বাংলাদেশে মাদরাসা ধারার ইসলামি রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ছিলেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামি। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন বাংলাদেশ গঠনের পূর্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তিনি প্রায় ছয় দশক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মুফতি ফজলুল হক আমিনির মৃত্যুর পর থেকে তিনি আমৃত্যু ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি। মাওলানা নেজামি হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট দীর্ঘ ১৮ বছর বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। ২০১৭ সালে তার দল জোট ত্যাগ করে। গত ১০ মে ইন্তিকাল করেন এই বর্ষীয়ান আলেম রাজনীতিবিদ।
তিনি একদিকে যেমন ট্র্যাডিশনাল আলেম ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তেমনি উপনিবেশোত্তর কালের ইসলামি রাজনীতির সংকটও বুঝেছিলেন। তাই সচেতনভাবেই প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে তিনি আসেন। কিন্তু এখানে প্রশ্নও কম নয়। তাই তার অবস্থান বোঝার জন্য আমাদেরকে বর্তমান প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মের যে অবস্থান, তার প্রকৃতি কেমন। তাছাড়া রাজনীতি ও এর সাথে আলেমের সম্পৃক্ততার স্বরূপ কী। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত ও এর পরবর্তী পরিস্থিতির মুখে, মুসলিম বিশ্বের স্কলারদের মাঝে নতুনভাবে শুরু হয়েছে রাষ্ট্র ও আলেমের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক। আর এক্ষেত্রে ইন্ধনের ভূমিকা পালন করেছে সরকারী বা আধা সরকারী ধর্মীয় সংস্থাগুলো থেকে প্রকাশিত বিপ্লব সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক ফতোয়া। ফলে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-যন্ত্রের কতৃত্বের অধীনে একজন আলেমের কর্তব্য কী, কিংবা তার অবস্থান কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আরো প্রশ্ন সামনে আসে। যেমন, তার অবস্থানের শরয়ি স্বীকৃতি কী? সাধারণ মানুষের কাছে তার অবস্থানের উত্তর কী? কিংবা তার যে অবস্থান, এটি কোন মূলনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে? ইত্যাদি।
স্বাভাবিকভাবে আলেম ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মাঝে কয়েকটি সম্পর্ক হতে পারে।
- ১. সহযোগিতামূলক
- ২. সংস্কারমূলক
- ৩. বিদ্বেষ বা উৎখাতমূলক।
এ দুয়ের সম্পর্ক নিয়ে ট্র্যাডিশনাল আলেমগণও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. (৯১১ হি.) ও অন্যান্য কয়েকজন আলেম রাষ্ট্র ও আলেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখালেখি করেছেন। রাষ্ট্র বিষয়ে তারা তাত্ত্বিক ময়দানেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। সরকারি রাজনীতিতে ঢুকতে চাননি। দাবি জানাননি কোন সরকারী পদ পদবীর। বরং তারা সবসময় ভেবে এসেছেন, তাদের দায়িত্ব কেবল, মানুষকে শরীয়তের বিধান জানিয়ে দেয়া। ভাল কাজের আদেশ দেয়া আর মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান করা। তাদের মাঝে আমরা দেখতে পাই, তারা জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে কেবল শরীয়ার আইন কানুন বর্ণনা করে যেতেন কোন কিছুর পরোয়া না করে। আরেকদিকে নৈতিকভাবে এর জন্য যে অবস্থান নেয়া দরকার, সেটা গ্রহণে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হতেন না।
ইমাম জাফর আস-সাদেক রহ. বলেছেন, ‘ফোকাহাগণ হলেন আল্লাহর রাসূলের বিশ্বস্ত উত্তরাধিকারী। যদি দেখ, তারা সরকারি ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে, তাহলে তাদেরকে দোষারোপ করো।’ এজন্যই শরয়ি বিচারের পদ পর্যন্ত গ্রহণ করতে রাজি হতেন না ট্র্যাডিশনাল আলেমগণ। কারণ এর মধ্যেও দৃশ্যত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের ব্যাপার আছে। হাদিসশাস্ত্রবিদগণ তো সরকারের নিকটে যারা যায়, তাদের প্রচুর নিন্দা করতেন। তাদের বিশ্বস্ততা ও ধার্মিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে একে তারা প্রতিবন্ধক মনে করতেন। ইবনুল জাওযীর মত আলেমও নিন্দিত হয়েছেন অনেক আলেমের পক্ষ থেকে, সুলতানের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে।
আর আলেমদের মধ্যে যারা রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখতেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল হিতোপদেশ ও সংস্কার। এই ধারার আলেমগণের মনস্তত্ত্বে সব-সময় কাজ করত, না জানি সরকারকে কেউ কোন মন্দ পরামর্শ দিয়ে দেয়, না জানি সরকারি লোকেরা সব বিপথে চলে যায়। তাহলে তো রাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে নেক কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। অর্থাৎ তারা রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একটা নৈতিক মানদণ্ড দাঁড় করাবার চেষ্টা করতেন। হ্যাঁ.. এর ব্যাতিক্রম যে ছিল না, তা অবশ্য বলছি না। এজন্যই তো কাজি আবু বকর ইবনে আরাবী (৫৪৩ হি.) সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘তিনি রাষ্ট্রের লেজের সাথে লেগে গিয়েছিলেন। অন্যান্য আলেমগণ যেমন সরকার ও তার দল সম্পর্কে সর্বদা স্পষ্টভাষী ছিলেন, তেমন ধারায় চলেননি তিনি।’
ইসলামি ইতিহাসের দীর্ঘ ধারায় আলেম সমাজের অধিকাংশই স্বাতন্ত্র রক্ষা করে গিয়েছেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে তারা কায়েম করেছেন মকতব, মাদরাসাসহ ধর্মীয় শিক্ষার অন্যান্য কার্যালয়। আর বৈষয়িক দিক থেকে তারা বেসরকারি সাধারণ মানুষের অনুদান লাভ করেছেন। তাই যখনই তারা ইসলামি রাজনীতির বিষয়ে কলম ধরেছেন, তখন তাদের সামনে উদ্দেশ্য ও মানদণ্ড ছিল, মুসলিম জামাতগুলোর একতা, দারুল ইসলামের সংহতি রক্ষা। তাদের গবেষণা আবর্তিত হয়েছে এই ভিত্তির উপরই। সরকার যেন ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের গণ্ডিতে প্রবেশ করতে না পারে, এজন্য তাদের চেষ্টা কম ছিল না। ইমাম শাফেয়ী রাহ. তার উসুলুস ফিকহ গ্রন্থে এ বিষয়ের উপর বলেছেন যে, ধর্মীয় টেক্সের ব্যাখ্যা এমনভাবে করতে হবে, যেন সরকার নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে ঐ টেক্সের ব্যবহার করতে না পারে। তাছাড়া ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের যে অবস্থান ছিল ‘মাসআলায়ে খালকে কোরআন’এর ক্ষেত্রে, এটাকে ইলমিভাবে দেখলে, অনেক আলেমেরই দ্বিমত আছে এই অবস্থানের সাথে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একে পাঠ করা যায় খুব সহজে। অর্থাৎ ইমাম আহমাদের অবস্থানের মূল কথাটা যেন ছিল, সরকারকে ধর্মীয় ব্যাখ্যার গণ্ডীতে ঢুকতে না দেওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু বর্তমানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে আলেমদের সিদ্ধান্তের মাঝে। রাষ্ট্র নিজের বৈধতার জন্যে তৈরি করে নিয়েছে একদল আলেম, যারা ফিকহি বিষয়ে রাষ্ট্রকে সকল সীদ্ধান্তে সমর্থন করতে প্রস্তুত। আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র মূলত উপনিবেশ থেকে আমাদের সমাজে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। তা আধুনিক মতাদর্শ, কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, যা ইউরোপীয় মডেল থেকে ধারকৃত। আর এই রাষ্ট্র ইসলামী সমাজে যুগ পরম্পরায় চলে আসা ট্র্যাডিশনাল কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ধর্মীয় বিষয়েও কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে ফকিহগণকে, যারা দীর্ঘকাল স্বাধীনভাবে ঐতিহ্যবাহী ধারায় নিজেদের ধর্মীয় কাজগুলো সমাধা করেছেন। বর্তমানে রাষ্ট্র-সরকার প্রভাব বিস্তার করছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরেও। যে ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে অনুদান গ্রহণ করে আলেমগণ স্বাধীনভাবে জ্ঞান-চর্চা করতে পারতেন, পারতেন সরকার থেকে বিমুখ থাকতে, সেই ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ও এখন সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রের প্রবণতাই হল, কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের একচেটিয়াকরণ। তাই নিজেদের জন্য পৃথক ধর্মীয় বক্তব্য তৈরি করার খায়েশ তাদের থাকবে না কেন। আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলো নিজেদের জন্য যেসব ধর্মীয় বক্তব্য তৈরি করে, সেটাইকেই বলা হয় الإسلام الرسمي বা সরকারী ইসলাম। এর উদ্দেশ্য হল, নিজেদের জন্য একটা ধর্মীয় বৈধতা হাজির করা, সরকারি বয়ানের বাইরে যেসব বিপ্লবী বা পরিবর্তনকামী ইসলামের ব্যাখ্যা আছে, সব খণ্ডন করা এই সরকারি ইসলামের উদ্দেশ্য। এতে করে রাষ্ট্রের দুইটা লাভ হয়। ১. সাধারণ মানুষকে বস্তুবাদী কর্তৃত্বের নিগড়ে আটকে ফেলা। ২. আর বাধ্যতার সাথে কল্পিত সরকারি ইসলামের প্রতিমাকে পূজা দেয়া।
এই খায়েশ থেকেই প্রতিটি রাষ্ট্রই একটা অধীনস্থ ধর্মীয় সংস্থা করতে আগ্রহী। আগে যেখানে ফিকহ ছিল একটা ধর্মীয় চর্চা, যে কেউ ইচ্ছে করলেই এর যোগ্যতা অর্জন করতে পারত, সেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের অধীনে গ্রান্ড মুফতি পদে নির্বাচিত করা হচ্ছে। তাও আবার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচন ও স্বাক্ষরের পরে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছু আঞ্চলিক, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব পাচ্ছে। যেমন, ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত আল-আজহারের অধীনে পরিচালিত ‘অ্যাকাডেমি অব ইসলামিক স্টাডিস’, ১৯৮১ সালে মক্কায় প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফিকহ একাডেমি’, ১৯৬২ সালে সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম ওয়াল্ড লীগ’ ইত্যাদি।
প্রথমে উল্লিখিত আল-আযহারের কথাই ধরি। আল-আযহার পেরিয়ে এসেছে ইতিহাসের অনেকগুলি ধাপ। এ দীর্ঘ সময়ে আল-আযহারের একটা জ্ঞানগত ও বৈষয়িক স্বাতন্ত্র চলে আসছিল। কিন্তু জামাল আবদুন নাসেরের সময়কাল থেকে আল-আযহার একটা সরকারি ইসলামের পরিমণ্ডলে চলে যায়। আগে যেখানে আল-আযহারের প্রধান নিযুক্ত করা হত আলেমদের শূরার বৈঠকে পরামর্শের পর, সেখানে এখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে নিযুক্ত করা হয় প্রধান শায়খকে।
কিন্তু এই সরকারি ইসলামের কারণে এর বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে গেছে আরো কিছু জ্ঞানতাত্ত্বিক দল। যারা ছিল স্বাতন্ত্রবাদী। প্রতিবাদ ও সমালোচনা তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে শাখাগত অনেক দল থাকলেও দুটি ধারা প্রধান। ১. জিহাদী সালাফী ধারা। যারা আমভাবে ট্র্যাডিশনাল আলেমদেরকে সরকারি আলেম হিসেবে গণ্য করে থাকে। ২. রাজনৈতিক পরিবর্তনবাদী ধারা। তাদের উপর ব্রাদারহুডের প্রবণতা খুব বেশি। এই ধারার অন্তর্ভুক্ত ফিকহী সংস্থাও আছে বিভিন্ন দেশে। যেমন, ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া এন্ড রিসার্চ’, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস’। এই সংস্থায় প্রসিদ্ধ সংস্কারপন্থী পরিবর্তনবাদী আলেমদের দেখা মিলে। যেমন, আহমাদ রাইসুনি, সালমান আল-আওদা ও ইউসুফ কারজাভি প্রমুখ। এই ফতোয়া সংস্থাগুলো বেসরকারিভাবে পরিবর্তনকামী ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিত। যদিও সরকারি ও পরিবর্তনকামী, এই দুই ধারার মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিভেদ বিদ্যমান, তবু এই বিরোধটা আগে ততটা স্পষ্ট ছিল না। ২০১০ এর পর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, আরব বসন্তের পর সুস্পষ্টভাবে আলাদা হয়ে যায় দুই ধারার মতামত, ফতোয়া ও মৌলিকত্বের প্রশ্নে। প্রথম ধারা ছিল সরকারি ফোকাহা। দ্বিতীয় ধারা ছিল বিপ্লবী ফোকাহা।
বিপ্লব বিরোধী দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তখন সরকারি আলেমদের সংঘটিত করার জন্যে নতুন ধর্মীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে দেখা যায়। ২০১৪ সালে আবুধাবীতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফোরাম ফর প্রমোটিং পিস ইন মুসলিম স্কলারস’, এর প্রধান ছিলেন শাইখ আবদুল্লাহ বিন বাইয়াহ। কিছুদিন আগে এই সংস্থার পক্ষ থেকে ইসরাইলের সাথে আরব আমিরাতের সম্পর্কের নরমালাইজেশনের পক্ষে মতামত দেয়া হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই শাইখই আরব বসন্তের আগে বিপ্লবী ফতোয়া সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস’এর সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি এই বিপ্লবী সংস্থার বিরোধিতায় প্রতিষ্ঠিত করেন ‘মুসলিম কাউন্সিল অব এল্ডার্স’। বিপ্লবী সংস্থাগুলো যেখানে রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের উৎসাহদাতা ছিল, সেখানে এই সরকারি সংস্থাগুলো ইসলামী আন্দোলনের ধর্মীয় বৈধতা নিয়ে অনবরত প্রশ্ন তুলে যাচ্ছিল। বিরোধ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক বিরোধ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পৃথক বক্তব্য তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল দুই দলকে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কিভাবে উলামায়ে কেরাম রাজনীতির হাতের খেলনা হয়ে গেলেন? কিভাবে তারা সারাজীবন ইলম ও ফিকহের চর্চা করার পরও জালেম রাজনীতিকে সমর্থন করতে পারলেন। এর উত্তর তিনভাবে দেয়া যায়।
- ইসলামী ফিকহের সাথে আধুনিক রাষ্ট্রের সম্পর্কের স্বরূপ।
- ফকিহগণের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র-প্রকৃতি।
- আলেমগণ যেই ট্র্যাডিশনে শিক্ষা লাভ করেছেন, আর যেই বাস্তবতায় তারা বসবাস করেন, দুয়ের মাঝে ভারসাম্যহীনতা ও সচেতনতার অভাব ফিকহে ইসলামি গড়ে উঠেছে খিলাফাহ ও ইমামাহর ক্রোড়ে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে সহযোগিতার সাথে এগিয়ে গিয়েছিলেন আলেমগণ ও খলিফাগণ। কিন্তু উম্মাহর ঐক্য, দারুল ইসলাম আর শরীয়ার উৎসগত ভিত্তিকে সম্বল করে। ফিকহ তখন ছিল ফকিহগণের স্বাধীন চর্চার ক্ষেত্র। কিন্তু দেশ-জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে রাজনীতির বিভিন্ন ধারা। হয়ত ধর্মের বিপরীত অথবা ধর্মের সহযোগী।
আলেমগণ ভাগ হয়ে গেছেন দু’ভাগে।
- ১. রাষ্ট্রের অধীনে কর্মচারী আলেম।
- ২. বিভিন্ন পন্থায় রাষ্ট্রের পরিবর্তন চান, এমন আলেম।
