বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলিম, প্রকৃতপক্ষে দেশের আলিমদের উস্তাদদের উস্তাদ ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। আল্লামা শফী শাহ ওয়ালীউল্লাহ পরবর্তী যে প্রথাগত দ্বীনী ইলমের চর্চা, তারই উত্তরাধিকার বহন করেছেন। মূলত, সিপাহী-জনতার ব্রিটিশবিরোধী মহাসংগ্রামের পর সমগ্র উপমহাদেশের আলিমদের ওপর ব্রিটিশরা যে গনহত্যা চালায়, তারই ফল হিসেবে দেওবন্দ গঠিত হয়। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ শোষণ ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের পরিনাম হিসেবে তৎকালীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসে, আজকের দেওবন্দ তার ফসল।
মূলত, দেওবন্দ যে সময় গঠিত হয়েছিল, তখনকার জন্য এটা ছিল উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামকে টিকিয়ে রাখার একেবারে সর্বশেষ উপায়। সরাসরি তাগুতের মুকাবিলায় না নেমে বরঞ্চ ইলম, আমল ও আখলাকের ওপর দাড়িয়ে তাগুতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে দেওবন্দ গঠন করা হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই ইসলামী জাহানে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে, তবে যে তীব্রতা নিয়ে তা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, আলজেরিয়া ও লিবিয়াতে উপস্থিত হয়েছিল তা অন্যত্র ছিল অনুপস্থিত। মূলত, এই অঞ্চলগুলিতেই ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চদের নির্যাতন-শোষন ছিল চরমে।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় দেওবন্দের অনুসারীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আশরাফ আলী থানভীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপ সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন করে, হুসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ সমর্থন করে অখন্ড ভারতকে। শাহ আহমদ শফী সরাসরি হুসাইন আহমদ মাদানীর ছাত্র। আমি যতদুর জানি, আল্লামা ছিলেন চিশতিয়্যা সুফী তরিকার অনুসারী।
হুসাইন আহমদ মাদানীর শিষ্য হিসেবে তার চিন্তাচেতনা ভারতের নিকটবর্তী হবার কথা থাকলেও আদতে তিনি ছিলেন তীব্র ভারতবিরোধী। এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক। বাংলাদেশের প্রথাগত দ্বীনী ইলম চর্চাকারীরা ভারতের বিরোধিতায় সোচ্চার, তাদের জ্ঞানগত উত্তরাধিকার দেওবন্দ হলেও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার দেওবন্দ না, এটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এটাকে ভুল বুঝে থাকেন। দারুল হারবের উলামাদের সিয়াসাত বা রাজনীতি অবশ্যই দারুল ইসলামের উলামাদের রাজনীতির চাইতে আলাদা হবে।
আমাদের দেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে ভারতবিরোধিতা দেখা গেলেও পাকিস্তানের প্রতি বাড়তি কোন আনুগত্য লক্ষ্য করা যায় না। অসংখ্য মাদ্রাসার ছাত্রদের সাথে মেশার মাধ্যমে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আওয়ামী লীগারদের মধ্যে যে বাড়তি ভারত বন্দনা বা জামায়াতে ইসলামী ভক্তদের মধ্যে যে বাড়তি পাকিস্তান প্রেম তা থেকে দেশের কওমী ঘরানা অনেকটাই মুক্ত। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান আন্দোলনের ফসল মনে করার মাধ্যমে পাকিস্তানকে একেবারে খারিজ করার যে হিন্দু জমিদারসুলভ বাম চিন্তা তার বিরোধিতা করেন, আবার মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটকে একচেটিয়া ভারতের দালালি বলে অভিহিত করার যে ভ্রান্তি, তাকেও প্রশ্রয় দেন না।
প্রকৃতপক্ষে, এই কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যেই বাংলাদেশী মুসলিম পরিচয়ের প্রতি সবচেয়ে স্পষ্ট আনুগত্য লক্ষ্য করা যায়। এই যে চৈন্তিক গড়ন, এটা আল্লামা শফীদের মত উস্তাদদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে সরাসরি প্রভাবিত। ভারতের দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলির ফারেগদের ভেতর এটা পাওয়া যায় না। আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে আমি তাই ভালোবাসি একটি রাজনৈতিক চিন্তাধারার উত্তরাধিকার হিসেবে, যে চিন্তা এই দেশের মুসলিমদের দ্বীনী ও রাজনৈতিক পরিচয়ের মিলন ঘটায়। হাজার প্রলোভনেও যা নিজের মুসলিম পরিচয় থেকে সরে যায় না।
এই চিন্তাকে আল্লামা ও তার উত্তরসুরীরা যথার্থভাবে ছাত্রদের হৃদয়ে গেথে দিয়েছিলেন বলেই শেষ জীবনে সন্তানের প্ররোচনায় তার যে বিচ্যুতি ঘটেছিল সেটার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তরুন কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তাকেই অপসারন করতে সক্ষম হয়েছিল বলে আমি মনে করি। এই চেতনার আরো জোরদার উত্তরাধিকার বর্তমান রয়েছে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, নুর হোসাইন কাসেমী ও মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীদের ভেতর। যে উস্তাদ হক্বের পথ থেকে সরে গেলে তার তালেবরা তাকে ঠিক করে দেন, সেই উস্তাদের মধ্যে মাকবুলিয়্যাত আছে, অস্বীকার করার উপায় নেই।
পক্ষান্তরে, আল্লামা শফী একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেশের মুসলমানদের ঐক্যের ডাক দিতে সক্ষম হলেও, বস্তুত, জাতীয় রাজনীতিতে পরবর্তীতে যে ভুমিকা পালনের সুযোগ তার জন্য ছিল তা পালন করতে পারেন নি। এটা নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও রাজনীতির ময়দানী অভিজ্ঞতার অভাবের কারনেই হয়েছে। দেওবন্দঘেষা ধারার একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যারা রাজনৈতিকভাবে ইসলামকে ধারন করতে চায়, তাদের প্রতি বিদ্বেষ ধারন এবং প্রয়োজনে তাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাতিলের সাথেও হাত মেলাতে কুন্ঠাবোধ না করা। এই উদাহরন পাকিস্তানের ডিজেল মাওলানা খ্যাত ফজলুর রহমান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শাহ আহমদ শফী, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এর দায় যে তাদের একার, তাও নয়।
আল্লামা শফীর পক্ষে সুযোগ ছিল মতাদর্শিক সীমাবদ্ধতাকে ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় ছাড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে নব্য উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার তৈরি করার। অন্তত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীও যদি তার সমর্থন পেতেন, এটা সম্ভব ছিল। আল্লামা শফীর আরো সুযোগ ছিল, কওমী মাদ্রাসাকে ব্রিটিশ আমলের মিনিমাইজড দ্বীনী ইলমের জায়গা থেকে উন্নত করে একবিংশ শতাব্দীর প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে শক্তিশালী করে তোলার। এর উদাহরন তুরস্কে-ইরানে-কাতারে আছে। তিনি লম্বা হায়াত পেয়েছিলেন। দিনশেষে আল্লামাকে আমি মনে রাখবো বাংলাদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা প্রথাগত ইসলামী শিক্ষার এক মহীরুহ হিসেবে, যার রাজনৈতিক শেকড় ভারত বা পাকিস্তানে নয়, বাংলাদেশে গাথা।
তাকে অন্ধভাবে অনুসরন না করে তার নেক চিন্তার উত্তরাধিকারকে বহন করা, আর চিন্তাগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যাওয়াই হবে পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাদেশী মুসলমানদের কর্তব্য। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন।