ট স্বীকারোক্তিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসলামি আদর্শ ধারণ করার পর সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে হয়, এমন কাজ তিনি এড়িয়ে চলতেন। কবিরা যা লিখেন, সেটা সাধারণত নিজেরাই মানেননি, যা প্রচার করেন, সেটা নিজেরাও বিশ্বাস করেননা। কবিদের এই দ্বিচারী স্বভাব নিয়ে আল মাহমুদ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন- “কবিরা সত্য কথা বলেনা, কিন্তু কবিদেরকে কেউ মিথ্যাবাদীও বলে না।”
ফররুখ আহমদকে এক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রম-ই বলা যায়। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই প্রকাশ করতেন। যা প্রকাশ করতেন, তাতে অটল থাকতেন। তিনি আইয়্যুব খানকে ‘জালিম’ মনে করতেন। সেই আইয়্যুব খানের সরকার যখন তাঁকে সরকারি টাকায় হজ্বে যাবার অফার দিলো, তখন তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বললেন- “আমি ড্রেনের পানি দিয়ে ওজু করি না!”
একদিকে পাশ্চাত্যের তোষণ, আরেকদিকে ‘বাবু সংস্কৃতি’, এই দুই সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে সাহিত্য চর্চা করাটা ছিলো প্রায় অবিশ্বাস্য। ফররুখ আহমদ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্বাসের সাগরে পাল তুলেন। নিজের স্বকীয়তার ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, “ছবি তো আঁকবো আমি, চিত্রকর আমার ছবি পড়ে তার রঙের ছবি আঁকবে। চিত্রকরের ছবি আঁকা দেখে আমি কবিতার শব্দ সাজাবো না।”
সাহিত্যের মধ্যে ‘ইসলাম’ নিয়ে আসাকে অনেকেই ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ বলতো। তাদের কাছে সাহিত্য বলতে ছিলো, প্রেম, মানবতাবাদ, বিপ্লব; যেখানে ধর্মের কোনো ছিটেফোঁটা থাকবে না। ফররুখ আহমদ ইসলামি সাহিত্যের পাল তোলা নৌকায় হাল ধরলে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় সমালোচনার তীর নিক্ষেপ। কেউ কেউ সামনাসামনি বলতো, কেউবা পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা করতো।
কলকাতায় এক সাহিত্য আড্ডা শেষে অজিত দত্ত ফররুখকে বলেই ফেললেন, “আপনি ধর্মকে কবিতায় আনেন কেনো? এখনকার সময় হচ্ছে মানুষের (মানবতার সময়)। এখন কি মধ্যযুগের ধর্মের সময় আছে?” এমন তীক্ষ্ণ আঘাতের সাবলীল জবাব দেন ফররুখ আহমদ। তিনি বলেন, “আমি তো ধর্ম নিয়ে কবিতা লিখি না, আমি কবিতা লিখি ইসলাম নিয়ে। আর ইসলাম তো চিরন্তন মানব ধর্ম।”
মানবধর্ম, মানবতাবাদ নামে অনেকেই নিজের মনগড়া তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, অনেকেই সমাজতন্ত্র থেকে মানবতাবাদ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু, ফররুখ আহমদ মানবতার সবক নেবার জন্য অন্য কোনো জীবনাদর্শে নোঙর ফেলেননি, তাঁর নোঙর তো ইসলামি আদর্শের মধ্যে। মানবতার বুলি যে ইসলামের আঙ্গিনা থেকে তোলা যায়, সেই সুর তাঁর ‘সিরাজুম মুনিরা’ আর ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে দেখান।
যে সমাজে আবু জাহেল, উমাইয়্যা ইবনে খালাফরা থাকবে, সেই সমাজেই তো খাব্বাব, বিলালরা ‘আহাদুন আহাদ’ বলে সুর তুলবে। ইসলাম গ্রহণ করার জন্য খাব্বাব, বিলাল, ইয়াসির, সুমাইয়্যাদের (রাদিআল্লাহু আনহুম) উপর কীরূপ অত্যাচার করা হয়েছিলো, সেটা আমরা সীরাতের গ্রন্থে পড়েছি।
