১.
মালিহার মনটা প্রচণ্ড খারাপ। কখনো কারো সাথে সম্পর্কে যায়নি। সব সময় ইচ্ছা ছিল বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করবে। সেই অনুযায়ী জিহাদের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। যাকে নিয়ে মালিহার মনে ভালবাসার অঙ্কুরোদগম হচ্ছিল। ছোট্ট কুড়ি থেকে যখন সেই ভালোবাসা বড় বৃক্ষে পরিনত হলো, ডাল-পালার বিস্তৃতি ঘটছিল ঠিক তখনই জিহাদের বাবা ফোন দিয়ে বলে জিহাদ অন্য একজনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। যখন তার ভালবাসার বৃক্ষ কাউকে ছায়া দানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, ঠিক তখনই কেউ একজন বৃক্ষের গোড়া থেকে উপড়ে ফেলল।
এই কষ্ট কোথায় রাখবে? মরে যেতে ইচ্ছা করে। মালিহার বাবা বলেছে একটা ছেলে গিয়েছে তো কী হয়েছে? ওর থেকে বেশি টাকাওয়ালা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিব। কিন্তু সে তো শুধু টাকা দেখেছে। মালিহার হৃদয়ের কথা বুঝতে পারেনি। বস্তুত বুঝতে চেষ্টা করেনি। নীরবভাবে মালিহা মেনে নিয়েছে। আর আড়ালে আড়ালে অশ্রু ফেলেছে। মাঝরাতে হঠাৎ করে যখন ঘুম ভেঙেছে তখন অজানা এক ঝড় তার পুরো ভেতরটাকে ওলট পালট করে দিয়েছে। কিন্তু সে ঝড়টা একান্ত মালিহার। কেউ তার ভেতরের হাহাকার বুঝতে পারেনি।
মালিহার যখন খুব খারাপ লাগে তখন সে শিরিনের কাছে যায়। শিরিন হচ্ছে মালিহার রুমমেট আবার বড় আপু। তাদের মাঝে তিন বছরের তফাৎ হলে ও একে অপরকে খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারে। শিরিনকে তুমি তুমি করেই বলে। দ্বীনে ফেরার পর শিরিন আর মালিহার জীবন যাত্রা পাল্টে গেলেও মনের মিল আগের মতই। তাই কোনো সমস্যা হলেই একজন আরেকজনের কাছে যায়। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। খুব গভীরে জমা ছোট ছোট কষ্ট আর আক্ষেপগুলো বলে। একটু হালকা হয়। মালিহা ঘর থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য শিরিন আপুদের বাড়ি। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে শিরিনকে কল দিল।
- হ্যালো আপু। তুমি কি বাসায় আছো?
- ওপাশ থেকে উত্তর আসল হ্যা আছি।
- আচ্ছা থাক তবে। আমি আসছি। [মালিহা]
হঠাৎ করেই মালিহার আগমনের খবর পেয়ে শিরিনের বুঝতে বাকি রইল না যে মালিহার কিছু একটা হয়েছে। না হলে হঠাৎ করেই আসত না।
মালিহা আসলে শিরিনের আর কোন কাজ হয় না। শুধু কথা হয়। তাই হাতের কিছু কাজ গুছিয়ে টেবিলে বসে পড়ল। পাশে খাতা কলম রাখা। লেখাটা এখনো অর্ধেকের বেশি বাকি। মালিহা আসার আগে সম্ভবত শেষ হবে। শিরিন খুব মনযোগ দিয়ে সুন্দর ভাবে লিখছে।
২.
