নূর মুহাম্মদ বেশ দক্ষ একজন দর্জী। দক্ষ হলে কী হবে, তার নিজের কোনো সেলাই মেশিন নেই। অন্যের মেশিন দিয়ে সেলাই করতে হয়। তাঁর অসচ্ছলতা দেখে একজন সরকারি অফিসারের দয়া হলো। তিনি নূর মুহাম্মদকে সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ড সিঙ্গারের একটি মেশিন কিনে দিলেন। নূর মুহাম্মদ যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। মহাখুশী। এবার তাঁর পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর হবে। বাড়ি ফিরে স্ত্রী ইমন বিবিকে মেশিনটি দেখালেন। ইমন বিবি স্বামীর আনন্দের সাথে তাল মেলাচ্ছেন না। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ। এতো দামী একটা মেশিন পেয়েও স্ত্রীর নিরাসক্তি দেখে নূর মুহাম্মদ বেশ অবাক হলেন।
“কী হলো, তোমার মুখে তো দেখি আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই। কোনো সমস্যা?”“আগে বলো মেশিনটি তোমাকে কে দিয়েছে?”
নূর মুহাম্মদ স্ত্রীকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। স্ত্রী তবুও সন্তুষ্ট না। ‘সরকারি অফিসার’ কথাটি শুনে তাঁর সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। গোপনে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। অফিসারটি কি সৎ নাকি ঘুষখোর? ইমন বিবির কাছে খবর আসলো, যে অফিসারটি তাঁর স্বামীকে সেলাই মেশিন উপহার দিয়েছেন, সে একজন অসৎ, ঘুষখোর অফিসার। ব্যাস, ইমন বিবি স্বামীকে গিয়ে বললেন,
“তোমার এই মেশিন দিয়ে সেলাই করে যা উপার্জন করবে, তা আমি খাবো না, আমার সন্তানদেরকে খাওয়াবো না। আমার পেটে, আমার সন্তানদের পেটে আমি কোনো হারামখোরের দেওয়া খাবার দেবো না। তুমি মেশিনটি ফেরত দিয়ে আসবে কিনা বলো?”
ইমন বিবির দৃঢ় প্রত্যয়কে নূর মুহাম্মদ ‘রিমাইন্ডার’ হিশেবে নিলেন। স্বামীকে হারামের পথ থেকে বাঁচাবে, এমন স্ত্রী কয়জনের ভাগ্যেই বা জোটে? নূর মুহাম্মদ কালবিলম্ব করলেন না। মেশিনটি ঐ সরকারি অফিসারের কাছে ফেরত দিয়ে আসলেন।
১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর। নূর মুহাম্মদ আর ইমন বিবির ঘরে এক ফুটফুটে রাজকুমারের জন্ম হলো। সদ্য দুনিয়ার আলো বাতাসের স্বাদ অনুভব করা ছেলেকে নূর মুহাম্মদ কোলে নিলেন। দারাজ দিলে বললেন,
“যদি তোমার এই জীবন ইসলামের কোনো উপকারে আসে, তাহলে দীর্ঘজীবী হও; অন্যথায় তোমার এই জীবন মূল্যহীন।”
মাত্র এক বাক্যে ছেলের জন্য দু’আ। হাদীসে আছে, সন্তানের জন্য পিতার দু’আ আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। [সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৮৬২] নূর মুহাম্মদের এই দু’আটি আল্লাহ কবুল করেছিলেন কিনা আল্লাহ ভালো জানেন। বাবা-মা পুত্রের নাম রাখেন মুহাম্মদ ইকবাল।
নূর মুহাম্মদের ছোট্ট ছেলেটি বেশ দুষ্টু হয়েছে। একদিন সে এক ভিখারীকে মারধর করে সব টাকা ছিনিয়ে আনে। এই বয়সে ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন সেটা কি বাস্তবে রূপ নেবে? নূর মুহাম্মদ ছেলেকে ডেকে বললেন, “শুনো বাবা। কিয়ামতের দিন এই ভিক্ষুক কাঁদবে আর আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে, এই বালক মুসলমানকে দিয়েছিলাম মানুষ করার জন্য, কিন্তু সে মানুষ না হয়ে কাদার তাল হয়েছে কেনো? কী জবাব দেবো আমি? তুমি কি চাও বাবাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে?” বালক বাবার আবেগী প্রশ্নে শুধু মাথা নাড়েন। ছোট্ট বালক বড়ো হয়ে তাঁর ‘রমুজে বেখুদী’ কাব্যগ্রন্থে বাবার সাথে সেদিনের কথোপকথন নিয়ে কবিতা লিখেন।
