ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই কয়েক যুগ আগে। বাংলাদেশে বেশ জুড়ালো একটা বিতর্ক চলছিলো পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই বইমেলায় ‘আমদানী’ করা হবে কি-না। এই নিয়ে সাহিত্যিক, কর্তৃপক্ষ দুই দলে ভাগ হয়ে যান। পত্রিকায় পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হয়।
আহমদ ছফাও সেটা নিয়ে কলম ধরেন। দুই পক্ষের বাইরে গিয়ে তিনি তৃতীয় চোখে বিষয়টি দেখেন। তিনি লিখেন:
“এই তর্ক বিতর্কের ধারা যেদিকে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় উভয় পক্ষই আসল বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মূল বিষয়, বাংলাদেশে ভালো বই লেখা, প্রকাশ এবং বিপনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। আমরা আমাদের দেশের পাঠকের রুচি তুষ্ট করতে পারি এমন বইপত্র যদি লিখতে না পারি, ধরে নিতে হবে সেখানে আমাদের একটা পরাজয় ঘটে গেলো।” [হারানো লেখা, আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ১২০]
আহমদ ছফার আর্গুমেন্ট ছিলো- নিজের দেশে যদি ভালো লেখকের আবির্ভাব ঘটে, তবেই কলকাতার লেখকদের আধিপত্য কমে যাবে। বিশ্বায়নের যুগে ‘ব্যান’ করে কিছু ঠেকানো যাবে না। তার ঠিক দুই দশক পর আমরা দেখতে পাই বইমেলায় বাংলাদেশী লেখকদের জয়জয়কার। কলকাতামুখী যে দৌড় ছিলো, সেটা কমা শুরু হয়। এটার পেছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘বাজারী লেখক’ বলে তাকে যারা সমোলোচনা করেন, তারাও একথা স্বীকার করেন।
কলকাতামুখী সাহিত্যকে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশমুখী করেন। কলকাতাকেন্দ্রীক সাহিত্যের কাল্ট ভাঙ্গাটা এতোটা সহজ ছিলো না। হুমায়ূন আহমেদ কৃত্রিমতা বর্জিত এক নতুন গদ্য বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেন; যা ছিলো এই অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি।
যারা ভারতীয় বাংলা সাহিত্যপাঠে অভ্যস্ত ছিলো, হুমায়ূন আহমেদের আগমনের সাথে সাথে তারাও রুচি বদল করলো। সাধারণ পাঠকের মধ্যে যেমন এর প্রমাণ দেখতে পাই, হুমায়ূন আহমেদের মায়ের মধ্যেও এটা দেখতে পাই।
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ লিখেন:
“হুমায়ূন লেখা শুরু করার আগে আমি ভারতীয় লেখকদের লেখা অনেক পড়তাম। কোনো বই না পাওয়া গেলে ভারত থেকে আনিয়ে নিতাম। কিন্তু ছেলে লেখা শুরু করার পর অন্য কারো লেখা পড়ার আর প্রয়োজন পড়ে নি। ছেলের লেখা প্রতিটি উপন্যাসই আমার প্রিয়।” [হুমায়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১২]
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো- উপন্যাসের প্লট জীবনঘনিষ্ঠ। আমাদের আশেপাশে যা ঘটছে সেটা নিয়েই তিনি লিখতেন। আলাদা করে কোনো একটা প্লট দাঁড় করাতেন না, ধার করতেন না। যার ফলে পাঠক সবসময় নিজের সাথে রিলেট করতে পারতো।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়তে গেলে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, সেটা হলো তার পাঠাভ্যাস। ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে হাল আমলের ফিকশন, নন-ফিকশন তিনি নিয়মিত পড়তেন। সাধারণত একজন উপন্যাসিক এতো এতো বই পড়েন না। হুমায়ূন আহমেদ যেমন দু-হাতে লিখেছেন, তেমনি পড়ার জন্যও নিজেকে আলাদা সময় দিতেন।