রাষ্ট্রের ছায়ায় তাই ট্র্যাডিশনাল ফিকহ বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করছে। একদিকে আছেন প্রতিবাদী বক্তব্য মুখে ইসলামী আন্দোলনের আলেম। অন্যদিকে আছেন রাষ্ট্রীয় ফোকাহা, যারা রাষ্ট্রের স্বার্থ, রাজনীতির পক্ষপাতমূলক বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। এ দুয়ের মাঝে আছে ট্র্যাডিশনাল ফকিহগণ, যারা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কোন মাথা ঘামান না। আরেক দিকে আছে সশস্ত্র বিপ্লবী ধারা। যারা ‘প্রকাশ্য রাষ্ট্রীয়’ রাজনীতি ও বক্তব্যে গৌণপ্রায়।
এভাবেই আমাদের এত বিভাজন ও প্রান্তিকতার ফলে ইসলামি ফিকহের তিনটি প্রান্তিক অবস্থান লক্ষ্য করার মত।
- একদিকে ফিকহ সমর্থন করে যাচ্ছে শোষণমূলক রাজনীতির প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে।
- ফিকহ আরেকদিকে প্রত্যেক পরিবর্তনকামী কাজকেই বানিয়ে দিচ্ছে ‘আল-জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’।
- আরেকদিকে মাদরাসার ফিকহ সম্পূর্ণরূপে বেখবর থেকে যাচ্ছে সমাজ, মানুষের আদত অভ্যাস আর জাগতিক প্রয়োজন থেকে। আধুনিক সময়ের সাথে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।
কিন্তু ট্র্যাডিশনাল ধারার শিক্ষা লাভ করার পরও কিছু ফকিহ আছেন, রাজনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ও সজাগ। তারা রাজনৈতিক সংস্কার চান, কিন্তু শাসকের উৎখাত চান না। মূলত তারা আকবরি আমলের মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও কামালী আমলের বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির ধারা অনুসরণ করে চলেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, তারা নিজেরা কিন্তু রাজনীতিতে পা দেননি। কারণ, তাদের যেই প্রভাব প্রতিপত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল সাধারণ মানুষের মাঝে, তাতে রাজনীতিতে যোগ দেবার প্রয়োজন তাদের পড়েনি। আধুনিক সৌদি আরবে সত্তর আশির দশকে বেড়ে উঠা সালমান আওদা ও সফর আল-হাওয়ালীর সাহওয়া আন্দোলন এই সংস্কারপন্থী ইসলামি সক্রিয়তার মূর্ত প্রতীক।
কিন্তু দেওবন্দের যাত্রা শুরু হবার পর আলেমগণ দেখলেন, বর্তমানে রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে যোগ দেয়া কিংবা কাছাকাছি যাওয়া ছাড়া সংস্কারপন্থী কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই তারা রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। এভাবে পরিবর্তনবাদী ধারায় না গিয়ে তারা নিজেদের ধর্মীয় ট্র্যাডিশনকে ঠিক রেখে সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যেতে পেরেছেন। বাংলাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলাম পার্টি ষাটের দশকে মুসলিম লীগ থেকে আলাদা হয়ে মূলত রাষ্ট্রের গঠন উপাদানে সংস্কারমূলক কাজ করতে চেয়েছেন। আর ঐ নেজামে ইসলাম পার্টির ধারায় দীর্ঘদিক রাজনীতি করেছেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী। তো দেখা যায়, এ পর্যায়ে তিনি আলফে সানী, নুরসী আর সাহওয়া আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু যখন তার নেজামে ইসলাম পার্টি ইসলামি ঐক্যজোটের সাথে গিয়ে যোগ দেয় তখন তার রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তন হয়। এর বাহ্যিক প্রকাশ ছিল, ইসলামী ঐক্যজোট ২০০১ সালের অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট বেঁধে ৩০০ আসনের দাবি। এভাবেই তিনি পরিবর্তনকামী রাজনীতি থেকে প্রত্যক্ষ ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তার পরবর্তী পর্যায়ের রাজনীতি যে নিছক ইসলামি দাবি দাওয়া পেশ করার জন্য নয়, সেটার স্বীকারোক্তি তার নিজের মুখ থেকেও পাওয়া যায়। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘ইসলামী ঐক্যজোট কি ইসলামি দাবি পেশ করার জন্য তৈরী হয়েছিল নাকি রাজনীতি করার জন্য?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘রাজনীতি করার জন্য। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ জোট গঠন হয়েছিল। জোটের প্রথম এমপি ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল হক। ১৯৯৬ সালের নিবাচনে জোট থেকে এমপি হয়েছিল গোলাম সারওয়ার।’
তিনি ক্ষমতার রাজনীতিতে চলে এসেছিলেন। এ অবস্থানে এসে ক্ষমতা কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতায় কাউকে সমর্থন করবেন না, এটা ভাবাই যায় না। তাই বলে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সবকিছুর বৈধতা তার কাছে ফিকহি দিক থেকে ছিল, এমনটা ভাবারও অবকাশ নেই। বরং তার অবস্থান যতটা না ছিল আদর্শগত, তার চেয়ে বেশি ছিল কৌশলগত। তিনি যেহেতু আদর্শগতভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করাকে কার্যকর মনে করতেন না, তাই প্রথম ধাপেই চারদলীয় জোটে অংশগ্রহণ করেননি। এজন্যই তিনি বলেছেন, ‘কেনো শর্ত ছাড়া নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে জোটে যেতে চাইনি। আমি স্বপ্ন দেখেছি ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনে একটা বিপ্লব সৃষ্টি করবো। আজ হোক কিংবা কাল। একটু একটু করেই সেটা করতে হবে।’
কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কৌশলগত দিক থেকে ভেবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন। আপন আইডোলজি বা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের মৌলিকত্বকে ঠিক রেখে আনুষাঙ্গিক বিষয়ে অধিকাংশ সময় স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হয়—এটাই স্বাভাবিক। এই যোগ দেয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আসলে যোগ দেয়াটাও তত ক্রিয়াশীল ছিল না। দেখলাম—জোটে না গেলে নতুন আরেকটি দল করতে হয় আমার। তাই নতুন দল না করতে সবার সঙ্গেই আবার যুক্ত হলাম।’
এভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, একদিকে মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী ছিলেন ট্র্যাডিশনাল আলেম। কিন্তু তিনি রাজনীতি সচেতন থেকেছেন। প্রথম জীবনে করেছেন পরিবর্তনকামী আন্দোলন নেজামে ইসলাম পার্টি। পরবর্তীতে তিনি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ইসলামী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছেন। দীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। চুকাতে পারলেন না দেনা পাওনার হিসাব। তার মত পেশাদার রাজনীতিবিদ আলেম সমাজে বিরল। আলেমদের রাজনীতি ও সফলতার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে তো রাজনীতি করতে হবে। তারপর সফলতার প্রশ্ন আসবে। ইসলামি দলগুলো তো রাজনীতি করে না। মৌসুম এলে ভোটে অংশ নেয় কেবল। মাঝেমধ্যে বিবৃতি দেয়, কনফারেন্স করে, এতটুকুই। রাজনীতির আলাদা একটা কাঠামো আছে, প্রাতিষ্ঠানিকতা আছে। এখানে নিয়মিত সময় দিতে হয়। পেশাদার হতে হয়। রাজনীতিতে আমাদের পেশাদারি মনোভাব নেই। যে যেখানে আছে, সেখান থেকে হয়তো সপ্তাহে একবার অফিসে আসে। দেখে যায়। কখনও মিছিলে অংশ নেয়।
ইসলামী ঐক্যজোটে আমি শায়খুল হাদীস রহ. এর সহকারী সেক্রেটারী ছিলাম। তখন দেখতাম—মিটিংয়ে একটা সভা করার তারিখ নির্ধারণ করা যেতো না। কারণ, শায়খুল হাদীস সাহেব ছয়টা মাদরাসায় দরস দেন, চরমোনাই পীর সাহেবের পুরো দেশে প্রোগ্রাম থাকে। সব শেষ করে কখন কার সময় হবে, এই নিয়ে বিপত্তি বাঁধতো। একবার প্রেস ক্লাবে প্রেস কনফারেন্স করবো জোটের পক্ষ থেকে। এসময় তারিখ ঠিক করেও কয়েকবার তারিখ বদলাতে হয়েছে।’ রাহিমাহুল্লাহু রহমাতান ওয়াসিয়াহ।