(১)
এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যে কারণে রেফারেন্স না থাকলে আমি কোন কিছু পড়তে চাই না। একজনের ব্যবহার করা রেফারেন্স দেখে বোঝা যায় সে কোন লেভেলের লেখক/স্কলার। তার লেখা কতটুকু গ্রহণযোগ্য। সে কোন সোর্সগুলো ব্যবহার করেছে, আর সে সোর্সগুলো কোন মাত্রায় গ্রহণযোগ্য। যদি সবাই রেফারেন্স ব্যবহার করতো, তাইলে অনেক প্রবলেম সল্ভ হয়ে যেতো। বোঝা যেতো একজন কোন সোর্স থেকে তথ্যগুলো আনছে, লেখাটা আংশিক ভালোভাবে স্টাডি করা না পুরোটা ঠিকভাবে স্টাডি করা, লেখার কোন অংশ গবেষণামূলক আর কোন অংশ মনগড়া।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি কুরআন নিয়ে লিখতে গিয়ে উইলিয়াম মুইর এর মত স্কলার কে ব্যবহার করে, তাইলে ধরে নিবো লেখক কাচা আর এই লেখা বেশি একটা কাজের হবে না, কেননা মুইর অ্যাকাডিমিয়ায় পুরোপুরি রিজেক্টেড। কিন্তু লেখক যদি অ্যাঞ্জেলিকা নইওয়ার্থ কে ব্যবহার করে, তাইলে বুঝবো যে লেখক জানে কোন সোর্স শক্ত আর সে সঠিক ভাবে তার কাজ করছে। সুতরাং এর লেখা পড়া যাবে। এভাবে যখন আপনি যথেষ্ট স্টাডি করে একটা পর্যায়ে আসবেন, তখন বই/পেপার পড়ার আগে রেফারেন্স/বিবলিওগ্রাফি দেখে একটা আপাত ধারণা করতে পারবেন, যা পড়ছেন তা কতটুকু শক্ত আর বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু এমন একটা শক্ত কালচার তৈরি করতে হলে সবার রেফারেন্স দিয়ে লিখতে শুরু করতে হবে। রেফারেন্স দিয়ে লিখলে ভুলভাল তথ্যের পরিবেশ অনেকাংশে কমে যাবে।
(২)
তথ্য চেক করার জন্য ও আরও তথ্যের জন্য। সাধারণভাবে এটা মূল কারণ হিসেবে দেখা হয় তবে উপরের টা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যাহোক, উদাহরণের জন্য শাহ আকবর খান নাজিবাবাদির ইতিহাসের বইটা ধরুন। এই বইটার আলাদা সম্মান ও গুরুত্ব আছে, যদিও রেফারেন্স বলতে কিছু নাই। ধরুন বইয়ের একটা টপিক আপনার অনেক ইন্টারেস্টিং লাগলো, আপনি এ ব্যাপারে আরো জানতে চান। যদি বইয়ে রেফারেন্স দেওয়া থাকতো, আপনি সেই রেফারেন্স এর অনুসরণ করে যা জানার জেনে নিতে পারতেন, রেফারেন্স সেকেন্ডারি হলে সেখানে আরো সোর্স পেতেন আর সেসব গ্রহণযোগ্য হত। কিন্তু যখন রেফারেন্স নাই, আপনার এখন নিজ থেকে সোর্স খুজে বের করতে হবে আরো জানার জন্য। গ্রহণযোগ্য কিনা, আসলেই কাজের কিনা বুঝতে হলে যা বের করবেন সব পড়ে দেখতে হবে। এতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়।
আর যারা রেগুলার স্টাডি করে তাদের জন্য এই সময় নষ্ট অনেক কিছু। সবার জন্যই অনেক কিছু, কারণ একটা বই পড়ে তার ভিতর কেবল একটা জিনিস তো আপনার ইন্টারেস্টিং লাগবে না। অনেক কিছু নিয়েই আরো জানতে ইচ্ছা হবে। উপরে উল্লেখিত বইটার মধ্যে ধরুন আপনার ৩০ টা টপিক নিয়ে আরো জানতে ইচ্ছা হল। এখন ৩০টা বিষয়ে সোর্স খুজে বের করা, সেসব পড়ে নিশ্চিত হওয়া যে আসলেই কতটুকু কাজের – এর জন্য কত সময় চলে যাবে ভাবতে পারেন? রিসার্চারের জন্য রেফারেন্সহীন জিনিস পড়া, সোজা কথায়, বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যা।
(৩)
সোর্স বাচাঁনোর জন্য। যদি সাইটেশন দেওয়া না হত, দুনিয়া থেকে অসংখ্য বই-পেপার হারিয়ে যেত। পৃথিবীর প্রতিটা রিসার্চার রেফারেন্স মাইনিং করে তার রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল খুজে বের করে, বুকশপে ঘুরে ঘুরে না। এখানে অনেক ভালোমানের ম্যাটেরিয়াল থাকে যা জনপ্রিয় হয় না, কিন্তু একটা টপিকের রিসার্চার নিজ বিষয়ের সবকিছু স্টাডি করেন, সাইটেশনে সবকিছু দেন। যদি না দিতেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সোর্স হারিয়ে যেত। মূল্যবান তথ্য গুলো আমরা পেতাম না। আর এর উপর জানতে পারতাম না যে একটা বিষয়ে ইতোমধ্যে রিসার্চ হয়ে গিয়েছে আর আবারো তার উপর একই কাজ করার মানে হয় না। সেটা সিরিয়াস সময় নষ্ট কেননা একটা রিসার্চ পেপার মানে দিনের পর দিন পরিশ্রম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষ পড়ার সময় এমন অনেক সোর্স চোখে পড়ে যা আগে কোথাও দেখিনি। ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, ইসলামী বিজ্ঞান নিয়ে লেখা বাংলদেশি লেখকদের রিসার্চ চোখে পড়ে। কিন্তু সেসবের ব্যাপারে কারোরই কিছু জানা নাই কেননা বাংলাদেশে রেফারেন্স দিয়ে লেখার কালচার নাই। যার ফলে মূল্যবান সোর্সসব হারিয়ে যাচ্ছে। আগে করা কাজ এখন আবার করতে হচ্ছে কেননা আগের কাজ আর পাওয়াও যায় না।
(৪)
নিজের চেক করার জন্য। একজন লেখক যখন রেফারেন্স ছাড়া লিখেন, তখন মস্তিষ্ক এ যা আছে তা লিখে দেন। অনেক আগে কিংবা যদি সেটা এক সপ্তাহ আগেও হয়, মাথায় যা আছে তা তিনি লিখে দেন যার ফলে ভুলের সম্ভাবনা থাকে সহজেই। যদি একজন রেফারেন্স দিয়ে লিখতেন, রেফারেন্স এ পৃষ্ঠাসংখ্যা উল্লেখ করতে হত তবে লাস্ট মুহূর্তে লেখকের বই/পেপার দেখে নাম্বারটা দিতে হত, ফলে তিনি শেষবারের মত তথ্যটাও চেক করে নিতেন। এর ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে কমে যায়। এ থেকে আশা করি আপনারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন রেফারেন্সহীন লেখক ও রেফারেন্সসহ লেখকের আকাশ-পাতাল তফাৎ। যার জন্য রেফারেন্সসহ লেখকের ক্রেডিবিলিটি রেফারেন্সহীন লেখক থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়।
————–
ইবনু তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ উনার সময়ে বলেছিলেন যে ভুল আর্গ্যুমেন্ট দেওয়া হারাম।* আর আমার পুরোপুরি মনে হয় যে নির্দিষ্ট বিষয়ে ও নির্দিষ্ট টাইপের কিছু লিখার জন্য উলামার ঘোষণা করা উচিত যে, রেফারেন্সহীন ভাবে লেখা গুনাহের কাজ।
———————–
*Carl Sharif el-Tobgui, Ibn Taymiyya on Reason and Revelation: A Study of Darʾ taʿāruḍ al-ʿaql wa-l-naql (Leiden: Brill, 2020) p. 174.