একজন ‘ইসলামিস্ট’ হবার জন্য কিভাবে নিগৃহীত, অবহেলিত হতে হয় সেটাও আমরা ফররুখের জীবনে দেখেছি। তাঁর চাকরি চলে যায়, কবি মহলে অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হতে হয় তাঁকে। ১৯৭৪ সালে নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে দেশের সকল খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক দাওয়াত পেলেও দাওয়াত জোটেনি তখনকার শক্তিশালী কবি ফররুখের। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলা হয়, “তিনি এখন একজন ‘ইসলামি কবি’ এজন্য দাওয়াত দেওয়া হয়নি।”
যারা অসাম্প্রদায়িকতার জিকির তুলে, তাদের অসাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞায়নের বাইরে গেলে তাকে কিভাবে ছুড়ে ফেলা হয় সেটা আমরা ফররুখের জীবনীতে দেখেছি। আহমদ ছফা অনেক সময় অনেককিছু বলে দিতেন, কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। ফররুখকে নিয়ে যারা হিপোক্রেসিতে লিপ্ত ছিলো, তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, “ফররুখ আহমদের অপরাধ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায় যে, তিনি অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের মতো স্লোগান বদল করতে পারেননি। সৎ কবিরা অনেকসময় ধরতার বুলিতে গা ঢেলে দিতে পারেন না। সেটাই তাদের অপরাধ। কবি ফররুখ আহমদও একই অপরাধে অপরাধী।”
চাকরি চলে যাবার পর মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারেননি। মেয়ে মারা যায়। পরিবার নিয়ে অনাহারে দিনাতিপাত করেন, তবুও ফররুখ কারো কাছে হাত পাতেননি। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ দুশো টাকা নিয়ে যান ফররুখের দুর্দিনে সহযোগিতা করার জন্য, ফররুখ উল্টো ধমক দিয়ে তাকে ফিরনি খাইয়ে বিদায় করেন। প্রকাশক তৈয়েবুর রহমান ফররুখকে আর্থিক সাহায্য করতে গেলে ফররুখ কথা ঘুরিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান।
যে কবি ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে, খোদার মদদ ছাড়া’ কবিতা লিখেন, তিনি কিভাবে মানুষের দুয়ারে হাত পাতেন? তিনি আর দশজন কবির মতো ছিলেন না।
যা লিখতেন, সেটা নিজে ধারণ করতেন। কবির লাইফস্টাইল নিয়ে ছোট্ট একটা রিভিউ দেন তাঁর মেয়ে ইয়াসমিন বানু। “আব্বা বলতেন, ‘দাম্ভিক পরহেজগারের চাইতে অনুতপ্ত পাপী ভালো’। জীবনে জ্ঞান থাকাবস্থায় তিনি সাধারণত নামাজ কাযা করেননি। শরীর ভীষণ অসুস্থ থাকাবস্থায় ত্রিশটি রোজাই রেখেছেন। নবিজীর সুন্নতকে ভালোবাসতেন বলে কাপড়ে তালি দিয়ে পরতেন।”
একজন ইসলামিস্ট জীবিতাবস্থায় সেক্যুলারদের কাছে বিভীষিকার মতো ভয়ানক। সেক্যুলাররা একজন ইসলামিস্টের ডেডবডিকেও যে ভয় পায়, সেটার প্রমাণ পাই ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর। তাঁর কবর দেওয়া নিয়ে যে রাজনীতি হয়, সেই ঘৃণ্যতম ইতিহাসের দলীলে আমরা কালো কালিতে তাদের নাম লিখে রাখবো!
আর ফররুখদেরকে তো আমরা হৃদয়ের মসনদে আসন পেতে দেবো৷ যিনি ক্ষণে ক্ষণে আমাদেরকে রিমাইন্ডার দিবেন- “রাত পোহাবার কতো দেরী, পাঞ্জেরী?”