এক ঘন্টা পর। বাড়িতে কলিং বেলের আওয়াজ। শিরিন বুঝল মালিহা এসেছে। শিরিনের মা দরজা খুলে দিল। শিরিন আর উঠল না। মালিহা সরাসরি শিরিনের রুমে এসে ঢুকল। খু্ব শক্ত করে শিরিনকে জড়িয়ে ধরল।
মালিহা তুমি ফ্রেশ হও। বাড়িতে বিরিয়ানী রান্না হয়েছে। তোমার জন্য নিয়ে আসি বলে মালিহা বিরিয়ানী আনতে চলে গেল। মালিহার ব্যাগটা টেবিলে রাখতে গিয়ে শিরিনের লেখা কাগজটা সামনে পড়ল। খুব সুন্দর হাতের লেখা শিরিনের। তার ওপর খুব আয়োজন করে লেখা দেখে মালিহার একটু কৌতুহল হলো। কাগজটা ধরে মালিহা পড়তে শুরু করল-
‘পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি’
সকল প্রশংসা তার জন্য, যিনি এই বিশ্ব জাহানের মালিক। সকল ক্ষমতা ও রাজত্ব যার হাতে। যার হাতে আমার জন্ম ও মৃত্যু, আমার সব কিছু। লক্ষ কোটি সালাম বর্ষিত হোক মানববতার পথিকৃৎ, সকল সৃষ্টিকুলের সব থেকে পবিত্র ব্যক্তি, আমার প্রিয় রাসুল (সা.)-এর প্রতি। এই অসীয়তনামাটি শিরিন রুমান এর পক্ষ থেকে। তার স্থায়ী ঠিকানা পশ্চিম মেহের নগর, মোল্লাবাড়ি।
“প্রত্যাহার” । আমি আমার পূর্বের সকল অসীয়তনামা ও এই সংক্রান্ত সকল সাক্ষ্য বাতিল ঘোষনা করছি। আমার ঈমানের ঘোষনা-
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অবিনশ্বর। তার কোন শরিক নেই। তিনি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। এই বিশ্বজাহানে যা কিছু রয়েছে তিনি তার স্রষ্টা, নিয়ন্ত্রক ও পালনকর্তা। তিনি আমাকে রক্তপিণ্ড থেকে জন্ম দিয়েছেন এবং তিনিই আমার মৃত্যু দিবেন। তিনি ঈসা (আ.), মুসা (আ.), ইব্রাহিম (আ.) ও মুহাম্মাদসহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) সকল নবী ও রাসুলদের স্রষ্টা। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো থেকে জন্ম নেননি। তিনি সকল নবী ও রাসুলদের পৃথীবিতে পাঠিয়েন, যাতে করে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবগোষ্ঠীকে মহান রবের নূরের আলোতে বিভাসিত করতে পারেন।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী ও রাসুল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে জান্নাত ও জাহান্নাম চির সত্য। আমাদের সামনে যে কিয়ামত রয়েছে সেটা ও অনিবার্য। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, হাশরের দিন আল্লাহ তা’আলা প্রথম প্রজন্ম থেকে শেষ প্রজন্ম পর্যন্ত সকলে পুনরোত্থিত করবেন। আমি আমার পরিবার, আত্মীয়জন, বন্ধুসহ সবাইকে নসীহাহ করছি, আমার পর যারা বেঁচে থাকবে, তারা যেন প্রকৃত মুমিন হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
তারা যেন এই আসমান ও জমিনের স্রষ্টার প্রতি নিজেকে বিনীত ভাবে সমর্পন করে আর ভয় করে। তারা যেন সব কিছুর থেকে মহান রবকে ভালোবাসে ও ভরসা করে। তারা যেন জীবনের অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় থেকে সব কিছুতে আমার রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করে।
আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, সবাইকে তার জন্য সময় বেধে দেয়া হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর সবাইকে পরপারের অনন্তকালে জীবনের দিকে যাত্রা করতে হব। কেউ একটু আগে বা পরে যেতে পারবে না। আমার মৃত্যু আমার সৃষ্টির অনেক আগেই রবে দরবারে লিপিবদ্ধ করা হয়ে গিয়েছে। সবার ক্ষেত্রেই এমন। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও যারা পরকালের প্রস্তুতি নিচ্ছো না, তাদের জন্য রয়েছে চরম দুর্ভোগ। যারা ভাবে মৃত্যু অনেক দূরে তাদের জন্য আফসোস। কারণ আমাদের জীবনের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক খুব কাছের, যেমনটা নাক আর মুখের সম্পর্ক।
আমি মারা গেলে কষ্ট পাবে না। ধৈর্য ধারণ করবে। কারণ আমার জীবন আমার রবের সম্পদ। যার সম্পদ সে নিয়ে যাবে। আমরা শুধু তার দান করা প্রানের আমানতদার। তাই আমার মৃত্যুতে বেশি শোক বা বিলাপ করবে না। ইসলামে এর অনুমতি নেই। ইসলামে নারী-পুরুষ তিন দিনের বেশি শোক পালন করতে পারবে না। যদিও বিধবাদের ক্ষেত্রে আলাদা। কেউ যদি আমার মৃত্যুতে বিলাপ করে বা খুব শোকাহত হয়, তবে তাকে বাধা দিবে।
আমি আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের অনুরোধ করছি, নিজেরা বিশ্বাস করুক বা না করুক, তারা যেন আমার বিশ্বাসকে যথাযথ সম্মান করে। তারা যেন আমার নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান করে এবং আমি আমার অসিয়তনামায় যা কিছু লিখে যাচ্ছি এর এক অক্ষর পর্যন্ত পরিবর্তনের চেষ্টা না করে। তারা যেন আমাকে সেভাবে দাফন করে যেভাবে আমি চেয়েছি। আমার সম্পদ সেভাবে বন্টন করে যেভাবে আমি লিখে যাচ্ছি। তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ জুলুমকারীদের ভালোবাসেন না।
“জানাজা ও দাফনের ব্যাপারে” । আমার মৃত্যুর সময় যারা আমার নিকটে অবস্থান করবে, তারা যেন বার বার আমাকে শাহাদাহ পড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমি আমার আত্মীয় ও বন্ধুদের নির্দেশ দিচ্ছি, তারা যেন আমার গোসল ও দাফন সম্পূর্ন ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক করে থাকে। মৃত্যুর সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব আমাকে যেন দাফন করা হয়। যদি আমার জানাজা ও দাফনের কাজ অন্ধকারে করে, তবে আমি খুব খুশি হব। আমার লাশ যেন কোন প্রকার ময়নাতদন্তের জন্য না নেয়া হয়। যদি একান্তই ময়নাতদন্তের প্রয়োজন পড়ে, তবে যেন ‘MRI Scan’সহ করা হয়।
আমি যদি বিবাহিত হই, তবে আমাকে যেন আমার স্বামীর পাশে দাফন করে। আর যদি বিবাহিত না হই, তবে যেন আমার বাবার পাশে দাফন করা হয়। নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষ ছাড়া আমার মুখ যেন কেউ না দেখে। গায়রে মাহাররামগণ তো কখনোই না। আমার দাফনের সময় কবরে যেন আমার মাহাররামগণ নামায়। অর্থাৎ আমি চাই না, কোন গাইরে মাহাররাম আমাকে স্পর্শ করুক। হোক সেটা জীবিত থাকা অবস্থায় অথবা মৃত।
আমার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেন কোন বেদাতি কাজ না হয়। যেমন কবরে বাতি জ্বালানো, কবর উচু করা, কবরের পাশে কুরআন পড়া, কুরআন খতম করা, কুলখানি করা বা শোক সভা/মিলাদ, জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা। আমি পূর্বেই সবাইকে আমার ছবি ডিলিট দিতে বলেছি। তারপর ও যদি কারো কাছে আমার ছবি থাকে, তবে সে যেন আমার ছবি ডিলিট দিয়ে দেয়। হোক সে আমার ভাই, স্বামী বা সন্তানরা।
আমি জানি এই সব করতে তোমাদের খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আমি বিনীত অনুরোধ করছি, তোমরা এই সব পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। পরিস্থিতির জন্য যদি কোন কিছু ছাড় দেবার প্রয়োজন পড়ে, তবে অন্তত যেন মৌলিক বিষয়গুলো সঠিক ভাবে পালন করা হয়।
“সম্পদ সংক্রান্ত” । আমি অনুরোধ করছি আমার মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব সকল প্রকার ঋণ যেন পরিশোধ করে দেয়া হয়।
আমার ঋণ সম্পর্কে আমার ভাই অবগত রয়েছেন। সে যদি ঋণ পরিশোধে অপরাগত হয়, তবে যেন আমার সম্পদ থেকে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। আর তাও যদি পরিশোধে অপরাগ হয়, তবে যেন আল্লাহর ওয়াস্তে ঋণদাতা ব্যাক্তি আমাকে ক্ষমা করে দেয়। যদি সে এমন করে, তবে তার জন্য আখিরাতে মহা পুরস্কার রয়েছে।