এমনকি ইসলাম সম্পর্কেও তার বেশ ভালো জানাশোনা ছিলো (তাকে ‘ইসলামিস্ট’ বলছি না কিন্তু)। বাংলাদেশের প্রকাশনী সেক্টরকে দুইভাগে ভাগ করি- চকবাজারী প্রকাশনী (ইসলামি + বাংলাবাজারের ইসলামিক টাওয়ার) এবং বাংলাবাজারী প্রকাশনী। বাংলাবাজারের প্রকাশনীর লেখকদের ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান ছিলো-আছে, হুমায়ূন আহমেদের আর-দশজন লেখকদের চেয়ে বেশি জ্ঞান ছিলো।
হুমায়ূন আহমেদের শেষজীবনের লেখাগুলোতে তিনি যেভাবে সহীহ হাদীস, জাল হাদীস, বিদআত নিয়ে লিখছেন, সেটা পড়ে তো অনেক পাঠক অবাক হবেন। উকিলবাপ ইসলামী রীতিসিদ্ধ নয় বলে তিনি জীবনে অনেকবার উকিলবাপ হলেও শেষে এসে বলেন- এটা হারাম। এরকম র্যাডিকাল চেঞ্জ কিভাবে হলো? তিনি যখন অ্যামেরিকায় ছিলেন, তখন পরোক্ষভাবে ইয়াসমিন মুজাহিদ দ্বারা প্রভাবিত হোন (সে এক বিশাল কাহিনী)। বাংলাদেশে ফিরে তিনি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের (রাহিমাহুল্লাহ) অনুরোধে নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী লেখা শুরু করেন।
তিনি যেমন ‘সহীহ ইসলাম’ নিয়ে লিখেন, তেমনি তার অনেকগুলো লেখায় ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন। যেমন: তাঁর আত্মজীবনী ‘হিজিবিজি’ –এর একটা অনুচ্ছেদ ছিলো ‘এখন আমি কোথায় যাব? কার কাছে যাব?’ ঐ লেখায় তিনি কাবা ঘরে মাদার মেরীর ছবি নিয়ে আলফ্রেড গিয়োমের একটা বিকৃত তথ্যের রেফারেন্স দেন। এমনকি রেফারেন্সের বাইরে গিয়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন- ভাস্কর্য জায়েজই নয়, নবী-খুলাফায়ে রাশেদার ‘সুন্নাত’! কয়েকবছর আগে আমি সেটাকে ‘রিফিউট’ করে লিখেছিলাম।
তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা বই সংকলিত হয়, নাম- ‘এক ডজন হুমায়ূন আহমেদ’। সেই বইয়ে তিনি ইসলামে চোরের হাত কাটার বিধানকে ‘সেকেলে’ বলেছেন। এটা নিয়েও আমি বছর দুয়েক আগে লিখেছিলাম।
দুয়েকটা বিষয় রিফিউট করার উদ্দেশ্য ছিলো- উপন্যাস হোক, গল্প হোক, কবিতা হোক, সেগুলো পড়তে গিয়ে যেনো আমরা মুগ্ধ হয়ে সবকিছুকেই বাহবা দিয়ে গ্রহণ না করি। গল্প-উপন্যাস পড়ে মজা পেতে গিয়ে শিক্ষা নেবার বদলে যেনো ‘দীক্ষা’ না নিই। গ্রহণ এবং বর্জন করার মাপকাঠিও আমাদের থাকতে হবে। কুরআন-সুন্নাহর সেই ফিল্টার দিয়েই আমরা সেগুলো পড়বো, যাচাইবাছাই করবো। সেটা হোক হুমায়ূন আহমেদ, নজরুল, আল মাহমুদ, ফররুখ হোয়েভার।
টিন-এইজে ‘হিমু’ পড়ে হিমু হতে চায়নি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ল্যাপটপের গ্যালারিতে হলুদ পাঞ্জাবি আর খালি পায়ের আমার পুরনো ছবিগুলো দেখলে এখন হাসি পায়! হাল আমলে ‘সাজিদ’ আসার আগে বাংলাদেশের সাহিত্যে সবচেয়ে এবং সর্বশেষ প্রভাব সৃষ্টিকারী চরিত্র ছিলো হিমু। একটা ফিকশনাল চরিত্রের বাইরে গিয়ে হিমু চরিত্রটি হয়ে উঠেছিলো যুবকদের ‘আইডল’।
হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল ‘কোথাও কেউ নেই’ –এ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি উপলক্ষে বাংলাদেশে যে আন্দোলন হয়েছিলো, বহির্বিশ্বে এটা খুব স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র কি-না সেটা ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন। যুবকরা রাজপথে স্লোগান দিয়েছিলো- ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। যুবতীরা স্লোগান দিয়েছিলো- ‘আমরা সবই মুনা হবো, এতো বাকের কোথায় পাবো?’
উপন্যাস লেখার পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ বেশ কিছু কবিতাও লিখেন। কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ নামে। কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা পড়ে গৃহত্যাগ করার সাধ জাগেনি এমন পাঠক কয়জন আছেন খুঁজে দেখতে হবে। ‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে/আমার আজন্ম সলজ্জ্ব স্বাদ আকাশে কিছু ফানুস উড়াই’ কবিতার লাইনগুলো মাইডে, ফেসবুক কাভারে রাখা তরুণ-তরুণীর অভাব নাই।
এই যে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আমাদের একটা মোহ/ক্রেইজ কাজ করে, তার পেছনেও তো কিছু কারণ আছে। আমরা যারা নিজেদেরকে ‘পড়ুয়া’ বলে দাবী করি, আমাদের পড়ুয়া হবার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান হুমায়ূন আহমেদের। বাংলাদেশের লক্ষাধিক যুবক-যুবতীকে ‘আউটবই’ পড়ুয়া বানিয়েছেন এই হুমায়ূন আহমেদই। বদরউদ্দীন উমরসহ অনেক ‘গবেষক’ হুমায়ূন আহমেদকে অনেকবার ‘বাজারী লেখক’ বললেও পাঠকের মানস থেকে হুমায়ূন আহমেদকে এখনো মুছে দিতে পারেননি। হাল আমলে হুমায়ূন আহমেদের ‘কাল্ট’ যারা ভাঙ্গতে চাচ্ছেন, তাঁদের বেশিরভাগই হুমায়ূন আহমেদ দ্বারা প্রভাবিত। যার ফলে লেখার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ছাপ খুব সহজে ধরা পড়ে (আমি নিজেও সেই দোষে দুষ্ট)।
হুমায়ূন আহমেদ পাঠককে প্রভাবিত করেছেন, পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে- তিনি কার দ্বারা প্রভাবিত হোন? আমার অবজারভেশন অনুযায়ী- হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ দ্বারা। তার এমন পাঁচটি বই দেখান, যেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের কোনো গান/কবিতা বা ঘটনা নেই।
হুমায়ূন আহমেদ যখন অ্যামেরিকায় যান পিএচডি করতে, তখন তার কাছে ছিলো একটা মাত্র বাংলা বই। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’। এমনকি আমি খুঁজে দেখলাম- মেঘ বলেছে যাব যাব, আগুনের পরশমণি, চলে যায় বসন্তের দিন, চক্ষে আমার তৃষ্ণা, সবাই গেছে বনে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, সকল কাঁটা ধন্য করে, বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল, ছায়াবীথি, আমার আপন আঁধার, আকাশ জোড়া মেঘ নামের কমপক্ষে এগারোটি বইয়ের নামকরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান থেকে। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিয়ে কয়েকমাস আগে লিখেছিলাম। সেখানে গানগুলোর রেফারেন্সও দিয়েছি।
হুমায়ূন আহমেদকে ডিঙ্গিয়ে যারা নতুন ধারার সাহিত্য রচনা করতে চান, তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। তার আগে বাংলাদেশের সাহিত্যের (নট বাংলা সাহিত্যে) সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখককে পাঠ করতে হবে, তিনি যে বিপ্লব এনেছেন সেটার স্বীকৃতি দিতে হবে। অবশেষে যদি হুমায়ূন আহমেদকে ডিঙ্গানো সম্ভব হয়, ড. সলিমুল্লাহ খানের ভাষায় হয়তো সেটাকে বলা যাবে ‘বেহাত বিপ্লব’। কয়েক যুগ আগে প্রশ্ন উঠেছিলো- কলকাতার সাহিত্য পড়া যাবে কি-না। এখন ‘আমাদের ঘরে’ প্রশ্ন উঠছে- হুমায়ূন আহমেদ পড়া যাবে কি-না? এক্ষেত্রেও আহমদ ছফার আগের বক্তব্যের সাথে একটা শব্দ জুড়ে দিলে সমাধান পেয়ে যেতে পারি।
“এই তর্ক বিতর্কের ধারা যেদিকে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় উভয় পক্ষই আসল বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মূল বিষয়, বাংলাদেশে ভালো (ইসলামী) বই লেখা, প্রকাশ এবং বিপনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। আমরা আমাদের দেশের পাঠকের রুচি তুষ্ট করতে পারি এমন বইপত্র যদি লিখতে না পারি, ধরে নিতে হবে সেখানে আমাদের একটা পরাজয় ঘটে গেলো।”