ফেসবুকে একটা ট্রেন্ড দেখে চমকে উঠলাম। নতুন ট্রেন্ড ‘ট্রেন্ডিং মোহাম্মদ আলী! মোহাম্মদ আলীর আবার কী হলো? লিংকে ক্লিক করে পোস্টগুলো পড়ার পর আসল কাহিনী বুঝতে পারলাম। সেই ১৯৮০ সাল থেকে ৩৬ বছর দূরারোগ্য পারকিন্সন্স রোগে আক্রান্ত এই প্রবাদপুরুষ হসপিটালাইজড হয়েছেন। এবারে তার অবস্থা সুবিধার নয় খুব একটা। আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে। বিশ্বের প্রখ্যাত সব অ্যাথলেট, মুসলিম/অমুসলিম সেলেব্রিটি, স্কলার, দা’ঈ এবং সর্বস্তরের ফ্যান-ফলোয়ার এই ‘কালো মানুষটার আরোগ্য কামনা করছেন।
অনলাইনে পোস্টের পর পোস্ট হচ্ছে মোহাম্মদ আলী ট্রেন্ডিং এ। সত্যি বলতে হৃদয়ের এক কোণে বিষণ্ণতার প্রচ্ছন্ন মেঘ জমলো খবরটা দেখে। বক্সিং বুঝতাম না ছোটবেলায়, এখনো যে নিয়মকানুন ভালোমত বুঝি- তেমনটা না। অথচ সেই ছোট্টবেলায় আমার স্বপ্নের নায়ক ছিলেন ক্যাসিয়াস মার্ভেলাস ক্লে জুনিয়র আকা মোহাম্মদ আলী। তার গল্পগুলো স্বভাবতই টানতো। হয়ত যে কাউকেই টানবে। কারণ, সেগুলো আকর্ষণ করবার মতই।
ক্যাসিয়াস ক্লে’র কাহিনী পড়েছিলাম ক্লাস ৪-৫ এ থাকতে। আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্ম এবং বসবাস ছিল তার। ক্লের বাবা সিনিয়র ক্লে ছিলেন একজন রংমিস্ত্রি। মা ওডিসা গ্রেডি ক্লে একজন গৃহিণী। লুইসভিলের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ ব্লাক আমেরিকান। বাকি প্রায় সত্তর ভাগের উপরে হোয়াইট। সুতরাং, আমেরিকার চিরন্তন বর্ণবাদ সমস্যার একটা ক্ষেত্র এখানেও বিদ্যমান ছিল।
বক্সিং জগতে মোহাম্মদ আলীর আগমনের পেছনে এমনই একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। ছেলেবেলায় তার প্রিয় সাইকেলটা চুরি হয়ে যায় একদিন। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিলো না ১২ বছরের ছেলেটি। সমাজে কালো হিসেবে তার প্রতি রেসিস্ট দৃষ্টিকেও সে মেনে নিতে পারত না। মনের ক্রোধ নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে সাইকেল চোরকে পেয়ে গেলো শহরেই।
সেখানেই মারপিট শুরু করে দিলো তার সাথে। কিন্তু বয়সে ছোট এবং তুলনামূলক দূর্বল হওয়ায় সুবিধা করতে পারলো না খুব একটা। এই মারপিট-রত অবস্থা নজরে পড়লো লুইসভিলের পুলিশ অফিসার জো মার্টিনের। চোরের সাথে একচোট মারপিটের পরে নিজের ভাইকে সাথে নিয়ে পুলিশ অফিসারের কাছে গেলো ক্লে। পুলিশকে জানালো, সে চোরকে পিটাতে চায় খুব করে।
কিন্তু কিভাবে? একে তো সে ছোট, তার উপর তারা কালো। সমাজের চোখে দূর্বল। এহেন সমস্যায় পুলিশ অফিসার মার্টিন তাকে বাতলে দিলেন সমাধান। তাকে লড়াই করা শিখতে হবে। ১২ বছরের ক্লে কে বক্সিং শেখার পরামর্শ দিলেন মার্টিন। চোরের উপর গড়ে ওঠা রাগকে পুঁজি করে ক্যাসিয়াস ক্লে শুরু করলেন বক্সিং শেখা। অদম্য মনোবল, সাদা-কালোর ভিত্তিতে সৃষ্ট সমাজের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ, প্রচন্ড সাহস আর আশ্চর্য ক্ষীপ্রতার উপর ভর করে বালক ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠলেন কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলী।
তার খুব অনন্য এক বৈশিষ্ট্য ছিল। অন্যান্য বক্সারদের মত বক্সিং এর সময় তিনি দু’হাত মুখের সামনে রাখতেন না, রাখতেন মাথার পাশে। প্রতিপক্ষের মার ঠেকানোর জন্য তিনি নির্ভর করতেন নিজের সহজাত প্রবৃত্তির উপর। তার অসাধারণ ক্ষীপ্রতার খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। বক্সিং রিং এর তিনবারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, ১৯৬০ অলিম্পিকের স্বর্ণজয়ী বক্সার, অনেকগুলো উত্তেজনায় ঠাসা কালজয়ী বক্সিং ম্যাচ এর মহানায়ক ছিলেন তিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সে তৎকালীন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন বক্সার সনি লিসটনের সাথে দ্বৈরথে তার জয় তাকে বিশ্বব্যাপী লাইমলাইটে নিয়ে আসে। এই ম্যাচের আগে আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রজাপতির মত নেঁচে নেঁচে মৌমাছির মত হুল ফোটাবেন তিনি। যেটি এখনো তার স্মরণীয় উক্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম।
Float like a butterfly, sting like a bee. The hands can’t hit, what the eyes can’t see!
তিনি জীবনে মোট ৬১ টি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ৫৬ টিতে জিতেছেন। সমসাময়িক তাবৎ বক্সারদেরকে ধরাশায়ী করেছেন রিং-এর চার দড়ির পাকে। তার আত্মপ্রত্যয়, অদম্য মনোভাব তরুণদের মাঝে ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। এই রেকর্ডগুলো তাকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করিয়েছে সর্বকালের সেরা বক্সার হিসেবে।
তার জীবনের এই ঘটনাগুলো পড়েছি ম্যাগাজিনে বা পরবর্তীতে ইন্টারনেটে। কিন্তু ক্যাসিয়াস ক্লে’র প্রতি অনুরাগের জন্মটা ছিল সেই ছোটবেলায় পড়া তার সম্পর্কীয় ঘটনাটিতেই। সেখানে কিভাবে সাধারণ ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে তিনি বক্সার ক্লে হয়ে উঠেছিলেন বা বক্সার ক্লে থেকে কিভাবে মোহাম্মদ আলী হয়ে উঠেছিলেন তার সামগ্রীক বর্ণনা হয়ত ছিল না, কিন্তু একজন মোহাম্মদ আলীর সারা বিশ্বের কাছে অনুস্মরণীয় হয়ে ওঠার প্রাথমিক ইঙ্গিতটা ছিল।
কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার প্রথম পর্ব তখনো শেষ হয়নি। শুধুমাত্র তার বক্সিং রেকর্ড দিয়ে তার ব্যক্তিত্বকে মাপা চলে না। ১৯৬৪ সালে তিনি আচমকা তার মুসলিম হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। এমন একটি সময়ে বিনামেঘে বজ্রপাতটি তিনি ঘটালেন যখন বক্সিং রিং-এ তার খ্যাতি চূড়ায় অবস্থান করছে প্রায়।
সদ্যই হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সনি লিসটনকে হারিয়ে। সম্মাননা পেয়েছেন অবিতর্কিত হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্তি দিলেন না তিনি, নিজের পিতামাতার দেয়া নাম পরিবর্তন করে রাখলেন মোহাম্মদ আলী। এর আগে বর্ণবাদ বিরোধী আফ্রিকান আমেরিকান মুসলিমদের সংগঠন ‘নেশন অব ইসলামে’র সঙ্গে তার যোগাযোগ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ম্যালকম এক্স তার আধ্যাত্মিক গুরু হয়ে ওঠেন।
এমনকি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নিজেকে ক্যাসিয়াস এক্স বলেও উল্লেখ করতে থাকেন তিনি। পরে ১৯৬৪ সালে ইসলাম গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী নাম গ্রহণ করেন। বক্সিং এর কল্যাণে ক্যাসিয়াস ক্লে নামে গণমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন আগেই। তাই গণমাধ্যমও তাকে এই নামেই ডাকছিলো তখনো। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ক্যাসিয়াস ক্লে একটা দাসের নাম। আমি এটা বেছে নেইনি এবং এটা আমি চাইও না। তার পূর্ব পদবীর মাঝে তিনি বহু বছর ধরে চলে আসা কালো মানুষের দাসত্বের পরিচয় খুঁজে পেতেন।
১৯৬৪ সালেই আলী মনস্থির করলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। সে বছর প্রথম দফায় আমেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালে ফের পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হন। সৈনিক জীবনে প্রবেশ করার পর ঘটল নতুন ঘটনা যেটি শুধু আমেরিকা নয়, আলোড়িত করে পুরো বিশ্বকে। সেসময় ভিয়েতনামের সাথে আমেরিকার যুদ্ধ চলছিল। তিনি এ যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানালেন সরাসরি। রীতিমতো নিজের সামরিক বাহিনীর প্রতিই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। এর পেছনে কী ছিল তার যুক্তি? তার যুক্তি ছিল–
“কুরআন অন্যায়ভাবে যুদ্ধ সমর্থন করেনা। আল্লাহ বা নবীর নির্দেশ ছাড়া তিনি যুদ্ধে যাবেন না। ভিয়েতনামের সাথে তার কোনো বিরোধ নেই, তাদের কেউ তাকে কালো বলে গালিও দেয়নি।”
“Why should they ask me to put on a uniform and go 10,000 miles from home and drop bombs and bullets on Brown people in Vietnam while so-called Negro people in Louisville are treated like dogs and denied simple human rights? No, I’m not going 10,000 miles from home to help murders and burn another poor nation simply to continue the domination of white slave masters of the darker people the world over. This is the day when such evils must come to an end.
I have been warned that to take such a stand would cost me millions of dollars. But I have said it once and I will say it again. The real enemy of my people is here. I will not disgrace my religion, my people or myself by becoming a tool to enslave those who are fighting for their own justice, freedom and equality…. If I thought the war was going to bring freedom and equality to 22 million of my people, they wouldn’t have to draft me, I’d join tomorrow. I have nothing to lose by standing up for my beliefs. So, I’ll go to jail, so what? We’ve been in jail for 400 years.”
কী কঠিন-কঠোর বিদ্রোহাত্মক ছিল তার একেকটা শব্দ!
তিনি নিজেকে ক্যাসিয়াস ক্লে হিসেবে পরিচয় দিতে চাননি- খেসারত হিসেবে ১৯৬৬ সালে আমেরিকান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিতে পারলেননা। সে বছরের শেষদিকে আবার বক্সিং রিং-এ ফিরে আসার সুযোগ পেলেন ঠিকই। কিন্তু পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে, ‘তিন’ বছরের জন্য আবার নিষিদ্ধ হলেন বক্সিং রিং থেকে। এবারের রেশ- ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করা। রিং-এর চারদড়ির লড়াইয়ে নামতে না পেরে তিনি আইনী লড়াইয়ে নামলেন মার্কিন আদালতে।
যে মুহুর্তে হয়ত তাকে ভিয়েতনামের মাটিতে সশস্ত্র সমরে লিপ্ত থাকতে হতো, অথবা বক্সিং রিং-এ উত্তেজনাকর কোনো ম্যাচে প্রতিদ্বন্দিতা করতে হতো- সেই মুহুর্তে তিনি ঠান্ডা লড়াই চালালেন মার্কিন আদালতের বিচারকক্ষে। তার বক্সিং ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে, পরবর্তী চার বছর কোনো ধরণের বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি তিনি।
১৯৭১ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে তার আপিল পেশ করা হলো। যেখানে তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। জয়ী হলেন আলী।
অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার এই অনমনীয় দৃঢ়তা সর্বস্তরে শ্রদ্ধার আসনে বসালো তাকে। ফের বক্সিং রিং-এ ফিরে মার্চ, ১৯৭১ সালে আরেক কিংবদন্তী বক্সার জো ফ্রেজিয়ারের মুখোমুখি হন তিনি, যা ‘শতাব্দীর সেরা লড়াই’ হিসেবে পরিচিত। বহুল আলোচিত এ লড়াইটি ছিল দুই মহাবীরের লড়াই যা শিহরিত করে বক্সিং-প্রিয় সকলকে। জো ফ্রেজিয়ার জয়লাভ করলেন এই খেলায়। আলী প্রথমবারের মত কোনো বক্সিং ম্যাচে পরাজিত হলেন। ১৯৭৪ সালে ফ্রেজিয়ারের সাথে ফিরতি লড়াইয়ে অবশ্য শিরোপা পুণরুদ্ধার করলেন তিনি। একইসাথে ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮ সালে ওয়ার্ল্ড হেভওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বিশ্বব্যাপী নিজের খ্যাতিকে অতুলনীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
একজন মুসলিম হিসেবে কেমন ছিলেন আলী? কেমন ছিল তার ব্রান্ডিং?