পাকিস্তানে পড়ালেখা শেষে আল্লামা ইকবাল উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান ইংল্যান্ডে। ভর্তি হোন বিশ্বের খ্যাতনামা ভার্সিটি ক্যামব্রিজে। একই সময়ে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হোন বিশ্বের বিখ্যাত ল’ কলেজ Lincolin’s Inn –এ।
এশিয়ার বাদামি রঙের ছেলেমেয়েদের গায়ে ইউরোপের হাওয়াবাতাস লাগলে তারা শিকড় ভুলে শিখরে উঠতে চায়। ইউরোপের রঙে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তারা আত্মপরিচয় ভুলে যায়। আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্যে তিনটি বসন্ত কাটিয়ে দেশে ফিরেন। অন্যান্যদের মতো মস্তিষ্ক পাশ্চাত্যে বন্ধক রেখে আসেননি। পাশ্চাত্যে গিয়ে উল্টো পাশ্চাত্যের ডিসকোর্স নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
তাঁর একটা কবিতার অনুবাদ হলো:
“হে পাশ্চাত্যবাসীরা!আল্লাহর পৃথিবী একটা দোকানঘর নয়।আর তোমরা যাকে সত্যিকারে স্বর্ণমুদ্রা মনে করছোতা মেকী বলে প্রমাণিত হবে।তোমদের নিজেদের খঞ্জরের উপরইআপতিত হবে তোমাদের সভ্যতা।ভঙ্গুর বৃক্ষ শাখায় নির্মিত কুলায়ভেঙ্গে পড়বে আজ নয় আগামীকাল।কখনো এ স্থায়ী হবার নয়।”
কবি পাশ্চাত্যে যান ১৯০৫ সালে। বহাবাহুল্য, কবির উপলব্ধির সত্যতা আমরা দেখতে পাই ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পাশ্চাত্যে যাবার আগে কবির মধ্যে চরম দেশাত্মবোধ ছিলো। ‘তারানি-ই-হিন্দী’ এর কবি লিখেছিলেন, ‘সারে জাহা সে আচ্চা হিন্দুস্তা হামারা’। সেই ‘তারানি-ই-হিন্দী’ -এর কবি পাশ্চাত্যে ‘শিক্ষা সফর’ শেষে এসে লিখেন ‘তারানা-ই-মিল্লি’। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠে নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই হাদীস, “মুসলিমরা একটি দেহের মতো”। [সহীহ মুসলিম: ৬৪৮০]
কবি লিখেন তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা:
“চীন ও আরব হামারা হিন্দুস্তা হামারামুসলিম হ্যাঁ হাম ওতন হ্যাঁ, সারে জাহা হামারা।”
যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:
“আরব আমার, ভারত আমার
চীনও আমার নহে গো পর,
মুসলিম আমি, সারাবিশ্বে
ছড়িয়ে রয়েছে আমার ঘর।”
১৯১০ সাল। মানুষে মানুষে হানাহানি, শিকলবন্দী মুসলিম সমাজের করুণ পরিণতি দেখে কবি ব্যাথিত হোন। ব্যাথিত হৃদয়ের কথাগুলো কবিতার ভাষায় সাজিয়ে বই লিখেন। বইয়ের নাম দেন ‘শিকওয়া’। এই কবিতায় তিনি আল্লাহর কাছে অভিযোগ, নালিশ করেন। কবিতার প্রথম ছত্রটি আমরা কবি গোলাম মোস্তফার অনুবাদে পড়ে নেবো।
“ক্ষতি কেন সইব বল? লাভের আশা রাখব না?অতীত নিয়েই থাকবো বসে- ভবিষ্যৎ কি ভাবব না?চুপটি করে বোবার মতন শুনব কি গান বুলবুলির?ফুল কি আমি? ফুলের মতন রইব নীরব নম্রশির?কণ্ঠে আমার অগ্নিবাণী- সেই সাহসে আজকে ভাইখোদার নামে করব নালিশ- মুখে আমার পড়ুক ছাই!”
কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হলে রাতারাতি আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ইকবাল হয়ে যান ‘টক অব দ্যা কাউন্ট্রি’। পতন্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মুসলমানদের চিন্তার খোরাক ছুঁড়েছিলেন ইকবাল। সেই তীর অনেকেই উল্টো তাঁর দিকে তাক করেন, তাকে ‘কাফির’ ফতোয়া দেন।
তিনবছর মানুষকে চিন্তায় ফেলে ইকবাল ১৯১৩ সালে লিখেন শিকওয়ায় আরোপিত প্রশ্নের জবাব- ‘জবাব-ই-শিকওয়া’। মুসলমানরা কেনো পতনের দাঁড় কিনারে আছে, সেটার জবাব লিখেন এভাবে:
“কওমের যারা ওয়ায়েজ, তারা ধার ধারে না’ক সুচিন্তারবিদ্যুৎ সম তাদের কথায় হয় না এখন আছর আর।রোমস হয়েছে আযানের বটে, আযানের রূহ বেলাল নাইফালসুফা আছে প্রাণহীন পড়ে, আল-গাযালীরে কোথায় পাই।মসজিদ আজি মার্সিয়া গায়- নামাযী নাহিক তার ভিতরহেজাযীরা ছিল যেমন- তেমন কোথায় মিলবে ধরার পর।খুব কহিছঃ দুনিয়া হতে বিদায় নিতেছে মুসলমান!প্রশ্ন আমারঃ মুসলিম কোথা? সে কি আজো আছে বিদ্যমান?চলন তোমার খ্রিস্টানী, আর হিন্দুয়ানী সে তমদ্দুন,ইহুদিও আজি শরম পাইবে দেখিলে তোমার এসব গুণ!হতে পার তুমি সৈয়দ, মির্জা, হতে পার তুমি সে আফগান,সব কিছু হও, কিন্তু শুধাইঃ বলত, তুমি কি মুসলমান?”
‘শিকওয়া ও জবাব-ই-শিকওয়া’ বইয়ের অনুবাদ মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠার। এই ছোট্ট বইয়ে ইকবাল যেভাবে মুসলিমদের আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেই প্রশ্নগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর উপলব্ধির পরিণতি দেখতে বেশিদিন লাগেনি। ‘জবাব-ই-শিকওয়া’ প্রকাশিত হবার মাত্র দশ বছর পর মুসলিমরা প্রায় তেরশো বছরের খিলাফত হারায়! আমরা ইতিহাস পড়ি, জীবনী পড়ি। কেনো পড়ি সেই প্রশ্নের কী উত্তর দেবো? অতীতকে জানার জন্য, অতীতকে বিশ্লেষণ করার জন্য, অতীত থেকে শিক্ষা নেবার জন্য, সহীহ-যঈফ নির্ণয়ের জন্য?
এই প্রশ্নের চমৎকার একটা উত্তর দেন আল্লামা ইকবাল। একজন ভিশনারী, কিভাবে ইতিহাস পাঠ করেন তার জবাব তিনি দেন এভাবে (যার কাব্যানুবাদ):
“গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে আমি আমার সামনে রাখিগতকালের আয়নায় আমি আগামীকালকে দেখি।”
যারা ইসলামকে ঔন করেন, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার’ নামে তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলা হয় সবসময়। সেই ঘৃণ্য রাজনীতির ছোবল থেকে আল্লামা ইকবালও রেহাই পাননি। ১৯১৫ সালে তাঁর প্রকাশিত ‘আসরার-ই-খুদী’ কাব্যগ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করতে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষার অধ্যাপক নিকলসের চেতনায় আঘাত লাগেনি। তিনি ১৯২০ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ –কে ইংরেজিভাষীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
অথচ সেই ইকবালকে ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রমাণ করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আঁতুড়ঘর থেকে ইকবালের নামটি মুছে ফেলা হয়। ইকবালকে যারা ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রমাণ করে ছুঁড়ে ফেলতে চাইতো, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তিনি পাল্টা আর্গুমেন্ট করেন:
“রবীন্দ্রনাথ যদি নতুন সভ্যতার বিন্যাসের কথা ভাবতে গিয়ে তপোবনের ভারতবর্ষের বর্ণনা করতে পারেন, যদি পুরাণ বা উপনিষদের শ্লোকে প্রশ্রয় খোঁজেন বারেবারে, তাকে কি বিশেষভাবে সাম্প্রদায়িক ভাবী তখন? তবে ইকবালই বা কেন ভাবতে পারবেন না যে, কুরআনের মধ্যেই থেকে গেছে অনেক সমাধান-সূত্র?”
আল্লামা ইকবালের কবিতায় এক নবজাগরণের সুর ফুটে উঠে। রাত্রিবেলা ঘুমন্ত মানুষকে যেমন ডাহুক পাখি জাগানোর চেষ্টা করে, তার কুহুক-কুহুক আওয়াজে যেমন সে রাত্রির বিদায় ঘন্টা বাজায়, ইকবালও তেমনি মুসলিম মানসে ডাহুক পাখির মতো আওয়াজ তুলেছিলেন। একদিন রাত পেরিয়ে সেই কাঙ্কিত ভোর আসবে। কবির আশাবাদের সাথে আমরাও সুর মেলাই।
“প্রভাতের আলোয় এই তিমির রাত্রির হবে অবসানএই উদ্যান করবে পুলকিত তাওহীদের প্রাণ মাতানো গান।”