আমি আমার মৃত্যুর পর আমার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ সদকায় জারিয়াহ হিসেবে দান করে যাচ্ছি। তারা যেন কুরআনে হিফজরত ইয়াতিম শিশুদের সাহায্য করে। আর যদি অনেক বেশি সম্পদ হয়, তবে যেন কোনো মসজিদের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করে ও কোনো একটি ইসলামি বই প্রকাশের জন্য দেয়। তবে মনে রাখবে, আমার এই সব ব্যয়ের ব্যাপারে পরিবারের লোক ছাড়া অন্য কেউ যেন না জানে। এমনকি যাদের দেয়া হবে, তারাও না জানলে ভালো হয়।
আমরা বাবার বাড়ির অবশিষ্ট সম্পত্তির উত্তোরাধিকারী যেন আমার ভাই হয়। আর নিজের যদি কোন সম্পদ থাকে তবে তাকে সমান ভাবে ভাগ করে আমার সন্তান ও ভাইয়ের সন্তানদের দেয়া হয়। তবে এই অসিয়ত তখনই কার্যকর হবে যখন আমার সন্তানদের জীবন ধারন ও শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে। আর স্বামীর বাড়ির অবশিষ্ট সম্পদ ইসলামি শরীয়াহ আইন মোতাবেক আমার সন্তানদের মধ্যে বন্টন হবে।
আমি বিন্দু পরিমান সম্পদের হিসাব নিয়ে আমার রবের কাছে যেতে চাই না। যেভাবে নিঃস্ব রিক্ত হাতে এসে ছিলাম, ঠিক তেমন নিঃস্ব রিক্ত হাতে রবের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চাই।
সবশেষে আমি আমার পরিবার, বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে অনুরোধ করছি, তারা যেন আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করেন। তারা যেন মহান আল্লাহর কাছে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যেসব মুসলিম ও অমুসলিম আমাকে কষ্ট দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করেছে আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। অনুরূপভাবে আমকে যারা কষ্ট দিয়েছি তারাও যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়।
“নির্বাহক নির্বাচন” । আমি মো. আমান রাহী (ভাই)-কে, বাড়ি পশ্চিম মেহেরনগর, মোল্লাবাড়ি ও মো. নুরুল শাফী (বাবা)-কে, বাড়ি পশ্চিম মেহের নগর, মোল্লাবাড়ি। আমার অসীয়তের নির্বাহক হিসেবে মনোনিত করছি। তাদের অনুরোধ করছি, অসিয়তে যা লেখা আছে তা যেন যথাযথভাবে পালন করে।
- এই অসিয়ত নামাটি সাক্ষর করছি ২০২০ সালে।
- আমার সাক্ষর: শিরিন রুমান
- প্রথম সাক্ষীর স্বাক্ষর:
- দ্বিতীয় সাক্ষীর স্বাক্ষর:
- নাম:
- ঠিকানা:
- পেশা:
৩.
লেখাটা পড়ে পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল মালিহা। চারদিক মনে হচ্ছে অন্ধকার হয়ে আসছে। সব কিছু ঘুরছে। নিজেকে কোনো মতে সামলে নেবার চেষ্টা করছে।
-এর মাঝে দরজায় কট কট আওয়াজ। শিরিন রুমে প্রবেশ করেই বলল, দুঃখিত মালিহা। ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। তাই একটু দেরি হলো। এই নাও। তোমার বিরিয়ানী।স
-কিন্তু মালিহার কোন সাড়া নেই। মালিহার কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলালো শিরিন। তারপর বলল ওহ। তুমি এটা পড়েছো? এখানে ভাইয়া আর বাবার স্বাক্ষর নিতে হবে।
-মালিহা কাঁদছে। কিন্তু আওয়াজ হচ্ছে না। খুব কষ্ট করে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল শিরিন আপু। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। জোরে কাঁদতে পারছি না। গলায় বেধে যাচ্ছে।
খুব বেশি কষ্ট পেলে মানুষ জোরে কান্না করতে পারে না। ভেতরে কান্নাটা আটকে থাকে। আর গলায় প্রচণ্ড ব্থা হয়। (শিরিন)
- আপু জিহাদ অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে। এটা শোনার পর আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি এটা আমার রবের নির্দেশে হয়েছে। তোমার এই অসিয়ত নামাটা পড়ার পর আমার ভেতরে অদ্ভুত ভাল লাগছে। ভেতরটা হালকা হয়ে গিয়েছে। আমি কার জন্য কাঁদি? ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ায় যে আমাকে ধোকা দিয়েছে? অথচ আমি এক বারও আমার রবের কথা ভাবিনি। সে আমাকে কত ভালোবাসে। যার দিকে আমার প্রত্যাবর্তন হবে। আমি সেই বিষয়ে একদম গাফেল ছিলাম। আপু আল্লাহ কী আমাকে মাফ করবেন?