১৯৬৪ সালে এলিজাহ মোহাম্মদের নেশন অব ইসলামের অনুসৃত বিকৃত ইসলামে প্রবেশ করলেও ১৯৭৫ এ মোহাম্মদ আলী সুন্নি ইসলামে দীক্ষিত হন। নেশন অব ইসলামের মতবাদকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেন। উল্লেখ্য, একই বছর তিনি বক্সিং রিং-এ লড়াই করেন ফ্রেজিয়ার এর সাথে। যেটা ছিল তাদের মধ্যকার সর্বশেষ লড়াই।
দুজন বীরের এ লড়াইয়ের জন্য সকলেই ছিল খুব উত্তেজিত, রোমাঞ্চিত। ১৪ রাউণ্ড শেষে ফ্রেজিয়ারের কোচ তাকে আর লড়াই করতে দিলেন না। কারণ, তার এক চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে। এর কিছুদিন পরই জো ফ্রেজিয়ার বক্সিং রিং থেকে অবসর গ্রহণ করেন চিরতরে। আলীও ১৯৭৯ সালে বক্সিং থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
তবে ১৯৮০ সালে তিনি ফিরে আসেন ল্যারি হোমস এর কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিতে। ল্যারি ছিলেন তার শিষ্য। লড়াইটি নিয়ে তাই সকলের মধ্যেই আগ্রহ ছিল বিপুল। কিন্তু ১১ রাউন্ড পর আলী পরাজিত হন ল্যারির কাছে। পরে জানা যায় তার মস্তিষ্কে মারাত্মক জটিলতা ধরা পড়েছে। তার মস্তিষ্ক ফুটো হয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ ১৯৮১ সালে আলী তার অ্যাথলেটের জীবন থেকে চিরতরে অবসর গ্রহণ করেন। তার ৫৬ জয়ের মধ্যে ৩৭ টিই ছিল নকআউটে।
বক্সার মোহাম্মদ আলীর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়টা ছিল ফিলানথ্রোপিস্ট মুসলিম হিসেবে তার লোকহিতৈষী কর্ম দিয়ে ঘেরা। অপ্রতিদ্বন্দী বক্সিং ক্যারিয়ার তাকে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। অপরদিকে বর্ণবাদ-বিরোধী অবস্থান, অন্যায়কে স্পষ্টভাবে অন্যায় বলার সাহস- নিপীড়িত মানুষের দুনিয়ায় তাকে দিয়েছিল সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা। আলী ম্যালকম এক্স এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন ১৯৬২ সালে। খুব দ্রুতই যিনি হয়ে ওঠেন তার রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরু। ম্যালকম এক্স তখনও ছিলেন নেশন অব ইসলামের একজন প্রথম সারির নেতা, এলিজাহ মোহাম্মদের সবচেয়ে কাছের শিষ্য, বলা যায় নেশন অব ইসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড।
বলা হয়ে থাকে, আলীর ধর্মীয় চিন্তার জগতটা ঘুরে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল এই মানুষটার। ১৯৬৩ এর পর থেকে ম্যালকম এক্স নেশন অব ইসলামের ভ্রান্তি আর কপটতা ধরতে শুরু করেন। এলিজাহ মোহাম্মদের সাথেও তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে তিনি নেশন অব ইসলামের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন সম্পূর্ণভাবে। সে বছরই তিনি সুন্নি ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় যেয়ে হজ্ব করে আসেন প্রিন্স ফয়সলামের রাজকীয় মেহমান হিসেবে।
গুরু-শিষ্যের মাঝে তখন এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরী হলো। ম্যালকম এক্স আলীকে সুন্নি ইসলাম গ্রহণ করানোর জন্য আহবান জানালেন, চেষ্টা করলেন বোঝানোর। বিপরীতে সদ্য নাম পরিবর্তন করে নেশন অব ইসলামে যোগ দেয়া আলী গুরুর সাথেই দিলেন সম্পর্কের পাট চুকিয়ে। পরে ১৯৬৫ সালে ম্যালকম এক্সকেই গুলি করে শহীদ করে দেয়া হলো। ম্যালকম এক্স-এর সাথে সম্পর্ক ত্যাগের ঘটনাকে পরবর্তীতে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
১৯৭২ সালে আলী হজ করতে পবিত্র কাবা ঘরে উপস্থিত হন। এখানে তিনি অন্য এক ইসলাম ধর্ম প্রত্যক্ষ করলেন। ইসলামের শ্বাশ্বত সৌন্দর্য দেখে তিনি তার গুরু ম্যালকম এক্সের মতোই প্রভাবিত হলেন। সর্বশেষ ১৯৭৫ এ তিনি নেশন অব ইসলামের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে সুন্নি ইসলামে নিজেকে ধর্মান্তরিত করে নিলেন। তার প্রশান্তি-লোভী মন জীবনের শেষ দিকে তাকে সুফিজমের দিকে ঝুঁকিয়েছিলো।
মানবতার কল্যাণের জন্য আলী তার সমগ্র জীবন জুড়ে কাজ করেছেন। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেছেন ক্ষুধায় কাতর আফ্রিকান মানুষগুলোর অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে। অসহায় মানুষের সেবায় কাজ করাকে তিনি নিজের উপর ইসলাম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন চ্যারিটি অর্গানাইজেশনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ দান করেছেন এ সময়ে। অনুমান করা হয় ক্ষুধায় জর্জরিত পৃথিবীর প্রায় ২.২ কোটি মানুষকে আলী খাবার সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭৪ এ তিনি দক্ষিণ লেবাননের এক ফিলিস্তিনি রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলেন। সেখানের অবস্থা দেখে ব্যথিত আলী বিশ্বকে ঘোষণা দিয়ে আহবান জানালেন, “support for the Palestinian struggle to liberate their homeland” । ১৯৭৮ এ আলীকে ৫ দিনের জন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে একটি বেসরকারী সংস্থা। এই সফরে তাকে অনারারি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয় সরকার।
যাইহোক, ২০১৬ সালের ৩রা জুন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ধর্মান্তরিত এই মুসলিম কিংবদন্তী। তার মৃত্যুতে সারা বিশ্বের মানুষ শোকাচ্ছান্ন হয়ে পড়ে। মুসলিম ইমাম, দা’ঈ, সেলেব্রিটি সর্বস্তরের মানুষ তাকে স্মরণ করে টুইট/পোস্ট করতে থাকেন অনলাইনে। ইসলাম, যুদ্ধ ও শান্তি, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, তার জীবনদর্শন, বর্ণবাদ, অন্যায় ইত্যাদি নিয়ে তার কিছু কিংবদন্তী তূল্য সাক্ষাৎকার, ভিডিও ক্লিপ, কোটেশন ভাইরাল হয় ইন্টারনেট দুনিয়ার প্রতিটি আঙিনায়।
যারা তাকে চিনতো না মৃত্যুর পর তারা তাকে অন্যরূপে জানার সুযোগ পায়। ইমাম জায়িদ শাকির, শায়খ হামজা ইউসুফ প্রমুখ তার জানাজা, দাফন-কাফনে নেতৃত্ব দেন সরাসরি। ঐ দিনে সারা বিশ্বজুড়েই মানুষের মুখে ছিল একটি নাম। “মোহাম্মদ আলী”। গতকাল (৩রা জুন) ছিল মোহাম্মদ আলীর চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকী। বিদায় কিংবদন্তী। আল্লাহ আপনার ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে আপনাকে জান্নাতে চিরপ্রশান্ত রাখুন। আল্লাহুম্মা আমীন।