ভদ্রলোকের মুখে দাড়ি আছে। নম্র স্বভাবের। অফিসে যোগ দিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। জাবির শুনলো, ভদ্রলোক ক্বুর’আনে হাফেয। সময় করে একদিন কথা বললো জাবির। আচ্ছা ভাই, ক্বুর’আন হিফয করতে চাইলে কী করতে হবে?
ভদ্রলোক একটু হাসলেন। আল্লাহর স্পেশাল ব্লেসিং ছাড়া সম্ভব না ভাই। আপনি প্রথমে ছোটো ছোটো সূরা দিয়ে শুরু করতে পারেন। জাবির সেভাবেই কাজ শুরু করলো। নতুন নতুন সূরা শেখে আর যোহরের নামাযের পর ভদ্রলোককে শোনায়। ভদ্রলোকও আগ্রহ নিয়ে শোনেন। কখনো আটকে যায় জাবির। পরদিন আবার শিখে আসে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
উস্তাদ বদলে যায় জাবিরের, কর্মক্ষেত্র বদলায়, বাসস্থান বদলায়, বয়স বাড়ে। কিন্তু কুর’আন হিফযের স্পৃহা থাকে সেই আগের মতো।
১৯ বছরের জাবির ২৮শে পৌঁছায়। বিয়ে করে। বাচ্চা হয়। অফিস শেষে বাসার ফেরে সন্ধ্যায় বসে ক্বুর’আন নিয়ে, নতুন সবক শেখে, আগের পড়া রিভিশন দেয়। তিলাওয়াত চলে প্রতিদিন। সে ভুলে যায়। সবক বন্ধ রেখে আবার আগের পড়া পড়তে থাকে। বারবার পড়ে। একদম শুরু থেকে আবার শুরু করে। আবার ভুলে। আবার শুরু করে। তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই। সে একটা স্বপ্নের পেছনে ছুটছে, কিছুতেই সেই স্বপ্ন রঙহীন হতে দেবে না।
বাচ্চারা বড় হয়। সংসার বড় হয়। সংসারের খরচ বাড়ে। উদায়াস্তের ক্লান্তিও বেড়ে যায় আগের চেয়ে বহু পরিমাণে। খাটুনী থাকবেই। পৃথিবী ফুলের বিছানা হবে না। জীবনে যন্ত্রণা থাকবেই। তাই বলে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। জাবির হাল ছাড়ে না। দাঁতে দাঁত চেপে অনুশীলন করে যায় প্রতিদিন। অল্প হলে অল্প, তিলাওয়াত করে প্রতিদিন। শুক্রবার সারাদিন ছুটি। সারাদিন তিলাওয়াত করে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও যাতায়ত বন্ধ হয়নি তাই বলে। সে জানে আল্লাহর ক্বালামকে সময় দিচ্ছে সে, সুতরাং তার সময়ের সুন্দরতম ব্যবস্থাপন আল্লাহই করে দেবেন। অবশ্যই করবেন।
কোথায় একটা হাদীস পড়েছিল। তার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। মনে রাখতে পারে না কিছু। আবছা মনে পড়ছে—যে আল্লাহর দিকে একটা মাত্র লক্ষ্যে স্থির হয়, তার বাকি সব চিন্তা-ভাবনা ও কাজ-কর্ম আল্লাহই গুছিয়ে দেন।
আশ্চর্য হয়ে জাবির দেখে, তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একদম খাপে খাপে মিলে গেছে। সংসার-রোজগার-চাকরি কিচ্ছু নিয়ে তেমন একটা ভাবনা নেই তার। সে শুধু ক্বুর’আন মুখস্থ করা নিয়ে ভাবে। এদিকে সব কাজ কীভাবে যেন খুব সুষ্ঠুভাবেই সমাধা হয়ে যায়। কোনো স্বজনের কাছ থেকে, পরিবার থেকে, স্ত্রী-সন্তান থেকে, অফিস থেকে তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই।
জাবিরের বয়স চল্লিশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ক্বুর’আন সম্পূর্ণ মুখস্থ হয় না তার। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। যতটা মুখস্থ করেছেন তা যেন কিছুতেই ভুলে না যায় সে চেষ্টা করেন। অনেকজনের সঙ্গে কথা বলেন। ক্বুর’আনে হাফেজ দেখলেই তার আবেগ উথলে উঠে। অফিসে নতুন জয়েন দিয়েছে একজন। বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোটো, কিন্তু পদবীতে তার সিনিয়র। ভদ্রলোক ক্বুর’আনে হাফেয। আবেগে কেঁপে উঠেন জাবির। ক্বুর’আন হিফয নিয়ে নানান কথা হয়। জাবিরের ইচ্ছে করে ভদ্রলোকের দুটো হাত টেনে চুমু খায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তিনি তবু জড়িয়ে ধরেন ভদ্রলোককে। ‘ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করবেন, কেমন! মাথাভর্তি গোবর-ঠাসা। কিচ্ছু মনে রাখতে পারি না।’
সমস্যা নেই ভাই। বেশী বেশী ‘রাব্বি জিদনী ইলমা’ পড়বেন। ‘রাব্বিশ’ রাহলী সাদরী…’ পড়বেন। আল্লাহ সাহায্য করবেন। ইনশাআল্লাহ। মাথা চুলকে জাবির বলেন, পড়ি তো।
অনেকেই বিরক্ত হয়। তিনি অনেক হুজুর-ইমাম ও নানান মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকে চট করে জবাব দিয়েছে, সম্ভব না। চাইলেই ক্বুর’আন হিফজ করা যায় না। আপনি বরং সূরা ইয়াসীন, সূরা রাহমান, সূরা ওয়াক্বিয়া এরকম কয়েকটা সূরা মুখস্থ করে রাখুন। কেউ কেউ ক্ষেপে গিয়েছেন। কথায় খানিক বিদ্রুপ মেখে বলেছে, চাইলেই যদি হিফজ করা যেত, সবাই হাফেজ হয়ে যেতো।
জাবিরের গায়ে লাগে না সেসব। সবার মুখে মধু ঝরবে না। কারো মুখ থেকে নিমও ঝরবে। গায়ে লাগাতে নেই এসব। তিনি বরং চেষ্টা করে যাবেন। ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। যারা সাহায্য করতে চায়, যাবেন তাদের কাছে। বারবার যাবেন। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। তিনজনকেই হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন, ওরা সবাই তার মাথা পেয়েছে মনে হয়। কেউ বেশিদূর পারেনি এগোতে।
এই মসজিদের ইমাম সাহেব বড় ভালো মানুষ। মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া হিফজ বিভাগের হাফেজটাও বড় নরম মনের মানুষ। ওরাই তাকে বললেন, শুধু শুধু বাচ্চাদের এখানে রেখে সময় নষ্ট করবেন কেন! ওরা অন্যভাবে পড়াশোনা করুক। জাবির দেখলেন আসলেই তাই। বাচ্চারা ক্বুর’আন মুখস্থ করতে না পারলেও, ক্লাসে ফার্স্ট হয়। পড়াশোনায় বেশ ভালো। তার তিন ছেলেমেয়েই এ প্লাস পেয়েছে। ছোটো মেয়ে এইচএইসসিতে, বড় দুই ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন।
বয়স হয়ে গেছে জাবিরের। আজকাল অফিস করা খুব কষ্টকর। প্রতিদিন সকালে বেরোনো, আবার সন্ধায় ফেরা, শরীরে কুলোয় না আর। কিন্তু তিলাওয়াত বন্ধ করেন না জাবির। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে এমন, কখনো অফিস ফেরত জাবির ক্লান্তিতে তিলাওয়াত বন্ধ রাখতে চাইলেও, তার স্ত্রী বলে উঠেন, কি ব্যাপার আজ ক্বুর’আন পড়বেন না!
ক্লান্তি উধাও নিমেষে। জাবির অযু করে ক্বুর’আন নিয়ে বসেন। তার এত বছরের সাধনা প্রায় শেষের পথে। একটু অবহেলা বা ক্লান্তির কারণে এত বছরের শ্রম নষ্ট হতে দিতে পারেন না তিনি। বয়সটাও কম হয়নি। মৃত্যুভয় জেঁকে ধরে তাকে। বয়স তার প্রায় ষাট এখন। কে জানে, মারা যাওয়ার আগে ক্বুর’আন সম্পূর্ণ মুখস্থ করতে পারবেন কিনা!
বড় ছেলে চাকরি করার পর থেকে একদম অবসর জাবিরের। বড় মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেছে। জাবির ক্বুর’আনকে প্রচুর সময় দিতে পারেন এখন। তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল ছিল, বয়সের কারণে আরো কমে গেছে মনে হয়। সকালে পড়লে সন্ধ্যায় ভুলে যান, সন্ধায় পড়লে মনে থাকে না সকালে। জাবিরের কান্না পায়। তাহাজ্জুদে খুব কাঁদেন। অনেক সময় ক্বুর’আন বন্ধ করতে ভয় হয় তার। যদি ভুলে যান আবার।
জাবিরের মা মারা গেছেন জন্মের পরপর। বাবাও বাঁচেননি বেশিদিন। বাবা-মায়ের জন্য কিছু করার সুযোগ হয়নি কোনোদিন। জাবির চেয়েছিলেন তিনি সম্পূর্ণ ক্বুর’আন মুখস্থ করবেন। ক্বুর’আনে হাফেজ হবেন। ক্বিয়ামতের মাঠে আল্লাহ হাফেজের মা-বাবাকে যে নুরের মুকুট পরিয়ে দেবেন, জাবিরের বাবা-মাও থাকবেন সেখানে। ১৯ বছর থেকে সাধনাটা টেনে এনেছেন ৬২ বছর পর্যন্ত। জাবির মৃত্যু পর্যন্ত এই স্বপ্নের পিছু ছাড়তে চান না। শেষ সবকের পাতা আর বেশী বাকি নেই, জাবির ক্বুর’আনে মনযোগী হন। আশাহত হবেন না তিনি। আল্লাহ তাকে এতটা যখন এনেছেন, বাকী পথটাও পার করবেন। অবশ্যই করবেন।