শিরিনের চোখে অশ্রু, মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। অবশেষে প্রানের বান্ধবিও তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। একটু লুকিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে জবাব দিল, আল্লাহ অতিক্ষমাশীল। পর্বত সমান পাপও তিনি মূহুর্তে মাফ করে দেন।
চেয়ার থেকে দপ করে উঠে শিরিনকে জড়িয়ে ধরল মালিহা। আপু……আপু…… বলে চিৎকার করে কাঁদছে। শিরিন মালিহাকে বিছানায় বসালো। এক গ্লাস পানি ওর হাতে তুলে দিয়ে বলল অসীয়তনামা আমাদের মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যারা সব সময় মৃত্যুকে স্মরণ করে তারা আল্লাহকে ভয় করে। শাস্তির ভয়ে পাপ করে না। মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করলে আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গাফেল হই না। মৃত্যুর স্মরণ সবাইকে পবিত্র রাখে।
মালিহা মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনছে। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম) অনেক বড় একটা সুন্নাহ ছিল বার বার মৃত্যুকে স্মরণ করা। কিন্তু এখন এই সুন্নাহ হারিয়ে গিয়েছে। যার কারণে অনায়েসে সবাই পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ্ ভীতি কমে যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মত্যুকে স্মরণ করা। আর অসীয়তনামা মৃত্যুকে স্মরণ করায়। অসীয়তনামা থাকলে আমাদের বার বার মনে পড়ে একদিন মৃত্যু হবে। যখন মৃত্যু হবে তখন কোন মুখ নিয়ে রবের সামনে দাঁড়াবো। এই ভয়ে মানুষ ভুল পথ থেকে চলে আসে।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম) বলেছেন, “অসীয়ত যোগ্য এমন কিছু রয়েছে এমন মুসলিমের উচিত নয় যে, সে দু’রাত কাটাবে অথচ তার কাছে অসীয়ত লিখিত থাকবে না।” [১]
এই প্রসঙ্গে ইবনে উমার (রা.) বলেছেন, “রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাহিস সালাম) এর এই হাদিস শোনার পর আমি আমার অসীয়তনামাটি ছাড়া এক রাত ও কাটাইনি।” [২]
মালিহা কথাগুলো শুনতে শুনতে বিরিয়ানীগুলো খেয়ে নিল। এক গ্লাস পানি খেয়ে ওড়নার এক পাশ থেকে চোখ মুছে বলল যে কষ্টের কথা বলার জন্য এসে ছিলাম সে কষ্ট অনেক আগেই চলে গিয়েছি। আমি এখন আমার গন্তব্য চিনি। আর দুনিয়াবি অপূর্ণতায় কাঁদব না। আমি এখন আসি আপু। আমার রবের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
দরজাটা খুলে মালিহা বের হয়ে গেল। আর শিরিন দৌড়ে বেলকুনিতে গেল। জানালা থেকে ঐ আসমানের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু ফেলল। এই অশ্রু আজ দুঃখের নয়। একটা পতিত আত্মাকে তার গন্তব্যে যেতে দেখার আনন্দ অশ্রু। মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
রেফারেন্স:
১. সহিহ বুখারি: ২৭৩৮
২. সহিহ মুসলিম: ১৬২৭